স্বস্তির বার্তা প্রবাসী আয়ে, কমেছে আমদানি ঋণপত্র

চলমান এ সংকটের মধ্যে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি ও আমদানি ঋণপত্র কমার খবরে ডলারের বাজারে চাপ কিছুটা কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আমদানি খরচ বাড়ায় অর্থনীতিতে যে চাপ তৈরি হয়েছে, তাতে কিছুটা হলেও স্বস্তি এসেছে। আমদানি ঋণপত্র খোলার হার গত জুলাই মাসে প্রায় ৩১ শতাংশ কমে গেছে। আবার ডলার সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মাধ্যম প্রবাসী আয়ও গত মাসে বেশ বেড়েছে। গত ১৩ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় এসেছে জুলাইয়ে। ফলে অর্থনীতির চাপের মধ্যে এই দুই সূচক কিছুটা আশা জাগাচ্ছে। যদিও গত অর্থবছরে রেকর্ড আমদানি খরচ হয়েছে। এতে নতুন রেকর্ড হয়েছে লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতিতেও।

ডলার আয় ও খরচের মধ্যে ব্যবধান বড় হওয়ায় গত কয়েক মাসে ডলারের দাম বেশ বেড়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ডলারের আন্তব্যাংক দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। তবে ব্যাংকগুলো ১০৪-১০৫ টাকা দরে আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাই মাসে ঈদের কারণে বেশ কয়েক দিন ব্যাংক বন্ধ ছিল। এ কারণে আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে। আবার ঈদের কারণে বেশি আয় এসেছে। এ ছাড়া গত মাসে হজের কারণেও দেশের বাইরে থেকে ছেলেমেয়েরা মা–বাবার জন্য ডলার পাঠিয়েছেন। তাই আপাতত এই দুই সূচকে কিছুটা স্বস্তি মিলছে। তবে প্রকৃত স্বস্তি মিলবে আগস্টের তথ্য হাতে পাওয়ার পর।’

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘এখন সময় এসেছে ডলারের দাম ১০৪-১০৫ টাকার মধ্যে আটকে ফেলার। এর বেশি বাড়তে দেওয়া আর ঠিক হবে না। আর ডলারের দাম যেন না বাড়ে, সে জন্য ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমাও তুলে দিতে হবে। এতে টাকার দাম বাড়বে, ডলারের চাহিদাও কমে আসবে। এখন সুদহার কম হওয়ায় রপ্তানিকারকেরা ডলার ধরে রাখছে, আবার আমদানিকারকেরা আগেই টাকা দিয়ে ডলার বুকিং করে রাখছে।’

আমদানি ঋণপত্র কমেছে

ডলার-সংকটের কারণে অনেক পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করেছে সরকার। এর ফলে চলতি বছরের জুনের তুলনায় জুলাই মাসে আমদানি ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ৩১ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৫৪৭ কোটি ডলারের, যা জুন মাসের তুলনায় ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ কম। জুন মাসে আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৭৯৬ কোটি ডলারের। তবে জুন মাসে অবশ্য মে মাসের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র ৭ শতাংশ বেশি ছিল।

বেড়েছে প্রবাসী আয়

প্রণোদনা ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির পরও ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে বড় পতন হয়। বিদায়ী অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ পথে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার দেশে পাঠান, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে আয় এসেছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে গত জুনে আসে ১৮৩ কোটি ৭২ লাখ ডলার।

তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রবাসী আয় এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে প্রবাসী আয় এসেছে ২০৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ গত বছরের মে মাসে সর্বোচ্চ ২১৭ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোরবানির ঈদের কারণে গত মাসে প্রবাসী আয় বেশি এসেছে। আবার ব্যাংকও এখন প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রে ডলারের ভালো দাম দিচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকে ডলার সরবরাহ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবাসী আয় বৃদ্ধি ও আমদানি কমায় কিছুটা স্বস্তি এসেছে। বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে অর্থনীতিতে যে চাপ তৈরি হয়েছে, আশা করছি তা কমে আসবে।’

লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতিতে রেকর্ড

জ্বালানি তেল ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে সার্বিকভাবে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের ওপর চাপ পড়েছে। আবার রপ্তানি বাড়লেও তা আমদানির মতো নয়। প্রবাসী আয়ও চাহিদা অনুযায়ী বাড়েনি। ফলে দেশে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। এতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহৃত প্রধান এ মুদ্রার দাম। সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকালও বিক্রি করেছে ৫ কোটি ডলার। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে হয়েছে ৩ হাজার ৯৪৮ কোটি ডলার।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানিতে খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৯১৬ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্ধবছরে যা ছিল ৬ হাজার ৫৫৯ কোটি ডলার। ফলে গত অর্থবছরে আমদানি খরচ বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। এতে গত অর্থবছর শেষে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৩২৫ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে যা ছিল ২ হাজার ৩৩৭ কোটি ডলার।

ডলারের ওপর চাপ কমাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক ২৭টি পণ্য আমদানিতে ব্যাংকঋণ বন্ধ করে দিয়েছে।