নতুন শ্রমিকের খোঁজে মালিকেরা

দুই কারণে নতুন শ্রমিক নিয়োগের হার বেড়েছে। তবে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক–সংকটের কথা বলছেন উদ্যোক্তারা।

নারায়ণগঞ্জের প্লামি ফ্যাশনস নিজেদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেছে। এ জন্য শ্রমিকের সংখ্যা ৬০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত তিন মাসে তারা ৭০০ শ্রমিক নিয়োগও দিয়েছে। আগামী এক মাসে আরও ৩০০ শ্রমিক নেবে। নতুন লোকবল নিয়োগের আগে পরিবেশবান্ধব এই কারখানাটিতে কাজ করতেন ২ হাজার কর্মী।

জানতে চাইলে প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলুল হক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার প্রথম ধাক্কার পর যখন ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ বাড়তে শুরু করে, তখনই আমরা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করি। কারণ, অনেক ক্রেতাই গুণগত মানসম্পন্ন কারখানা খুঁজছেন। বর্তমানে ক্রয়াদেশ ভালো থাকায় উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ করতে তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না।’

ক্রয়াদেশ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লামি ফ্যাশনসের মতো রপ্তানিমুখী অনেক পোশাক কারখানাই উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। আবার আগের তুলনায় ক্রয়াদেশে কম লিড টাইম (ক্রয়াদেশ থেকে পণ্য জাহাজীকরণ পর্যন্ত সময়) দেওয়ায় অল্প সময়ে বেশি পণ্য উৎপাদনের চাপ তৈরি হয়েছে। এই দুই কারণেই মূলত নতুন শ্রমিক নিয়োগের হার বেড়েছে। তবে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কিংবা অদক্ষ কোনো শ্রমিকই পাচ্ছেন না বলে জানালেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা।

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ২০১৯ সালের তুলনায় পোশাকের ক্রয়াদেশ ১০-১৫ শতাংশ বেশি আসছে। বাড়তি ক্রয়াদেশের ফলে ৫-৭ শতাংশ শ্রমিক নিয়োগ বাড়তে পারে। তাতে দুই লাখের কিছু কমবেশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে।

রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে কারখানা ও শ্রমিকের সংখ্যার সঠিক কোনো হিসাব নেই। তবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা উন্নয়ন কেন্দ্রের (সিইডি) ম্যাপড ইন বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, দেশে রপ্তানিমুখী ৩ হাজার ৩৮৪ পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করেন ২৬ লাখ ৬৬ হাজার শ্রমিক। এর মধ্যে ১১ লাখ ১৩ হাজার পুরুষ ও ১৫ লাখ ৫৩ হাজার নারী।

ম্যাপড ইন বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ও বিজিএমইএর দাবি আমলে নিলে বাড়তি ক্রয়াদেশের কারণে ৫-৭ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ ৩৩ হাজার থেকে ১ লাখ ৮৬ হাজার নতুন শ্রমিক নিয়োগ হতে পারে পোশাকশিল্পে। তবে ৩ হাজার ৩৮৪ কারখানার মধ্যে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য নয়, এমন কারখানার সংখ্যা ৬৭৫। ফলে নতুন শ্রমিক নিয়োগের সংখ্যাটি আরও কম হতে পারে। আবার করোনাকালে ছাঁটাই হওয়া অনেক শ্রমিকও আবার নিয়োগ পাচ্ছেন।

পোশাক খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি স্নোটেক্স গ্রুপ। তারা বছরে ২৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। তাদের স্নোটেক্স আউটারওয়্যার ও স্নোটেক্স স্পোর্টসওয়্যারে ছয় হাজার নতুন শ্রমিক নিয়োগ পেয়েছে। আরও এক হাজার নতুন শ্রমিক নিয়োগ করা হবে।

স্নোটেক্স গ্রুপের এমডি এস এম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৯ সালের তুলনায় আমাদের ক্রয়াদেশ বর্তমানে প্রায় দ্বিগুণ। সক্ষমতা আরও বেশি হলে ক্রয়াদেশ আরও বেশি নেওয়া যেত।’

পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। তাই সেসব দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের জন্য করোনার আগের মতো ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। তা ছাড়া মিয়ানমারে সেনাশাসন ও ভারতে করোনার ভয়াবহতার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। তার আগেই চীন থেকে কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে স্থানান্তর করে আসে ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা। সাম্প্রতিককালে ভিয়েতনামে লকডাউন থাকার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ আসছে। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বেশি এসেছে।

চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট ক্রয়াদেশ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত তিন-চার মাসে ৩৫০ জন শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছে। আরও সাড়ে তিন শ শ্রমিক নেবে। এ তথ্য দিয়ে ডেনিম এক্সপার্টের এমডি মোস্তাফিজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রয়াদেশ দিতে আগ্রহী ক্রেতাদের ফোন প্রতিদিনই পাচ্ছি। ক্রয়াদেশের এমন চাপ গত পাঁচ বছরে পাইনি। তবে বর্তমানে বড় সমস্যা হচ্ছে শ্রমিকের সংকট। চাহিদা অনুযায়ী লোক পাচ্ছি না। সে কারণে উৎপাদনক্ষমতাও বাড়ানো যাচ্ছে না।’

করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে পোশাক রপ্তানি ইতিমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরের প্রথম মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ভালো হয়নি। তবে আগস্টে ২৭৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই মাসের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ বেশি।

আরেক শীর্ষস্থানীয় পোশাক কারখানা স্প্যারো অ্যাপারেলস। দেশে চারটি ছাড়াও জর্ডানে তাদের যৌথ মালিকানায় একটি কারখানা রয়েছে। দেশ থেকে তারা বছরে ২০ কোটি ডলার বা ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি করে। পবিত্র ঈদুল আজহার পর প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন ৮০০ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির এমডি শোভন ইসলাম বলেন, ‘করোনার মধ্যে ক্রয়াদেশ কমাসহ নানাবিধ কারণে কয়েকটি লাইন বন্ধ করতে হয়েছিল। ক্রয়াদেশের চাপে সেগুলো চালু করেছি।’

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রেতারা আগের চেয়ে কম লিড টাইমে পোশাকের ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। তাই অল্প সময়ে বেশি উৎপাদনের জন্য লোকবল নিয়োগ বেড়েছে। তাতে পুরো খাতে বর্তমান জনবলের চেয়ে ৫ শতাংশের বেশি নতুন কর্মসংস্থান হবে।’ তিনি বলেন, প্রায় প্রতিটি কারখানার ফটকেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ঝুলছে।