মৌসুমে শতকোটি টাকার বাণিজ্য
করোনার বিধিনিষেধ ও মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কারণে মিরপুর এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছেন ওই এলাকার বেনারসিপল্লির ব্যবসায়ীরা। ওখানকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুই বছরের তুলনায় এ বছর তাঁদের বিক্রি ভালো। পাশাপাশি আগামী মৌসুমে আরও ভালো বিক্রির আশা করছেন তাঁরা।
বেনারসিপল্লির বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও বিক্রয়কর্মী জানান, করোনার কারণে মিরপুর বেনারসিপল্লিতে বেচাকেনা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ কমে যায়। এর আগে ওই এলাকায় মেট্রোরেলের কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। এ কারণেও ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বর্তমানে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ বলতে গেলে শেষ। আবার করোনার ধাক্কাও কেটে গেছে। তাতে ব্যবসায় আবার ধীরে ধীরে সুদিন ফিরতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, এখন পর্যন্ত
তাঁদের হারানো ব্যবসার ৮০ শতাংশ পুনরুদ্ধার হয়েছে।
নিজস্ব তাঁতির হাতে তৈরি বেনারসি শাড়ি বিক্রি করে মিতু কাতান শাড়িঘর। পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানি করা পোশাকও বিক্রি হয় এই দোকানে। জানতে চাইলে মিতু কাতান শাড়িঘরের ব্যবস্থাপক আকরাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা ও মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কারণে ব্যবসায় যে মন্দাভাব নেমে এসেছিল, তা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। আশা করছি, আগামী মৌসুমে ভালো বিক্রি হবে।’
বেনারসি শাড়ির বাজার
মিরপুর বেনারসিপল্লির ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে সোনারগাঁও, টাঙ্গাইল, নরসিংদী, আড়াইহাজার ইত্যাদি স্থানে বেনারসি বানানো হলেও মিরপুরেই তৈরি হয় সবচেয়ে উন্নত মানের বেনারসি শাড়ি। বর্তমানে বেনারসিপল্লির দোকানগুলো মিরপুর-১০ ও ১১ ও সাড়ে ১১ এলাকাজুড়ে অবস্থিত। এর মধ্যে মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় দোকান আছে প্রায় ১১০টি। এর মধ্যে ২০ শতাংশ দোকান নিজস্ব তাঁতে শাড়ি বানায়। অন্যরা তাঁতি বা বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে শাড়ি কিনে তা বিক্রি করে। আর মিরপুর–১১ নম্বর এলাকায় আছে আরও প্রায় ৩০টি দোকান। এসব দোকান থেকে থেকে সারা দেশে পাইকারি দরে বেনারসি শাড়ি বিক্রি হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে মিরপুর বেনারসিপল্লিতে কারিগরসহ প্রায় দেড় হাজার তাঁতি কাজ করছেন। তাঁদের সঙ্গে কাজ করছেন আরও প্রায় আড়াই হাজার সহকারী। এ ছাড়া চার থেকে পাঁচ হাজার লোক কাজ করছেন দোকানগুলোয়। সব মিলিয়ে মিরপুর বেনারসিশিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন ১০ থেকে ১২ হাজার লোক।
মৌসুমে বিক্রি দেড় শ কোটি টাকা
সাধারণত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসকে বিয়ের মৌসুম ধরে নেওয়া হয়। এ সময়েই সবচেয়ে বেশি বেনারসি শাড়ি বিক্রি হয়। বিয়ের মৌসুমে মিরপুর-১০–কেন্দ্রিক বেনারসিপল্লির দোকানগুলোয় প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়। এতে এক মৌসুমে প্রায় ৩০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয় বলে জানান বেনারসিপল্লি দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবুল কাশেম। আর মিরপুর-১০, ১১ ও সাড়ে ১১ নম্বর এলাকার বেনারসি শাড়ির পাইকারি ও খুচরা বিক্রির সব দোকান মিলিয়ে প্রায় শতকোটি টাকার শাড়ি বিক্রি হয়।
