দর সংশোধনেও স্বস্তি নেই নির্মাণ উপকরণে
বর্তমানে টনপ্রতি দর
রড: ৭৫,০০০–৭৮,৫০০ টাকা।
সিমেন্ট: ৭,৮০০–৮,৪০০ টাকা
পাথর: ৩,৫০০–৩,৫৫০ টাকা।
সংশোধনের পরও বাড়তি (টনপ্রতি)
রডে ১৭ হাজার টাকা।
সিমেন্টে ৬০০–৮০০ টাকা
পাথরে ২০০–২৫০ টাকা
* চট্টগ্রামের দর দেখানো হয়েছে। পরিবহন খরচের কারণে ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে দাম কিছুটা বেশি হবে।
রডের মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড হওয়ার পর টনপ্রতি আবার দেড় থেকে দুই হাজার টাকা কমেছে। কিন্তু দাম সংশোধনের এই সুখবরও নির্মাণ উপকরণের বাজারে স্বস্তি দিচ্ছে না। কারণ, এখনো রডের দাম গত বছরের ঠিক এই সময়ের তুলনায় টনপ্রতি ১৭ হাজার টাকা বেশি।
রডের মতো আরেক নির্মাণ উপকরণ পাথরের দামও কিছুটা সংশোধন হয়েছে। এখন প্রতি বস্তা সিমেন্ট আগের চেয়ে ১০–১৫ টাকা কমে পাওয়া যাচ্ছে। এরপরও সিমেন্টের দাম এক বছর আগের তুলনায় বেশ বাড়তি রয়েছে। একইভাবে সব কটি নির্মাণ উপকরণের দাম এখন গত বছরের এই সময়ের তুলনায় বেশি। বাজারদর হিসাব করে দেখা গেছে, দর সংশোধনের পরও প্রধান তিনটি নির্মাণ উপকরণ রড, সিমেন্ট ও পাথর এক বছর আগের তুলনায় এখন ২৪ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ইটের দামও বেড়েছে ২০ শতাংশ।
নির্মাণ উপকরণ তৈরির প্রধান কাঁচামালের সব কটি আমদানিনির্ভর। রডের জন্য পুরোনো লোহার টুকরা বা পুরোনো জাহাজ, সিমেন্টের জন্য ক্লিংকার, আর কাঁচা ইট পোড়ানোর জন্য কয়লা আমদানি করতে হয়। এসব কাঁচামালের বাজার বিশ্বব্যাপীই চড়া। এর ওপর জাহাজভাড়া অনেক বেড়েছে। দুটি মিলিয়ে দেশে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত খরচের টাকা তুলে নিচ্ছেন উৎপাদকেরা।
দেশে রড, সিমেন্ট ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ইট উৎপাদনকারী মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণ উপকরণের দাম এখানে কত হবে, তা ঠিক করে দিচ্ছে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দর। যেমন বিশ্ববাজারে রডের কাঁচামাল টনপ্রতি ২০–২৫ ডলার কমায় দেশেও রডের দাম কমেছে। বিশ্ববাজারে দাম না কমলে দেশে কমার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। উৎপাদন খরচ অনুযায়ীই বাজারে পণ্য বিক্রি করা হয়।
এক বছর আগের তুলনায় কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরে এই উদ্যোক্তা বলেন, প্রতি টন পুরোনো লোহার টুকরার দাম ৩১০ ডলার থেকে বেড়ে ৫২৫ ডলার, কয়লা ৭০ ডলার থেকে ১৪০–১৫০ ডলার এবং ক্লিংকার ৪২ ডলার থেকে ৬৫ ডলারে উঠেছে। বিশ্ববাজারে দামের পাশাপাশি ডলারের বিনিময়মূল্যও কয়েক মাস আগের তুলনায় এখন দু–তিন টাকা বেশি। ফলে নির্মাণ খাতের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
করোনার সময় বিশ্বব্যাপী নির্মাণ খাতের কাঁচামাল বা প্রস্তুত পণ্যের উৎপাদন কমে যায়। তখন চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য ছিল না। কিন্তু করোনা মহামারি কাটিয়ে গত বছরের শেষ দিকে যখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার শুরু হয়, তখন দেশে দেশে কাঁচামালের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। ফলে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়। তার জেরে দেশের বাজারে নির্মাণসামগ্রীগুলোর দাম বেড়ে বাড়তে থাকে। কিছুটা সংশোধনের পরও এখনো গত বছরের চেয়ে বেশি।
ভবন বা অবকাঠামো নির্মাণে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয় রডের জন্য। চট্টগ্রামের বাজারে এখন প্রতি টন রড বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা। ঢাকায় এই দর দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বেশি। অবশ্য সিমেন্টের দর এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে বস্তাপ্রতি ৪০–৫০ টাকা বা টনপ্রতি ৮০০–১০০০ টাকা বেড়েছে। এখন অবশ্য বস্তাপ্রতি ১০–১৫ টাকার মতো কমেছে। জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়ায় কয়েক মাস আগে পাথরের দাম টনপ্রতি ৭০০ টাকার বেশি বেড়েছিল। এখন দর কমে হয়েছে ৩ হাজার ৫৫০ টাকা। এরপরও এক বছর আগের তুলনায় দাম টনপ্রতি ২০০–২৫০ টাকা বেশি।
মূল্যবৃদ্ধির তালিকা থেকে বাইরের ছিল দেশীয় উপকরণে তৈরি ইট। শেষ পর্যন্ত সেই ইটের নামও উঠে গেছে মূল্যবৃদ্ধির তালিকায়। এর কারণও বিশ্ববাজার। খুলেই বলি, ইট পোড়াতে দরকার কয়লা। প্রতি টন কয়লার দাম ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা থেকে বেড়ে এখন দেশভেদে ১৯ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে ইট উৎপাদনের খরচ বেড়ে প্রতিটির দাম দেড় থেকে দুই টাকা বেড়েছে।
নির্মাণ উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ভরা মৌসুমেও বিক্রি খুব বেশি বাড়েনি। কারণ, ব্যক্তি খাতে ও বেসরকারি খাতে অনেকে এখন দাম কমার অপেক্ষায় আছেন। নির্মাণ খাতের ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সাবেক সভাপতি খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে অবকাঠামো নির্মাণ যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে গতি পায়নি। এর কারণ নির্মাণ উপকরণের চড়া দাম।’
অবশ্য আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহসভাপতি আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণ উপকরণের দাম বাড়লেও আবাসন খাতে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখার সুযোগ নেই। তবে দাম বাড়ায় এখন ফ্ল্যাট নির্মাণে আগের তুলনায় ১৫–২০ শতাংশ খরচ বেড়েছে। গ্রাহক সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে এখনো আবাসন কোম্পানিগুলো এই বাড়তি খরচের ভার নিচ্ছে। যদি মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে তাহলে ফ্ল্যাটের দাম বাড়ানোর বিকল্প থাকবে না।