অমিক্রনের প্রভাবে আবার অনিশ্চয়তা বিশ্ব অর্থনীতিতে
অক্টোবর মাসে বৈশ্বিক খাদ্যের মূল্যসূচক দাঁড়িয়েছে ১৩৩ দশমিক ২ পয়েন্ট, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির ক্রমবর্ধমান দাম, পুনরুদ্ধারের মিশ্র গতি—বিশ্ব অর্থনীতি গত কয়েক মাস এসব নিয়েই সরগরম ছিল। তবে হঠাৎ করে ইউরোপে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি ও আফ্রিকায় অমিক্রন নামে করোনাভাইরাসের নতুন প্রজাতির সন্ধান সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিচ্ছে।
জ্বালানির তেলের দাম কয়েক মাস ধরেই বাড়ছিল। একপর্যায়ে তা প্রতি ব্যারেল ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ করেই ইউরোপে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় লাগাম পড়ে তেলের দামে। ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে অস্ট্রিয়ায় লকডাউন আরোপ করা হয়েছে। বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি দেশে। ফলে চাহিদা কমেছে। সেই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় আরও কয়েকটি দেশ মজুতভান্ডার থেকে বাজারে তেল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে বাজারে তেলের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দাম আবার নিম্নমুখী। সম্প্রতি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের নিচে নেমে গেলেও, আবার তা ৭০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
এসব মিলিয়ে বাজারের অবস্থা এখন মিশ্র। তেলের দাম কমে যাওয়া স্বস্তির খবর। এতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি বাড়বে। কিন্তু ইউরোপে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া অশনিসংকেত। তার সঙ্গে আছে নতুন প্রজাতি অমিক্রন নিয়ে ভীতি। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য এটি শঙ্কার। কারণ, দেশের রপ্তানি পণ্যের ৮০ শতাংশের বেশি হলো তৈরি পোশাক। আর সেই পোশাকের বড় গন্তব্য হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ফলে ইউরোপে লকডাউন বা বিধিনিষেধ দেশের রপ্তানিকারকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলবে।
তবে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশসহ সবখানেই খাদ্যের মূল্যস্ফীতি শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুসারে, অক্টোবর মাসে বৈশ্বিক খাদ্যের মূল্যসূচক দাঁড়িয়েছে ১৩৩ দশমিক ২ পয়েন্ট, যা
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। টানা তিন মাস বৃদ্ধির পর এই সূচক এখন ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ জায়গায় আছে। এফএওর তথ্যানুসারে, অক্টোবর মাসে মূল্যসূচক বৃদ্ধির কারণ হলো, শস্য ও ভেজিটেবল অয়েলের মূল্যবৃদ্ধি।
সামগ্রিকভাবে সব দেশেই মূল্যস্ফীতি এখন বাড়তি। চলতি নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা মূল্য সূচক ৩১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছেছে। ফেডারেল রিজার্ভসহ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যদিও বলছে, এই মূল্যস্ফীতি সাময়িক, তবে বিশ্লেষকেরা সেই কথা মানতে নারাজ। তাঁদের শঙ্কা, মূল্যস্ফীতি আরও দীর্ঘদিন বাড়তি থাকবে।
মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা জন ওয়ালড্রন গত মাসে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ১ নম্বর ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এতে শেয়ারবাজারের অবস্থাও খারাপ হতে পারে।
অন্যদিকে আরেক বিনিয়োগ ব্যাংক জে পি মরগ্যানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেমি ডিমন রয়টার্সকে বলেছেন, ব্যাংকগুলোর শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ সুদহারের কারণে পণ্যমূল্য অত্যন্ত বেশি হারে ওঠানামা করে।
নতুন প্রজাতির দাপট
এদিকে অমিক্রনের দাপটে বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারেও ধস নামতে শুরু করেছে। সোমবার এশিয়া মহাদেশজুড়ে সূচক পড়ে গেছে। জাপানের নিক্কি সূচক পড়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ, হংকংয়ের হ্যাং শেং সূচক কমেছে ১ শতাংশ। তবে চীনের সাংহাই কম্পোজিট সূচক অপরিবর্তিত আছে। তবে ইউরোপের বাজার এই ধাক্কা অনেকটাই সামলে নিয়েছে।
এদিকে অমিক্রনের প্রভাবে তেলের দাম প্রাথমিকভাবে কমার পর আবার কিছুটা বেড়েছে। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৩ শতাংশ বেড়ে ৭৫ ডলার এবং ইউএস ক্রুড ৪ শতাংশ বেড়ে ৭১ ডলারে উঠেছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আগামী কয়েক সপ্তাহ তেলের বাজার এক রকম অনিশ্চিত থাকবে।
করোনাভাইরাসের নতুন প্রজাতির কারণে দেশে দেশে বিধিনিষেধ আরোপ করতে শুরু করেছে। এতে সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে। ইতিমধ্যে জাপান অনাবাসী বিদেশি নাগরিকদের আসা নিষিদ্ধ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন প্রজাতিকে উদ্বেগজনক হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তারা নতুন প্রজাতিকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দিয়েছে।
এই বাস্তবতায় বিশ্ব অর্থনীতি আবার কিছুটা অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।