তবে স্বাভাবিক সময়ে বিক্রি খুব বেশি হয় না বলে জানান আবুল কাশেম। তিনি বলেন, বছরের অন্য মাসগুলোয় বিক্রি একদমই কম থাকে। কোনো কোনো মাসে লোকসানও গুনতে হয়। মৌসুমের বিক্রির আয় থেকে সেই ক্ষতি পোষাতে হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, মিরপুর-১০ এলাকার বেনারসিপল্লির ১১০টি দোকানের মধ্যে বড় বড় ২০টি দোকানকে মোটাদাগে লাভজনক বলা যায়। অন্যদের আয়-ব্যয় প্রায় সমান সমান থাকে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। আর কারও কারও ব্যবসায় কোনো কোনো বছর লোকসান গুনতে হয়। বিয়ের মৌসুম ছাড়াও ঈদের সময় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি বিক্রি হয়।
শাড়ি ও দরদাম
বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান কিংবা সব সময় পরা যায়, এমন ২৫ থেকে ৩০ ধরনের শাড়ি বিক্রি হয় বেনারসিপল্লিতে। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের নকশার কাতান শাড়ি অন্যতম। এ ছাড়া জামদানিসহ দেশীয় অন্যান্য শাড়িও আছে; পাশাপাশি বিক্রি হয় ভারতীয় বিভিন্ন শাড়িও।
বেনারসি কুঠিরের মালিক রকিবুল হাসান জানান, দেশীয় বেনারসি শাড়ির দাম সর্বনিম্ন ২ হাজার থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া ভারতীয় শাড়িগুলো ৩ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, বেশি দামের দেশীয় বেনারসি শাড়ি বেনারসিপল্লিতে কম বিক্রি হয়। এসব শাড়ি ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় বড় বিপণিবিতানে
বিক্রি হয়।
করোনার প্রভাব
করোনার কারণে দুই বছর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়ে বেনারসিপল্লির ব্যবসায়ী ও তাঁতি উভয় পক্ষই। তাঁতিরা অনেকে করোনার সময় পেশা ছেড়ে দেন। আর সরকারি বিধিনিষেধের কারণে টানা কয়েক মাস দোকানপাট বন্ধ ছিল।
বেনারসিপল্লি দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবুল কাশেম জানান, করোনার কারণে বেনারসিপল্লির বড় দোকানগুলোয় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আর ছোট দোকানগুলোর ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে গত দুই বছরে এখানকার ১০টির বেশি দোকানের মালিকানার হাতবদল হয়েছে। এ সময়ে অনেকে ব্যাংকঋণ নিয়ে ব্যবসা ধরে রেখেছেন। আবার অনেকে তাঁতিদের টাকা আটকে রেখেছেন ক্ষতি পোষাতে।
এভাবে আর এক বছর লোকসান হলে আরও ২০ থেকে ২৫টি দোকানের মালিকানা বদল হতে পারে বলে শঙ্কার কথা জানান আবুল কাশেম। ব্যবসায় টিকে থাকতে করোনার সময় ব্যবসায়ীদের জন্য নানা প্রণোদনা ঘোষণা করা হলেও মিরপুরের বেনারসিপল্লির তাঁতি ও দোকানমালিকেরা কোনো প্রণোদনা পায়নি বলেও জানান তিনি।
শাহ আলী বেনারসি কুঠিরের মালিক রায়হান সিদ্দিক বলেন, ‘এবারের ঈদের সময় যতটা বিক্রি হবে ভেবেছিলাম, তা হয়নি। বছরজুড়ে এ অবস্থা চললে খুব একটা লাভের মুখ দেখতে পারব না।’
কাশফিয়া শাড়ি কালেকশনের মালিক মো. কামাল হোসাইন বলেন, এবার তাঁর দোকানে বিক্রি ভালো হয়েছে। তাতে মোটামুটি ভালো লাভ করেছেন এবার। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত দুই বছরের ক্ষতি পোষাবে না।
দেশীয় বেনারসিকে ভ্যাটমুক্ত রাখার প্রস্তাব
ঐতিহ্যবাহী বেনারসিপল্লি ও বেনারসি শাড়ির ব্যবসা ধরে রাখতে এবং বাজার বড় করতে দেশে তৈরি বেনারসি শাড়িকে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। দিয়া শাড়িজের মালিক আবুল কাশেম বলেন, ‘দেশীয় কোনো শিল্প সুনাম অর্জন করলে সাধারণত সরকার তাতে ছাড় দেয়, ভর্তুকি দেয়। কিন্তু এই বেনারসিপল্লিতে আরও বেশি করে কর ও ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ ভারতে ৩০০ বছরের পুরোনো বেনারসিশিল্পে বিদ্যুৎ, পানি, চিকিৎসাসেবাসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়। বিদেশি পণ্য থেকে ভ্যাট নিক, তাতে আমাদের কোনো সমস্যা তো নেই। আমরা দেশীয় বেনারসি শাড়িকে ভ্যাটমুক্ত রাখার দাবি জানাই।’