তৈরি পোশাকশিল্প
দেউলিয়া জিবিজি, দুশ্চিন্তা এ দেশে
গত ৩০ জুন জিবিজি তাদের উত্তর আমেরিকা অংশের ব্যবসা দেউলিয়া ঘোষণার জন্য নিউইয়র্কের আদালতে আবেদন করেছে।
করোনার কারণে ব্যবসায় লোকসানের মুখে পড়ে দেউলিয়া হওয়ার তালিকায় যুক্ত হতে যাচ্ছে পোশাক ও জুতার পাইকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ব্র্যান্ডস গ্রুপ (জিবিজি) হোল্ডিং লিমিটেড। গত ৩০ জুন প্রতিষ্ঠানটি তাদের উত্তর আমেরিকা অংশের ব্যবসাকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য নিউইয়র্কের আদালতে আবেদন করেছে।
হংকংভিত্তিক জিবিজি ফাং গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান লিঅ্যান্ডফাং বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে থাকে। তারা ম্যাসি, নর্ডস্ট্রমের মতো যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি ডিপার্টমেন্ট চেইন স্টোরে পাইকারি দরে পোশাক ও জুতা সরবরাহ করে। এ ছাড়া ই-কমার্স জায়ান্ট আমাজনেও পণ্য সরবরাহ করে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইউরোপেও জিবিজির একই ধরনের ব্যবসা রয়েছে। তবে সেখানকার ব্যবসা যথারীতি চালিয়ে যাবে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশের অন্তত ১০টি কারখানা থেকে পোশাক যায় জিবিজি ইউএসএর কাছে। প্রতিষ্ঠানটিতে পোশাক সরবরাহকারী একাধিক কারখানামালিক বলেন, দেড় বছর ধরে জিবিজি আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। ফলে তাদের সঙ্গে কাজ করা অধিকাংশ কারখানামালিক আগে থেকে সতর্ক ছিলেন। তা সত্ত্বেও অনেকের টাকা আটকে আছে। এখন প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া ঘোষিত হলে বকেয়া পাওনা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন উদ্যোক্তারা।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘বিষয়টি আমরা শুনেছি। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির জন্য পোশাক তৈরি করত ১০-১২টি কারখানা। এই কারখানার উদ্যোক্তারা যেন আর্থিক ক্ষতির মুখে না পড়েন, সে জন্য পুরো বিষয়টি আমরা নজরদারিতে রেখেছি।’
২০১৩ সালে হংকংয়ের উইলিয়াম ফাং গ্লোবাল ব্র্যান্ডস গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার জন্য নিউইয়র্কের আদালতে আবেদন করার পর এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, করোনার কারণে ১৮ মাস ধরে খুচরা পণ্য বিক্রির ব্যবসায় ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়েছে। তাতে প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে গেছে। তাই আদালতের মাধ্যমে জিবিজির উত্তর আমেরিকার সম্পদ বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সময়ে নতুন ক্রয়াদেশ দেওয়া হবে না। তবে জিবিজির ইউরোপের ব্যবসা যথারীতি চলবে।
বিষয়টি আমরা শুনেছি। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির জন্য পোশাক তৈরি করত ১০-১২টি কারখানা। এই কারখানার উদ্যোক্তারা যেন আর্থিক ক্ষতির মুখে না পড়েন, সে জন্য পুরো বিষয়টি আমরা নজরদারিতে রেখেছি।শহিদউল্লাহ আজিম সহসভাপতি,বিজিএমইএ
সাত বছর ধরে লিঅ্যান্ডফাংয়ের মাধ্যমে জিবিজি ইউএসএর জন্য পোশাক তৈরি করে আসছিল রাইজিং গ্রুপ। গত বছর করোনার শুরুর দিকে তারা ১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের পোশাক কিছু মূল্যছাড় দিয়ে জিবিজির কাছে রপ্তানি করে। মূল্য ছাড়ে বিক্রি করা পোশাকের দাম পেলেও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির ক্রয়াদেশের বিপরীতে কেনা ২ লাখ ৯৩ হাজার ডলারের কাপড় রাইজিং গ্রুপের গুদামে পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। তাতে প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতি প্রায় আড়াই কোটি টাকা।
জানতে চাইলে রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুদামে পড়ে থাকা কাপড়ের বিষয়ে অনেক দিন ধরেই অপেক্ষা করতে বলছে জিবিজি ইউএসএ। এখন যেহেতু দেউলিয়া হয়ে গেছে, আমরা সেগুলো অন্য ক্রেতার কাছে অন্য নকশার পোশাক বানিয়ে রপ্তানির চেষ্টা করব।’
পাওনা অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না, সে বিষয়ে মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের দেউলিয়া আইনের অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। ফলে তারা যে সরবরাহকারীদের সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছে, সেটি নিয়মরক্ষার অংশ। সম্পত্তি বিক্রির পর প্রথম কোম্পানির কর্মী ও তাদের অফিস ও গুদামের মালিকেরা বকেয়া অর্থ পাবেন। তারপর যদি কিছু থাকে, তাহলে আমরা পেলেও পেতে পারি। যদি পাইও, তা হবে খুবই সামান্য।’
আরেক ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড। কারখানাটিকে ২০১৯ সালের শেষের দিকে ২৪ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ দেয় জিবিজি। করোনার আগে কিছু পোশাক রপ্তানিও করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। মহামারির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে লকডাউন শুরু হলে ক্রয়াদেশ অনুযায়ী পণ্য নিতে গড়িমসি করে জিবিজি। এদিকে কাপড় কিনে পোশাক বানানো অনেকটাই সেরে ফেলে ডেনিম এক্সপার্ট।
জিবিজির কাছে বিপুল অর্থ আটকে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন ডেনিম এক্সপার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন। এ নিয়ে দেশি-বিদেশি গণ্যমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। চাপে পড়ে জিবিজি। ধাপে ধাপে পোশাক নিতে থাকে তারা। শেষ পর্যন্ত ক্রয়াদেশের দেড় বছর পর রপ্তানির অর্থ পায় কারখানাটি।
জানতে চাইলে মোস্তাফিজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়া হওয়াটা নতুন কিছু নয়। কোনো ক্রেতা দেউলিয়া হলে তাদের সরবরাহকারী কারখানাগুলো লোকসানের মুখে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক সংগঠন ও সরকার এগিয়ে এলে পাওনা আদায় সহজ হয়। তিনি বলেন, ‘জিবিজি ইউএসএর অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় কয়েকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আমার প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। মানে, ক্রয়াদেশ দিচ্ছে না।’