কয়েক বছর ধরেই বাংলা নববর্ষকে ঘিরে কেনাকাটা বাড়ছিল। সাধারণ মানুষের গণ্ডি পেরিয়ে উৎসবটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানেও মিশেছে। ফলে বর্ষবরণের ব্যবসা-বাণিজ্য শুধু আর পোশাক কেনাবেচায় আটকে নেই, বরং পরিধি বেড়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৈশাখী ভাতাও পান। বেসরকারি খাতের অনেকগুলো ব্যাংকও ভাতা দেয় বৈশাখে। সব মিলিয়ে বৈশাখকেন্দ্রিক ছোট অর্থনীতির আকারটি ধীরে ধীরে বাড়ছিল। তবে গত বছর করোনার থাবায় সেই ‘উদীয়মান অর্থনীতি’ হুমকির মুখে পড়ে। চলতি বছরও মহামারির কারণে উৎসবটি ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
বৈশাখকেন্দ্রিক বেচাবিক্রি বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো প্রতিবছরই বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে। গত বছরের লোকসান কাটাতে চলতি বছর আশায় বুক বেঁধেছিলেন ব্যবসায়ীরা। বৈশাখে বিক্রির জন্য পণ্যসামগ্রীও প্রস্তুত করেছিলেন। হঠাৎ করে দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সরকার গত সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য দোকানপাট ও বিপণিবিতান বন্ধ ঘোষণা করে। ব্যবসার ভরা মৌসুমে দোকান ও মার্কেট বন্ধের প্রতিবাদে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসায়ীরা রাস্তায় নামেন। একাধিক জায়গায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও বাঁধে ব্যবসায়ীদের।
এ অবস্থায় বৈশাখের আগের পাঁচ দিন ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আজ এক প্রজ্ঞাপনে বলেছে, আগামীকাল শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আট ঘণ্টা স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট ও বিপণিবিতান খোলা রাখা যাবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানা না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় পয়লা বৈশাখ উদযাপনের আমেজ অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে দোকানপাট ও বিপণিবিতান খুললেও ব্যবসা কতটা হবে, সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে সরকারের সিদ্ধান্তে আপাতত স্বস্তি পেয়েছেন তাঁরা।
রাজধানীতে থাকা মানুষের মধ্যে বৈশাখী পোশাক কেনার আগ্রহ বেশি থাকায় বুটিক ও ফ্যাশন হাউসগুলো তিন-চার মাস আগ থেকেই প্রস্তুতি নেয়। কয়েক বছর আগেও বৈশাখের আগে সপ্তাহখানেক ফ্যাশন হাউসের ব্যবসা হলেও বর্তমানে পুরো চৈত্র মাসই ব্যবসা চলে।
দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো বৈশাখের আগে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। শেষ পাঁচ দিনে দোকানপাট খুলতে পারলে কিছু ব্যবসা হয়তো হবে। তবে মোট বিনিয়োগের খুব ছোট্ট অংশই তুলতে পারবেন।সৌমিক দাশ , কর্ণধার, রঙ বাংলাদেশ
ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতি (এফইএবি বা ফ্যাশন উদ্যোগ) বেশ কয়েক বছর আগে একটি জরিপ করেছিল। সেই জরিপের তথ্যানুযায়ী, দেশের ফ্যাশন হাউসে সারা বছরে যে পরিমাণ বিক্রি হয়, তার মধ্যে ৫০ শতাংশই হয় রোজার ঈদে। ২৫ শতাংশ হয় পয়লা বৈশাখে। বাকিটা সারা বছর। সেই হিসাবে বৈশাখে দেড় হাজার কোটি থেকে দুই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় বলে জানান ফ্যাশন উদ্যোগের নেতারা।
জানতে চাইলে রঙ বাংলাদেশের কর্ণধার সৌমিক দাশ প্রথম আলোকে বলেন, দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো বৈশাখের আগে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। শেষ পাঁচ দিনে দোকানপাট খুলতে পারলে কিছু ব্যবসা হয়তো হবে। তবে মোট বিনিয়োগের খুব ছোট্ট অংশই তুলতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, বৈশাখের চেয়েও ঈদের ব্যবসা নিয়ে বেশি চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। রোজায় দোকানপাট খোলা না গেলে অনেকেই বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়বেন। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন ও জীবিকা দুটোই বাঁচাতে হবে।
আশা করছি, পবিত্র রমজান মাসেও দোকানপাট ও বিপণিবিতান খোলা থাকবে। আমরা তখন দোকানপাট ও বিপণিবিতান খোলার সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ করব। আমরা সরকারকে কথা দিচ্ছি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা পরিচালনা করব। কেউ কথা না রাখলে মার্কেট কমিটি ব্যবস্থা নেবে।হেলাল উদ্দিন , সভাপতি, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি
বর্ষবরণ উৎসবটি সর্বজনীন। সব ধর্মের মানুষই উৎসবটি উদযাপনে কেনাকাটা করে। এ ছাড়া গ্রামগঞ্জ ও শহরে অনেক জায়গায় বৈশাখী মেলা হয়। এতে দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের পণ্যসামগ্রী বিক্রি হয়। দোকানপাট ও বিপণিবিতান খোলার সিদ্ধান্ত হলেও মেলার বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়ার কথা জানায়নি সরকার। ফলে গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা গতবারের মতো এবারও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পয়লা বৈশাখের আগে দোকানপাট ও বিপণিবিতান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে আমরা ব্যবসায়ীরা আনন্দিত। কারণ, বৈশাখের পোশাক রমজানে বিক্রি করা যায় না। বৈশাখকে ঘিরে দেশীয় ফ্যাশন হাউস ও দোকানপাটে চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়।’
পয়লা বৈশাখের পর দোকানপাট খোলা থাকবে কি না, সেটি পরিষ্কার করেনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ বিষয়ে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আশা করছি, পবিত্র রমজান মাসেও দোকানপাট ও বিপণিবিতান খোলা থাকবে। আমরা তখন দোকানপাট ও বিপণিবিতান খোলার সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ করব। আমরা সরকারকে কথা দিচ্ছি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা পরিচালনা করব। কেউ কথা না রাখলে মার্কেট কমিটি ব্যবস্থা নেবে।’