উন্নত প্রযুক্তিতে দেশেই উন্নত স্বাস্থ্যসেবা

নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও একঝাঁক এসএমই উদ্যোক্তা আমাদের প্রতিনিয়ত চমৎকৃত করে চলেছেন। তাঁদের কেউ কেউ চোখের সামনে কারখানা আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরও ভেঙে পড়েন না, কেউ কেউ মিথ্যা অপবাদে নিঃস্ব হলেও ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠেন, কেউ কেউ সোনালি আঁশের নবজাগরণের জন্য কাজ করেন। এ রকম সাধারণের মাঝে অসাধারণ ছয়জন স্বপ্নজয়ী উদ্যোক্তাকে দেওয়া হয়েছে ‘আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১’।

স্বাস্থ্যে আইডিএলসি–প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১ পেয়েছেন বাইবিট লিমিটেডের সভাপতি অধ্যাপক ড. খোন্দকার সিদ্দিক–ই–রব্বানী
প্রথম আলো

যুক্তরাজ্যে পিএইচডি গবেষণার সময় ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী বুঝতে পারেন, দেশের মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে যথাযথ প্রযুক্তি দরকার। আর সে কাজের জন্য দেশেই ফিরতে হবে। তাই বিদেশে চাকরি না করে দেশে ফিরে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে, ১৯৭৮ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি শুরু করেন গবেষণার কাজ। উদ্দেশ্য একটাই—প্রযুক্তি দিয়ে বাংলাদেশের গণমানুষের জীবনমান উন্নত করা।

১৯৮৮ সালে বানালেন দেশের প্রথম কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক-ভিত্তিক ইএমজি-নার্ভ কন্ডাকশন ডিভাইস, স্নায়বিক রোগ নির্ণয়ের একটি জরুরি মেডিকেল যন্ত্র। নিজ হাতে যন্ত্র তৈরিতে ড. রব্বানীর আগ্রহ দেখে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা তাঁকে এর জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনে বিশেষ সহায়তা করেন। ড. রব্বানী ইলেকট্রনিকসের আরও কিছু সামগ্রী তৈরি করছেন, যা দেশের মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিয়ে জীবনমানের উন্নত করতে পারে। ১৯৯১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত এসব সামগ্রী তৈরি ও তার বাণিজ্যিক বিতরণের উদ্যোগ নিয়ে সফলও হন। ২০০২ সাল থেকে সেই উদ্যোগ থেকে সরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো ও ১৯৭৮ থেকে করে আসা স্বাস্থ্যসেবায় পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিকসের ব্যবহার নিয়ে গবেষণায় আরও মনোযোগী হন। এ বিষয়ে তাঁর দুটি উদ্ভাবন আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিতি লাভ করে, কিন্তু পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষের বঞ্চনায় পেটেন্টের অবদান আছে ভেবে তিনি কোনো পেটেন্ট নেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বায়োমেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি’ বিভাগ। শিক্ষার্থীদের মধ্য একদল উদ্যমী তরুণ গবেষক তাঁর দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন গবেষণার ফলাফলকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ২০১১ সাল থেকে এগিয়ে আসে সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়। তখন থেকে তারা গবেষণায় সহায়তা করে যাচ্ছে, যার কারণে এসব ত্যাগী তরুণকে কিছু ভাতা দেওয়াও সম্ভব হয়।

অতিথিদের সঙ্গে আইডিএলসি–প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১ প্রাপ্ত বিজয়ীরা। গত মঙ্গরবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে
ছবি: প্রথম আলো

