আবাসন নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা দরকার
করোনাকালেও আবাসন খাতের ব্যবসা চাঙা। তবে নির্মাণসামগ্রীর মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। ফলে ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে। প্রস্তাবিত ড্যাপ নিয়েও ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হচ্ছে। অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। আগামী বছরে মেট্রোরেলও চালু হবে। এমন প্রেক্ষাপটে সবার জন্য আবাসন নিশ্চিতে কী করা দরকার?
আলমগীর শামসুল আলামিন: দেশে বড় ধরনের রূপান্তর হচ্ছে। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যুক্ত হতে যাচ্ছি। সে ক্ষেত্রে যে বড় পরিবর্তন হবে, তার সঙ্গ তাল মিলিয়ে আবাসন খাতেও বদলের প্রয়োজন আছে। ফুটপাতে মানুষ রেখে উন্নয়নশীল দেশ হওয়া যাবে না। আবাসন সমস্যাটা শুধু সরকারের সমস্যা নয়, এটা সবার সমস্যা। এই সমস্যা মোকাবিলায় সরকার ও বেসরকারি খাতকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। এককভাবে সরকার বা বেসরকারি খাত এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। সরকার আমাদের ব্যবসা করিয়ে দেবে না। তবে সরকারের কাছ থেকে আমরা বেসরকারি খাত ব্যবসাবান্ধব নীতি চাই। সরকারি সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নতুন ড্যাপে (ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান) যেসব প্রস্তাব রাখা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবসম্মত কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। ড্যাপ প্রণয়নকারী কমিটি যেসব অবকাঠামোর কথা বলেছে, সেগুলো কবে বাস্তবায়িত হবে, সেটি নিয়ে আমাদের প্রশ্ন রয়েছে। প্রস্তাবিত ড্যাপে রাস্তাঘাট, পানি শোধনাগার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য অবকাঠামো না করেই আমাদের ওপর নানা শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? আমাদের বলা হচ্ছে, শহরের বাইরে আবাসন প্রকল্প করেন। শহরের বাইরে যাব কোথায়? যেখানে স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্যসেবা নেই, সেখানে যাব? একটা মেগাসিটিতে মানুষ কেন আসে? দুনিয়ার সব জায়গার চিত্র কিন্তু একই রকম। মেগাসিটিতে সাধারণ মানুষ কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্যই আসে। এসব সুযোগ-সুবিধা অন্য শহরে ব্যবস্থা করলে মানুষ ঢাকায় ঢুকবে না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনি প্রস্তাবিত ড্যাপের ত্রুটির কথা বললেন। নির্মাণসামগ্রীর দামও ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। ভবিষ্যতে ফ্ল্যাটের দাম কেমন বাড়তে পারে?
আলমগীর শামসুল আলামিন: প্রস্তাবিত নতুন ড্যাপ ঢাকায় জমির দাম আরেক দফা বাড়াবে। পাল্লা দিয়ে বাড়বে ফ্ল্যাটের দামও। অনেক ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। মানুষের ফ্ল্যাট কেনার চাহিদা থাকলেও তা তাঁদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে না। যেভাবে দাম বাড়বে, তাতে প্রথম দিকে আমাদের মনে হয়েছিল, উচ্চবিত্তরাই কেবল ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন। তবে বিচার-বিশ্লেষণ করে আমরা দেখছি, আগামী দিনে গুলশানে প্রতি বর্গফুটের দাম বেড়ে হবে ৪০-৪২ হাজার টাকা, যা বর্তমানে ১৮-২০ হাজার টাকা। তার মানে ফ্ল্যাটের দাম উচ্চবিত্তদেরও নাগালের বাইরে চলে যাবে। ফলে বাজারটা ছোট হয়ে আসবে। সুপার রিচ, অর্থাৎ ধনীদের মধ্যে সেরা ধনীরাই কেবল ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন। ফ্ল্যাটের দাম উচ্চমধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে, মধ্যবিত্তের কেনার তো তো প্রশ্নই ওঠে না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: তাহলে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের কী হবে?
