দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে অমিক্রন

ইউরোপের দেশে দেশে আবারও বিধিনিষেধ আরোপ হতে থাকলে ক্রয়াদেশ কমবে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় গত মঙ্গলবার করোনাভাইরাসের নতুন ধরন অমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। এরপর বতসোয়ানা, ইসরায়েল, হংকং, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, চেক প্রজাতন্ত্র, অস্ট্রেলিয়াসহ ১৩টি দেশে নতুন এই ধরনের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অমিক্রনকে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’, ‘উদ্বেগজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছে।

অবশ্য অমিক্রনের আগেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছিল। এ জন্য ১৯ নভেম্বর অস্ট্রিয়া তিন সপ্তাহের লকডাউন জারি করেছে। নেদারল্যান্ডসও তিন সপ্তাহের জন্য আংশিক লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে। সে কারণে ক্রিসমাস বা বড়দিন উপলক্ষে বেচাকেনার এই ভরা মৌসুমে বিকেলের মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বেলজিয়াম, জার্মানি, চেক রিপাবলিক, গ্রিসসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশেও প্রায় একই ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

এদিকে করোনার নতুন ঢেউ আর নতুন ধরন অমিক্রনের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তাঁরা বলছেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে ইউরোপের দেশে দেশে আবারও আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ লকডাউন হলে আগামী মৌসুমের ক্রয়াদেশ কমবে। পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হলে ক্রয়াদেশ স্থগিতও হতে পারে। তবে বিদেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা এখন পর্যন্ত নেতিবাচক কোনো বার্তা দেননি।

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার নতুন ঢেউ নিয়ে আমরা শঙ্কায় ছিলাম। অমিক্রন সেটিকে আরও বাড়িয়েছে। ইতিমধ্যে নেদারল্যান্ডস, জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে আংশিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশও কড়াকড়ি আরোপ করলে ক্রিসমাসের বিক্রিতে ধস নামবে। সেটি হলে চলমান কিছু ক্রয়াদেশ স্থগিত হতে পারে। আবার পণ্য রপ্তানি পর দেরিতে অর্থ পরিশোধ করতে পারেন ক্রেতারা। বর্তমানে ক্রয়াদেশ আসার যে গতি রয়েছে, সেটিও শ্লথ হতে পারে।’

করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাক্কা কাটিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ১ হাজার ২৬২ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৭ হাজার ২৭০ কোটি টাকার তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। গত বছর ওই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৪৫ কোটি ডলারের পোশাক।

কয়েকজন পোশাকশিল্প মালিক প্রথম আলোকে জানান, আগামী বসন্ত ও গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ ইতিমধ্যে দিয়ে দিয়েছে ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। তাতে দেশের অধিকাংশ কারখানায় আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত ভরপুর কাজ রয়েছে। তবে চীনের কাঁচামাল সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ও জাহাজে পণ্য পরিবহনে সময় বেশি লাগার কারণে আগামী শীত মৌসুমের পোশাকের ক্রয়াদেশও আগেই দিতে শুরু করেছে কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। অবশ্য ক্রয়াদেশের মূল চাপটা আসবে ক্রিসমাসের ছুটির পর।

জানতে চাইলে প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, ক্রেতাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের নেতিবাচক বার্তা আসেনি। ফলে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, সেটি বোঝা যাবে আগামী মাসে। কারণ, তখন আগামী শীতের ক্রয়াদেশ দেওয়া শুরু করবে ক্রেতারা। তবে করোনা সংক্রমণ রোধে দেশে দেশে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে স্বাভাবিকভাবেই ক্রয়াদেশ কমবে। যদিও লকডাউন মানতে চাচ্ছেন না ইউরোপীয়রা। সে কারণে লকডাউনের বিরুদ্ধে দেশে দেশে বিক্ষোভ হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় গত বছরের মার্চে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করা হয়। অন্যদিকে দেশেও ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পর মাসখানেক কারখানা বন্ধ থাকে। সে কারণে গত বছরের এপ্রিলে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরের মাসে রপ্তানি হয় ১২৩ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ১৮ শতাংশ কম। এরপর ধীরে ধীরে খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়।

বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, করোনার প্রথম ধাক্কার শুরুতে ৩১৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ প্রাথমিকভাবে বাতিল ও স্থগিত হয়েছিল। পরে নানামুখী চাপের কারণে অধিকাংশ ক্রেতাই পণ্য নিতে সম্মত হন। তবে অর্থ পরিশোধে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত বেশি সময় নেয় অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।

অবশ্য গতবারের মতো বাজে পরিস্থিতি এবার হয়তো হবে না—এমন আশাবাদ শোনালেন টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব। গত রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরবরাহব্যবস্থায় নানাবিধ সমস্যার কারণে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দেওয়ার সময় কিছুটা এগিয়ে এনেছেন। সে কারণে আগামী শীতের ক্রয়াদেশ ইতিমধ্যে আসছে। এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তা ছাড়া এখনো অমিক্রনে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর তথ্য আমরা সুনির্দিষ্টভাবে পাইনি।’