গত মঙ্গলবার বেলা দুইটা। রাজধানীর গ্রিন রোডে জাহানারা মার্কেট-সংলগ্ন সড়ক। ষাটোর্ধ্ব এক নারী উদ্দেশ্যহীনভাবে পায়চারি করছেন। রাস্তার এক পাশে জাহানারা মার্কেট, আরেক পাশে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি)। রাস্তার দুই পাশের দুই ভবনের মধ্যে আসা-যাওয়া করছেন তিনি। দূর থেকে বেশ কিছু সময় অনুসরণ করলাম। এরপর জাহানারা মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলাম, কেন তাঁর এই উদ্দেশ্যহীন পায়চারি। উত্তরে বললেন, বাবা, কাজ নেই। করোনা কাজ কেড়ে নিয়েছে। সময় কাটছে না। হাতের মুঠোয় গোঁজা ৫০ টাকার একটি নোট দেখিয়ে বললেন, সম্বল বলতে এটুকুই। দুপুরের খাবার খেলেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ সম্বল খরচ করতে মন চাইছে না। একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন হিরুণ নেছা।
এমনিতেই জীবন ছিল তাঁর বিভিন্ন সংকটের, সংগ্রামের। করোনা এসে হিরুণ নেছার জীবনকে করেছে আরও বিপর্যস্ত। করোনার আগে গ্রিন রোডের জাহানারা মার্কেটে ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করতেন। বাজার কমিটি থেকে মাসে বেতন পেতেন তিন হাজার টাকা। কিন্তু করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের কারণে মার্কেট বন্ধ। তাই ঝাড়ু দেওয়ার কাজও নেই তাঁর। কাজ নেই তো বেতনও বন্ধ। টানা কয়েক মাসের বেতন আটকে আছে। যখন কাজ করতেন, তখন সমিতির বেতনের বাইরে মার্কেটের বিভিন্ন দোকানের মালিকদের কাছ থেকে কিছু টাকা পেতেন কাজের বিনিময়ে। তা–ই দিয়েই টেনেটুনে সংসার চালিয়ে নিতেন।
কিন্তু মার্কেট বন্ধ হওয়ার পর থমকে গেছে হিরুণ নেছার জীবন। মার্কেটের পেছনেই একটা খুপরিতে থাকেন তিনি। বেতন না পাওয়ায় এখন দিন চালানো দায় তাঁর। চোখে কম দেখেন, পায়ে ব্যথা। শরীরে বাসা বেঁধেছে আরও নানান রোগ। চিকিৎসা করাবেন বা ওষুধ কিনবেন? কীভাবে? দুবেলা দুমুঠো ভাতই জোটে না, আবার ওষুধ কেনার টাকা। যদি মার্কেট খোলে, এ আশায় প্রতিদিন মার্কেটের সামনে এসে ঘোরাঘুরি করেন। রাস্তা দিয়ে বহু মানুষ যাওয়া–আসা করে। হরদম ছুটে চলে গাড়ি। কিন্তু হিরুণ নেছার পানে কেহ চাহে না। জোটে না তাঁর দুমুঠো অন্নের অল্প কিছু টাকা।
হিরুণ নেছার বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। ঢাকায় এসেছেন ২৫ বছর আগে। স্বামী মারা গেছেন এক যুগ হয়ে গেছে। এক মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন মুন্সিগঞ্জে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। তাই মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাতেন মেয়ের সংসারে। গত দুই মাসে কানাকড়িও দিতে পারেননি। টাকার সংকটে মেয়ের সঙ্গে দেখাও করতে যেতে পারছেন না। কথায় কথায় হিরুণ নেছা বলেন, ‘একমাত্র মেয়ে আমার। তাঁরে দেখার জন্য মন হু হু করে। কিন্তু এ সময় কেমনে যাব, কী নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াব? মেয়ে যে কয়েক দিন বসিয়ে খাওয়াবে, সে অবস্থাও তাঁর নেই।’ তাই মায়ের মন নীরবে কাঁদে।
মুখে মাস্ক নেই, করোনার ভয় করে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে হিরুণ নেছা বলেন, ‘মরে গেলেই বাঁচি। বেঁচে থেকে কী লাভ? জীবনে সুখ জিনিসটা দেখে যেতে পারলাম না। করোনা ভয় করি না।’ ‘চলেন কেমনে?’ জানতে চাইলে বলেন, ‘কারও কাছ থেকে যদি কিছু পাই, তা দিয়েই চলে। তিন বেলা খাওয়া হয় না।’ সরকারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহযোগিতা মেলেনি। এমনকি দেড় বছরে এক ছটাক ত্রাণও না। তাই এ প্রতিবেদকের কাছে জানতে চাইলেন, কবে করোনা থামবে? কবে মার্কেট খুলবে? কবে আবার ঝাড়ু দেওয়া শুরু করতে পারবেন? সেই অপেক্ষায় এখন হিরুণ নেছা।