আবাসন খাতে সুদিন, আছে দুই চ্যালেঞ্জ
এক বছরের বেশি সময় ধরে ফ্ল্যাটের ব্যবসা চাঙা। চাহিদা বেশি থাকায় আবাসন প্রতিষ্ঠানের হাতে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা ফ্ল্যাট প্রায় নেই বললেই চলে। সুযোগ-সুবিধা ভালো এমন এলাকার প্রকল্পের ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য ছাড়লেই দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তাই নিত্যনতুন প্রকল্পও নিয়ে আসছে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ, নিবন্ধন ব্যয় হ্রাস, সরকারি কর্মকর্তাদের ৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ প্রদান ফ্ল্যাটের বাজার চাঙা করতে ইতিবাচক প্রভাব রাখছে।
অবশ্য সাধারণ মানুষের জন্য সুখবর নেই। উচ্চমূল্যের কারণে অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে ফ্ল্যাটের দাম। তবে নতুন করে দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য। তাতে নতুন করে ফ্ল্যাটের দাম আরও বেড়েছে। আবার ভীতি ছড়াচ্ছে ২০১৬-৩৫ সালের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রস্তাবিত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রস্তাবিত ড্যাপ বাস্তবায়িত হলে ফ্ল্যাটের দাম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটি এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবর্তন ছাড়া প্রস্তাবিত ড্যাপ বাস্তবায়িত হলে উচ্চবিত্তের নিচে কেউ হয়তো ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন না। সেটি হলে পুরো খাতটি হুমকির মুখে পড়বে।
জানতে চাইলে আবাসন প্রতিষ্ঠান বিল্ডিং ফর ফিউচারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীরুল হক বলেন, ‘বর্তমানে এ খাতের ব্যবসা ভালো। চাহিদা থাকায় আমরাও নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। তবে নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে ফ্ল্যাট নির্মাণের ব্যয় বেড়েছে। প্রস্তাবিত ড্যাপের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। ড্যাপে যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো অপরিবর্তিত থাকলে তাতে ফ্ল্যাটের দাম দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে।’
স্বল্প জায়গায় কীভাবে বেশি মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, সেই চিন্তা থেকেই আবাসন ব্যবসার গোড়াপত্তন হয়েছে। শুরু করেছিলেন ইস্টার্ন হাউজিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম। তাঁর দেখানো পথ ধরেই ধীরে ধীরে অন্যরা আবাসন ব্যবসায় যুক্ত হন। বর্তমানে রিহ্যাবের সদস্যসংখ্যা ৯২৫। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে গড়ে ১২-১৫ হাজার ফ্ল্যাট ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর করছে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান সময়মতো ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেওয়ায় খাতটির প্রতি আস্থাও হারিয়েছেন অনেক ক্রেতা। রিহ্যাবের নানা পদক্ষেপের কারণে ফ্ল্যাট না পাওয়ার হার কিছুটা কমেছে।
২০১২ সালে আবাসন খাতে মন্দা শুরু হয়। পরের বছর টানা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেটি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সে সময় ফ্ল্যাটের মূল্য কমিয়েও ক্রেতা খুঁজে পায়নি অনেক প্রতিষ্ঠান। কিস্তি দিতে না পারায় অনেক ফ্ল্যাটের ক্রেতার বুকিংও বাতিল হয়। সেই অস্থির সময় পার করে ২০১৬ সালের দিকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সংকট পুরোপুরি কাটেনি। তবে ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে সরকারি কর্মচারীদের ৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ দেওয়ার ঘোষণা আসে। তারপর ধীরে ধীরে ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। করোনার ধাক্কায় গত বছরের শুরুর দিকে আবার সংকটে পড়ে আবাসন খাত। এরপর করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে জুলাই–আগস্টের দিকে ব্যবসা বাড়তে শুরু করে।