উদ্যোগী তরুণদের সঙ্গে নিয়ে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাইবিট লিমিটেড, বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় নিজেদের উদ্ভাবিত ও পরিমার্জিত স্বাস্থ্যসহায়ক যন্ত্রপাতিকে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি ও বিতরণের উদ্দেশ্যে। এটিও করেন ব্যতিক্রমী একটি ধারায়—বাইবিটের কোনো মালিক নেই, কেউ এর মুনাফা নিতে পারবে না। ফলে ব্যাংক থেকে মূলধন পাওয়ার কোনো উপায় থাকল না, কিন্তু নিজেদের প্রযুক্তির ওপর বিশ্বাস রেখে তাঁরা এগিয়ে যান। বাইবিট এরই মধ্যে অধ্যাপক রব্বানী ও তাঁর সহযোগী গবেষকদের উদ্ভাবিত ১৫টির মতো যন্ত্র বাজারজাত করেছে, যার সব কটি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত।

হাসপাতালে করোনার রোগীদের থেকে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের যেন সংক্রমণ না হয়, সে জন্য বানিয়েছেন নেগেটিভ প্রেশার আইসোলেশন ক্যানোপি। আবার বাইরের সংক্রমণ থেকে বার্ন ইউনিটের পোড়া রোগীকে নিরাপদ রাখার জন্য তৈরি করেন পজিটিভ প্রেশার আইসোলেশন ক্যানোপি, যেটি পৃথিবীতে প্রথম। এই কদিন আগেও ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, এ ধরনের ক্যানোপি ব্যবহার করলে তা হতো না।

বাইবিট বানিয়েছে ইলেকট্রো হেলথ নামের একটি যন্ত্র। এটি পালসড ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড (পিইএমএফ) প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং কোমর, ঘাড় ও হাঁটুর ব্যথায় নিরাময় দিতে পারে। ১৯৭৮ দুজন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানীর সঙ্গে মিলে পিইএমএফ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অধ্যাপক রব্বানী হাড় জোড়া দেওয়ার একটি পদ্ধতির ওপর গবেষণা করে সফল হন। সেটির পরিবর্তিত রূপই হলো এই ইলেকট্রো হেলথ যন্ত্র। এটি রোগীর শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে রক্ত চলাচল বাড়াতে সাহায্য করে, তাতে ব্যথা নিরাময়ে শরীরের নিজস্ব ব্যবস্থাগুলো উদ্দীপ্ত হয়।

রয়েছে হাত-পায়ের অতিরিক্ত ঘাম থেকে মুক্তির বৈদ্যুতিক আইন্টোফোরেসিস যন্ত্র—‘অ্যান্টিসোয়েট’। আরও আছে পায়ের তলার চাপের পরিমাণের বিশদ ছবি তৈরি করার কম্পিউটারভিত্তিক পেডোগ্রাফ যন্ত্র, যার ভিত্তিতে বিশেষ জুতো তৈরি করে ডায়াবেটিস রোগীদের পা কাটা থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে বাইবিটের তৈরি পেডোগ্রাফ যন্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। আর আছে ডিজিটাল ইসিজি যন্ত্র। একটি কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত করে এটি ব্যবহার করে ১২ লিডের ইসিজি করা যায়, এমনকি তাৎক্ষণিকভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূরে যেকোনো চিকিৎসকের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া যায়। বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা গবেষণাগারের জন্যও যন্ত্র তৈরি করে দিয়েছে বাইবিট।

অধ্যাপক সিদ্দিক-ই-রব্বানীর ধারণা, বাইবিট তাদের উৎপাদন বাড়িয়ে গবেষণার খরচ জোগানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে। সে জন্য পণ্যের বাজারজাতকরণে আরও মনোনিবেশ করতে চান।

মুক্ত দর্শনের অধিকারী এই বিজ্ঞানী মনে করেন, সারা বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ প্রযুক্তির অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাইবিট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা মিলে যে স্বাস্থ্যপ্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বাণিজ্যিকীকরণের মডেল স্থাপন করেছে, তা তৃতীয় বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া বাইবিটের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। ড. রব্বানীর আশা, এ প্রচেষ্টায় উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানীরাও যুক্ত হবেন।

আরও পড়ুন