আলমগীর শামসুল আলামিন: সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন দিতে হলে সরকারকে একটি মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা করতে হবে। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশ নিয়েই মহাপরিকল্পনাটি করতে হবে। আমাদের জমির পরিমাণ তো আর বাড়বে না। সে জন্য খুব পরিকল্পনা করে জমি ব্যবহার করতে হবে। প্রস্তাবিত ড্যাপে ভবনের উচ্চতা কমিয়ে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে। এখন আমরা যদি ওপরের দিকে (বহুতল ভবন নির্মাণ) না যাই, তাহলে কৃষি ও শিল্পের জমি আমাদের বাসস্থানের জন্য ব্যবহার করতে হবে, যা দেশে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। জনগণকে সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসনসুবিধা দিতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এটি বেসরকারি খাতকে দিয়ে সম্ভব নয়। এখানে বেসরকারি খাত যেটি করতে পারে সেটি হলো, সরকার জমি দিলে ভবন নির্মাণ করে দেওয়া সে ক্ষেত্রে দাম বেঁধে দেওয়া থাকবে। সেই দামেই ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হবে। এ জন্য সরকারকেই জমি দিতে হবে। বাজারমূল্যে জমি কিনে সাশ্রয়ী মূল্যে দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মিরপুরের আশপাশে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের প্রচুর জমি আছে। সেখানে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকার যৌথভাবে আবাসন প্রকল্প করতে পারে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: করোনাকালে ব্যবসা কেমন হচ্ছে?
আলমগীর শামসুল আলামিন: করোনার মধ্যে আমরা ভালো ব্যবসা করেছি। এ ক্ষেত্রে সরকারের কিছু পদক্ষেপ ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। যেমন রেজিস্ট্রেশন খরচ হ্রাস, এক অঙ্কের সুদে গৃহঋণ বিতরণ ও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ। সরকার এসব সুযোগ দেওয়ার ফলে আবাসন খাতটি চাঙা ছিল। আমাদের কারোর কাছেই আর রেডি ফ্ল্যাট নেই। আমাদের সংগঠন থেকে কোম্পানিমালিকদের অনুরোধ করেছিলাম, নির্মাণাধীন প্রকল্পের কাজ আগে শেষ করুন। এ কারণে গত দুই বছরে নতুন প্রকল্প তুলনামূলক কম এসেছে। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম রয়েছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সরবরাহ কম থাকলে মেলায় সাড়া কেমন মিলবে?
আলমগীর শামসুল আলামিন: মেলায় ফ্ল্যাটের সরবরাহ কিছুটা কম থাকবে। মেলা কিন্তু বিক্রির জায়গা নয়। এটা একটা মিলনমেলা। ক্রেতা-বিক্রেতারা মেলায় শুধু যে নতুন ফ্ল্যাটের খোঁজ নেন তা নয়, নতুন নির্মাণসামগ্রী ও ফিটিংসের প্রদর্শনীও হয়। অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো ফ্ল্যাটের মালিকেরাও নিজেদের ফ্ল্যাটের সংস্কারের জন্য সেসব পণ্য দেখতে আসেন। যেহেতু গত বছর মেলা হয়নি, তাই আশা করছি, এবারের মেলায় অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো সাড়া পাবে। চট্টগ্রামে আমাদের মেলায় প্রচুর ক্রেতা-দর্শনার্থী এসেছিলেন।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: ফ্ল্যাট কিনেও নানা সময়ে ক্রেতারা প্রতারিত হয়েছেন। আপনাদের কাছেও তাঁরা প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেছেন। বর্তমানে কী অবস্থা?
আলমগীর শামসুল আলামিন: ক্রেতাদের অভিযোগ কমেছে। কারণ, আমরা কঠোর নজরদারি করছি। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের ডেকে ডেকে আমরা মোটিভেট করি। তাঁদের আমরা বোঝাই, এভাবে ব্যবসা করলে টিকে থাকা যাবে না। আমি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে রিহ্যাবে ক্রেতাদের অভিযোগের সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ হাজার। বর্তমানে সেটি কয়েক শতে নেমে এসেছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সরকারি কর্মকর্তারা ৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ পাচ্ছেন। এ জন্য আবাসন খাতে কি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে?
আলমগীর শামসুল আলামিন: কর্মকর্তাদের ৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ দেওয়ার নীতিমালা করেছে সরকার। তবে সরকারি তহবিল থেকে ঋণ নিতে গেলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অনেক ধরনের কাগজপত্র চায়। ঋণগ্রহীতারা সব কাগজপত্র জোগাড় করতে না পারায় ঋণও ছাড় হচ্ছে না। বিষয়টি সহজ করা দরকার।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সরকার তো একইভাবে সাধারণ মানুষের জন্যও গৃহঋণের ব্যবস্থা করতে পারে...
আলমগীর শামসুল আলামিন: সাধারণ মানুষের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বল্প সুদে পুনঃ অর্থায়ন তহবিল ছিল। কেন সেটি বন্ধ হলো, আমাদের বোধগম্য নয়। হয়তো কারও স্বার্থে আঘাত লেগেছে বলেই সেটি বন্ধ হয়েছে। আবার দীর্ঘদিন দাবি করেও আমরা এমন কোনো তহবিলের ব্যবস্থা করতে পারিনি। কিন্তু বাসস্থান কোনো বিলাসী পণ্য নয়। এটি মানুষের মৌলিক অধিকার।