চামড়া নিয়ে সবার এখন মাথাব্যথা

এখনো কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার প্রস্তুত নয়। ডাম্পিং ইয়ার্ডের কাজ শুরুই হয়নি। বেশ কিছু রাস্তা ব্যবহারের অনুপযোগী।

ঈদুল আজহা এসে গেছে। তাই আবার আলোচনায় সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগর। কিন্তু চামড়াশিল্প নগর কাঁচা চামড়া সংগ্রহে কতটা প্রস্তুত? গত বুধবার সরেজমিন ঘুরে সেখানে কাউকেই কিন্তু স্বস্তিতে দেখা গেল না। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), কারখানার মালিক, শ্রমিক, আড়তদার, ব্যাপারী—সবার কপালেই চিন্তার ভাঁজ। একেকজনের সমস্যা একেক ধরনের, এই যা।

চামড়াশিল্প মালিকদের দুশ্চিন্তার কারণ হলো, ২৩ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হলে তাঁরা সারা দেশ থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে কারখানা পর্যন্ত নিয়ে আসবেন কীভাবে? কারণ, ওই দিন থেকে সব ধরনের শিল্পকারখানা ও যানবাহন বন্ধের কঠোর বার্তা দিয়ে রেখেছে সরকার। এই অবস্থায় চামড়ার দাম নির্ধারণ নিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে শিল্পমালিকেরা এই শিল্পকে কঠোর বিধিনিষেধের বাইরে রাখার দাবি জানালেও সরকার কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) অস্বস্তি চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) দৈনিক বর্জ্য ধারণক্ষমতা নিয়ে। সিইটিপির বর্জ্য ধারণক্ষমতা ২৫ হাজার কিউবিক মিটার। কিন্তু ঈদুল আজহার সময় তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ থেকে ৪৫ হাজার কিউবিক মিটারে। কোরবানির ঈদে বাড়তি এই চাপ সামাল দেওয়ার উপায় খুঁজছেন বিসিকের কর্মকর্তারা। বর্জ্য ও পানি আলাদা করতে নয়টি ডি ওয়াটারিং ইউনিট পুরোপুরি কাজ না করায় বিকল্প করণীয় বের করতেও গলদঘর্ম অবস্থা কর্মকর্তাদের।

চামড়াশিল্প নগরের প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্রনাথ পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদে পরিস্থিতি সামাল দিতে আমরা বিকল্প চিন্তা করছি। সরকার এলাকাওয়ারি যেমন বিদ্যুতের রেশনিং করে থাকে, ঠিক তেমনি আমরা সিইটিপিতে একই পদ্ধতি চালু করব। ১৩২ কারখানার বর্জ্য একসঙ্গে সেখানে দেওয়া হবে না। অর্ধেক করে দেওয়া হবে।’

ঈদে পরিস্থিতি সামাল দিতে আমরা বিকল্প চিন্তা করছি। সরকার এলাকাওয়ারি যেমন বিদ্যুতের রেশনিং করে থাকে, ঠিক তেমনি আমরা সিইটিপিতে একই পদ্ধতি চালু করব।
জিতেন্দ্রনাথ পাল, প্রকল্প পরিচালক, চামড়াশিল্প নগর

সাভার শিল্পনগরে শ্রমিকেরাও ভালো নেই। সেখানে যেসব মালিক ভাড়ায় কারখানা চালাচ্ছেন, তাঁরা শ্রমিকদের নিয়মিত মজুরি দিচ্ছেন না। জুলাইয়ের অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো জুন মাসেরই বেতন পাননি অনেক শ্রমিক। তা ছাড়া যাঁরা স্থানীয় বাজারে ওয়েট ব্লু (চামড়া পরিশোধনের প্রাথমিক ধাপ) ব্যবসা করেন, করোনার কারণে তাঁদের ব্যবসাও স্থবির। তাঁদের টাকা আটকে আছে স্থানীয় বাজারে।

আড়তদার ও ব্যাপারীরা গতবারের টাকা এখনো হাতে পাননি। করোনাভাইরাস যে হারে ঊর্ধ্বমুখী, তাতে এবারও চামড়ার টাকা পাবেন কি না, তা নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা।

