কিষানি রাজিয়ার হাত ধরে হোক হাজারো কিষানির নবযাত্রা

নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও একঝাঁক এসএমই উদ্যোক্তা আমাদের প্রতিনিয়ত চমৎকৃত করে চলেছেন। তাঁদের কেউ কেউ চোখের সামনে কারখানা আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরও ভেঙে পড়েন না, কেউ কেউ মিথ্যা অপবাদে নিঃস্ব হলেও ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠেন, কেউ কেউ সোনালি আঁশের নবজাগরণের জন্য কাজ করেন। এ রকম সাধারণের মাঝে অসাধারণ ছয়জন স্বপ্নজয়ী উদ্যোক্তাকে দেওয়া হয়েছে ‘আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১’। তাঁদের মধ্যে কৃষিতে পুরস্কার পেয়েছেন রাইয়ান অ্যাগ্রো লিংকের এমডি রাজিয়া সুলতানা

কৃষিতে আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১ বিজয়ী রাইয়ান অ্যাগ্রো লিংকের এমডি রাজিয়া সুলতানা
প্রথম আলো

প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর শুরু হয় রাজিয়া সুলতানার নতুন দিনের চ্যালেঞ্জ। শনি ও রোববার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে নিজের উৎপাদিত পণ্যের পসরা নিয়ে বসা, অন্য দিন বাগান থেকে ফুল নিয়ে আগারগাঁও ফুলের বাজারে হাজির হওয়া। গ্রীষ্ম, বর্ষা কিংবা শীত কোনো কোনো ঋতুতেই তার ব্যত্যয় ঘটে না। বেচাকেনা শেষে রাজিয়া যখন তাঁর আশুলিয়া বা হেমায়েতপুরের খামারে ফিরে যান তখন হয়তো অনেকের দিনও শুরু হয় না।

চাল ও কাপড়ের ব্যবসায়ী আবদুস সামাদ ও গৃহিণী মরিয়ম আক্তারের সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে ষষ্ঠ রাজিয়া। ছয় বছর বয়সে ঢাকার দক্ষিণখানে চলে আসেন। সেখানে বাবাকে দেখছেন শীতকালে সবজির চাষাবাদ করতে। বাবা বাড়ির পাশের উন্মুক্ত যে জায়গাটিতে সবজির চাষ করতেন সে সব সবজি আশপাশের লোকদেরও দিতেন। সে সময় সেখানে ধানি জমিও ছিল অনেক। এসব দেখে রাজিয়ার মনেও কৃষক হওয়ার সাধ জাগে। নিজেই একটা কিছু করার শখও তখন থেকে।

আইডিএলসি প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১-প্রাপ্ত বিজয়ীরা অতিথিদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেয়। (বা থেকে বসা) পুরস্কারপ্রাপ্ত মো. ওলি উল্লাহ, রেহানা আক্তার, খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী, রাজিয়া সুলতানা, মো. মনির হোসেন ও কামরুন্নাহার খানম। (বাঁ থেকে দাঁড়িয়ে) মো. জাকের হোসেন, মির্জা নূরুল গণী শোভন, এম এ মান্নান, এম জামাল উদ্দিন, মুহম্মদ গাজী তৌহীদুর রহমান ও মতিউর রহমান। গত মঙ্গলবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে
প্রথম আলো

স্বামী পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে গেলে কিছু করার তাড়না থেকে শুরু করেন একটি বুটিকের দোকান। কিন্তু সন্তানের জন্মের সময় দোকানের দেখভাল করতে না পারায় লোকসান হয়ে যায় অনেক। বন্ধ করার সময় দোকানের এক কর্মচারীর পরামর্শে হাঁসের খামারে মনোযোগী হন। খামার গড়ে তোলেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে ৪০০ খাকি ক্যাম্বেল হাঁস দিয়ে শুরু হয়েছে উদ্যোক্তা জীবনের পথচলা। ছোটবেলা থেকে টিভিতে কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান দেখতেন। নিজে উদ্যোগী হওয়ার পর ইউটিউব ও অন্যান্য মাধ্যমেও কৃষিবিষয়ক কর্মকাণ্ড মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করেন। এমনকি আশপাশে কোনো কৃষিখামারের কথা জানতে পারলে সেখানে চলে যেতেন কাজ বোঝার জন্য।

হালুয়াঘাটের সেই খামারের পাশের পতিত জমিতে শুরু করেন বিদেশি সবজির চাষ। ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, লেটুস, চেরি, টমেটো, ফ্রেঞ্চ বিন (রাজমা), রেড ক্যাবেজ (লাল বাঁধাকপি), চীনা ক্যাবেজ, স্কোয়াশ। প্রথম বছরেই বড় অঙ্কের লাভের মুখ দেখেন। রাজিয়া জানান, পাঁচ বিঘা জমিতে ৮০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে আয় হয় আড়াই লাখ টাকার মতো। ঢাকা থেকেই হালুয়াঘাটের খামার চালাতেন।

স্বামী দেশে ফিরে এলে স্বামীর কর্মস্থলে সিলেটে চলে যান। সেখানে বছরের অধিকাংশ সময় জমি পতিত থাকে। এসব চিন্তা থেকে রাজিয়া হালুয়াঘাট থেকে খামার সিলেটে নিয়ে আসেন। কিন্তু এক বছরের মাথায় স্বামী আবার বদলি হয়ে আসেন ঢাকায়। আবারও খামার সরিয়ে আনতে হয়। এবার ঢাকার আশুলিয়ায় ১৮ বিঘা জমি নিয়ে নতুন করে শুরু করেন। এখন এই আশুলিয়ার খামারসহ, মানিকগঞ্জ ও হালুয়াঘাটে তাঁর রয়েছে তিনটি খামার।

সবজির দামের ওঠানামা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেড় বছর ধরে শুরু করেছেন ‘ডাচ রোজ (গোলাপ)’ ফুলের চাষ। পাশাপাশি তিনি এখানে গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প এবং ছাগলের খামারও গড়ে তুলেছেন। গোলাপের চারা উৎপাদন ছাড়াও চায়না গোলাপ, ডাচ রোজ, চন্দ্রমল্লিকা, এস্টার জিপসি চাষ করছেন।

কৃষিতে বাংলাদেশের নারীদের গৌরবময় ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও আধুনিক কৃষিতে তাঁদের অংশগ্রহণ খুবই নগণ্য। কৃষি উদ্যোক্তার সংখ্যাও আশানুরূপ নয়। রাজিয়া সুলতানা এসব নিয়ে ভাবেন। তারপর ভাবলেন তথ্য আর প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্যকেও এগিয়ে নেওয়া যায়।

তাই ব্যবসার পাশাপাশি ‘এগ্রিকালচার ই-কমার্স রেভুলেশন বিডি’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। এ গ্রুপের মাধ্যমেই ভালো মানের চারাগাছ, কীটনাশক, সার ইত্যাদি সরবরাহের একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও গড়ে উঠেছে। ওই গ্রুপে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ লাখ সদস্য রয়েছে। যার মধ্যে ১৪ হাজারের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি।

তাঁর ধারণা আধুনিক কৃষি বিষয়ে আগ্রহী শিক্ষার্থীসহ গ্রামীণ নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে পারলে কৃষিতে আরও অগ্রগতি সম্ভব হবে।

রাজিয়া সুলতানা এর আগে ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক ২০১৮, ২০১৯ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সেরা নারী কৃষক পুরস্কার লাভ করেছেন।

আরও পড়ুন