একাধিক আবাসন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে ঢাকায় ১ কোটি টাকার কমবেশি মূল্যের ১ হাজার ২০০ বর্গফুট থেকে শুরু করে ১ হাজার ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসক, সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারাই ফ্ল্যাটের মূল ক্রেতা।
সামনে দুই চ্যালেঞ্জ
ব্যবসার এ সুদিনের মধ্যেও দুটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আবাসন খাত। এক. রড-সিমেন্টসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর দাম ঊর্ধ্বমুখী। এক বছরের ব্যবধানে শুধু রডের দামই বেড়েছে ২৮ শতাংশ। দুই. রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ২০১৬-৩৫ সালের জন্য ড্যাপ প্রণয়ন করছে। সেটির আলোকে ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০২১ হচ্ছে। সেই খসড়া বাস্তবায়ন করা হলে ভবনের আয়তন বর্তমানে যা অনুমোদিত হচ্ছে, তার চেয়ে ৩৩-৫৩ শতাংশ আয়তন হ্রাস পাবে।
নির্মাণকাজের ভরা মৌসুমে রডের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বিশ্ববাজারে রডের কাঁচামালের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদকেরাও সমানতালে দাম বাড়াচ্ছেন। বর্তমানে প্রতি টন রড বিক্রি হচ্ছে ৭৫ হাজার থেকে ৭৮ হাজার ৫০০ টাকায়। গত বছর দাম ছিল ৫৮ হাজার থেকে ৬১ হাজার ৫০০ টাকা। অন্যদিকে গত মার্চে সিমেন্টের দাম বস্তাপ্রতি ৩০ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ৪০০-৪৫০ টাকা। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় আবাসন ব্যবসায়ীরাও ফ্ল্যাটের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে দাম বাড়িয়েও দিয়েছে।
এদিকে রাজধানীতে এখন ভবন নির্মাণ করা হয় ২০১০ সালের ড্যাপ ও ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে। ২০০৮ সালে করা এই বিধিমালায় জমির আয়তন অনুযায়ী কত তলা বা উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যাবে, তা উল্লেখ আছে। এ বিধিমালার কারণে বেশি উচ্চতার আবাসিক ভবন নির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, ১৯৯৬ সালের বিধিমালায় ধানমন্ডিতে যে জমিতে ৬ তলা ভবন নির্মাণ করা যেত, ২০০৮ সালের বিধিমালায় সেই জমিতে ১৪ তলা ভবন হচ্ছে।
অবশ্য নতুন খসড়া ড্যাপে প্রস্তাব করা হয়েছে, গণপরিসর বা সাধারণ মানুষের জন্য জায়গা না ছাড়লে ব্যক্তি পর্যায়ে ধানমন্ডিতে ৮ তলার ওপর আর ভবন নির্মাণ করা যাবে না। নতুন ড্যাপে আবাসিক ভবনের উচ্চতাসংক্রান্ত প্রস্তাবটি শুধু ধানমন্ডি নয়, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ঢাকা শহরের সব এলাকার জন্য প্রযোজ্য হবে। আর রাজউকের আওতাধীন নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন এবং সাভার পৌর এলাকায় আবাসিক ভবন হবে সর্বোচ্চ ৬ তলা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভবনের আয়তন হ্রাস পেলে জমির মালিক কিংবা আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পিত বা চাহিদা অনুযায়ী ফ্ল্যাট পাবে না। ফ্ল্যাটের সংখ্যা কমে যাবে। কিন্তু জমির দাম কমবে না। তাতে ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে রিহ্যাবের সহসভাপতি মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ সময়ের চেয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিক্রি ১৫-২০ শতাংশ বেড়েছে। অবশ্য সামনের দিকে ফ্ল্যাটের দাম কিংবা আবাসন খাতের ব্যবসার গতিপ্রকৃতি নির্ভর করছে প্রস্তাবিত ড্যাপের ওপর। যদিও রাজউক থেকে কিছুটা সংশোধনের আশ্বাস মিলেছে, তবে সেটি যথেষ্ট নয়।