হেমায়েতপুরের স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, চামড়াশিল্পের কারণে ধলেশ্বরীতে আগের মতো মাছ মিলছে না। একসময় এই নদীর পানি দিয়ে ভাত রান্না করা হতো, অথচ এখন গোসল করাও যায় না। এমনকি হাত-পা ধুলেও চুলকানি শুরু হয়ে যায়। মোহাম্মদ নাসির নামের একজন গ্রামবাসী জানান, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া থেকে তিনি ১৫ জন জেলেকে মাছ ধরতে তিন মাসের জন্য ভাড়া করে এনেছিলেন। কিন্তু চামড়াশিল্প নগরের বর্জ্য পড়ে দূষিত হওয়ায় ধলেশ্বরী নদীতে আগের মতো আর জালে মাছ ধরা পড়ে না। ফলে ভাড়াটে জেলেদের নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন তিনি।

বুধবার চামড়াশিল্প নগরের মোর্শেদ ব্রাদার্স ট্যানারিতে ঢুকে দেখা যায়, চামড়া সংরক্ষণের জন্য তারা লবণ মজুত করে রেখেছে। চামড়া রাখতে তিনতলা কারখানার নিচতলা পুরোটাই খালি রাখা হয়েছে। চামড়ার পশম দূর করার জন্য ড্রামও তৈরি।

ভুলুয়া ট্যানারিতেও দেখা গেল, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ থেকে সংরক্ষণে সবকিছু প্রস্তুত। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘এবারে তিন লাখ পিছ কাঁচা চামড়া কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ থাকলে কাঁচা চামড়া কীভাবে সংগ্রহ করব? কীভাবে তা কারখানা পর্যন্ত নিয়ে আসব?’ তিনি বলেন, ‘এখন গরমের সময়। বেশি দিন চামড়া বাইরে রাখা যাবে না। যদি চামড়াশিল্পকে বিধিনিষেধের বাইরে রাখা না হয়, তাহলে আমরা চামড়া কিনব না।’

সাভার চামড়াশিল্প নগরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি), ডি ওয়াটারিং ইউনিট এবং ডাম্পিং ইয়ার্ড একসঙ্গে লাগোয়া। সিইটিপিতে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে পাম্প, জেনারেটর, ল্যাবের কাজ এখনো শেষ হয়নি।

চামড়াশিল্প নগরে বর্জ্য ও পানি আলাদা করতে ডি ওয়াটারিং ইউনিট আছে নয়টি। কিন্তু দেখা গেল, তিনটি ইউনিট কাজ করছে না। অবশ্য প্রকল্প পরিচালক বলেন, তিনটি নয়, একটি ইউনিট অকার্যকর। অন্যদিকে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলছেন, তিনটি ইউনিট অকার্যকর।

দুর্গন্ধের কারণে ডাম্পিং ইয়ার্ডের আশপাশ দিয়ে মানুষের যাতায়াত করা কঠিন। রাস্তাটিও ব্যবহারের অনুপযোগী। প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্রনাথ পাল জানান, ডাম্পিং ইয়ার্ড বানানোর জন্য নতুন একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। তার আগে আপৎকালীন হিসেবে দুটি ইনডোর ডাম্পিং ইয়ার্ড করা হয়েছে।

বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচাতে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ২০১৭ সালে চামড়াশিল্পকে সাভারে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু সিইটিপি কার্যকর না থাকায় সব বর্জ্য গিয়ে পড়ছে ধলেশ্বরী নদীতে। দূষণের কারণে ধলেশ্বরী নদীও এখন হুমকিতে।

এদিকে হেমায়েতপুরের পাশে হরিণধরা বাজারে গত এক বছরে চামড়ার অন্তত ৭০টি আড়ত গড়ে উঠেছে। তাদের সংগ্রহ করা গরু, মহিষ, ভেড়া ও ছাগলের কাঁচা চামড়া ট্যানারির মালিকেরা কিনে নেন।

চামড়াশিল্প নগরে কথা হয় অন্তত ২০ জন শ্রমিকের সঙ্গে। তাঁরা জানান, চামড়ায় রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে তাঁদের শরীরে নানা ধরনের রোগ বাসা বেঁধেছে। ৩০ বছরের পুরোনো শ্রমিক মোহাম্মদ বাবুল জানান, হরিণধরা ইউনিয়নে এক মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে

থাকেন। তারপরও যা টাকা বেতন পান, তা দিয়ে জীবন চলে না।

চামড়াশিল্প নগরে শ্রমিকদের জন্য আবাসন ও বিনোদন এবং তাঁদের সন্তানদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি ক্লিনিক ইত্যাদি করার কথা থাকলেও এসব সুবিধা এখনো অধরা।