সাভারের গয়না গ্রাম
রপ্তানির হাতছানি ভাকুর্তার অলংকারের
১৫ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে ভাকুর্তায়। মৌসুমের সময় প্রতিদিন গড়ে এক কোটি টাকার বেচাকেনা হয় সেখানে।
দুই বছর আগে করোনা মহামারির শুরুতে অলংকার নির্মাতা দুলাল রাজবংশী ভেবেছিলেন, এ পেশা ছেড়ে দেবেন। কারণ, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির ফলে অলংকার বিক্রি করে লাভের মুখ দেখছিলেন না তিনি। পেশা বদলানোর কথা যখন ভাবছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তার। তাঁর মাধ্যমে গত বছর জাতীয় এসএমই মেলায় একটি স্টল দেন দুলাল রাজবংশী। মেলায় অংশ নিয়ে তিনটি দেশ থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকার রপ্তানি আদেশ পান তিনি। আর তাতেই পেশা বদলানোর চিন্তা বাদ দেন দুলাল রাজবংশী; বরং এখন তিনি ব্যবসা বড় করে রপ্তানি কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই পরিকল্পনা করছেন।
দুলাল রাজবংশীর মতো প্রায় ৩০০ অলংকার ব্যবসায়ী আছেন ঢাকার অদূরে সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নে। মালিক ও কর্মী মিলিয়ে এ ইউনিয়নের অন্তত ১০ গ্রামের ১৫ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে হাতে তৈরি এ অলংকারশিল্পে। তাঁদের মধে৵ প্রায় অর্ধেকই নারী। আর অলংকার বেচাকেনার জন্য এ ইউনিয়নের তিনটি বাজারে আছে প্রায় সাড়ে ৩০০ দোকান। সাধারণত আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে বিভিন্ন নকশার অলংকার তৈরি করা হয় সেখানে। পাশাপাশি আমদানি করা সম্পূর্ণ তৈরি অলংকারেরও কেনাবেচা করেন অলংকারশিল্পের মালিকেরা। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার গয়না বিক্রি হয় এখান থেকে।
এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, অক্টোবর–ফেব্রুয়ারি মৌসুমে স্থানীয় তিনটি বাজারে প্রতিদিন হাতে তৈরি গড়ে এক কোটি টাকার অলংকার বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ক্রেতারা ভাকুর্তা থেকে এসব অলংকার কিনে নিয়ে যান। রাজধানীর চকবাজার, নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, গাউছিয়াসহ বিভিন্ন বিপণিবিতানের ব্যবসায়ীরাও এসব পণ্য কেনেন।
দেশের বাজারে ভালো চাহিদা থাকলেও ভাকুর্তার অধিকাংশ উদ্যোক্তা এখনই বিদেশে রপ্তানির বিষয়টি ভাবছেন না। কারণ, তাঁরা এখন কাঁচামাল–সংকট, রাসায়নিকের উচ্চমূল্য, ব্যাংকঋণ তথা অর্থসংকটে ভুগছেন। পাশাপাশি আছে পণ্য বাজারজাতের সমস্যা, প্রশিক্ষণের অভাব ও দুর্বল যাতায়াতব্যবস্থা। এসব সমস্যাকে এ শিল্পের বিকাশের পথে অন্যতম বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
তবে এসএমই ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, হাতে তৈরি এখানকার অলংকারের রপ্তানির অনেক সম্ভাবনা আছে। তাতে বাড়বে কর্মসংস্থান। তাই ভাকুর্তার গয়না তৈরির সঙ্গে যুক্ত গ্রামগুলোকে একটি অঞ্চল (ক্লাস্টার) হিসেবে ধরে নির্মাতাদের প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে কাজ করছে এসএমই ফাউন্ডেশন।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় দেড় শ বছর ধরে কয়েক প্রজন্মের হাত ধরে এ অলংকারশিল্পের বিকাশ ঘটেছে। ২০০০ সালেও এই এলাকায় পাঁচ হাজারের মতো অলংকার তৈরির কারিগর ছিলেন। দুই যুগের ব্যবধানে সেই সংখ্যা বেড়ে এখন ১৫ হাজারের বেশি। কারিগরেরা জানান, গলার হার, নথ, টায়রা ও আংটি থেকে শুরু করে একজন নারীর সাজতে যত ধরনের অলংকার প্রয়োজন, তার সবই তৈরি হয় এ গয়না গ্রামে। ২০ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম আছে এসব গয়নার। মানভেদে এ গ্রামে তৈরি গয়নাগুলো ছয় মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
কাঁচামালের চড়া দাম
ভাকুর্তার গয়না ব্যবসায়ী মো. আলমগীর হোসেন জানান, তামা ও পিতল থেকে কাস্টিং পদ্ধতিতে অলংকার তৈরির মধ্যবর্তী বিভিন্ন উপকরণ বানানো হয়। এ কাজে যন্ত্র ছাড়াও প্রয়োজন হয় ইনভেস্টমেন্ট কাস্টিং পাউডার নামে একধরনের রাসায়নিকের। ভারত থেকে এ কাস্টিং পাউডার আমদানি করা হয়। নির্ধারিত কয়েকটি খাত ছাড়া অন্যরা এ পাউডার আনতে গেলে দিতে হয় চড়া শুল্ক। তাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে অলংকার তৈরির পর বিক্রি করে যে দাম পাওয়া যায়, তাতে খুব বেশি লাভ হয় না বলে জানান আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘খরচ কমাতে এখন আমরা সরাসরি অলংকার তৈরির আনুষঙ্গিক উপকরণ আমদানি করি। তবে কাস্টিং পাউডার আমদানির শুল্ক কমালে তাতে আমাদের উৎপাদন খরচ অনেক কমবে।’
অন্যান্য উপকরণ ক্রয়ের ক্ষেত্রেও বাড়তি খরচের কথা জানান, আরেক ব্যবসায়ী মো. আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘ট্রেড লাইসেন্স ও অন্য কাগজপত্র না থাকায় এসব উপকরণ আমরা সরাসরি আমদানি করতে পারি না। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আমদানি করতে হয়। তাতে খরচ বেশি পড়ে।’ এ ছাড়া পুঁজি–সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও কিনতে পারছেন না বলে জানান কয়েকজন উদ্যোক্তা। তবে ধীরে ধীরে আমদানিনির্ভরতা কমছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। আবুল হোসেন বলেন, গয়না নির্মাতারা আগে প্রায় শত ভাগ কাঁচামাল ভারত থেকে আমদানি করতেন। এখন ৩০ শতাংশ কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে পাওয়া যাচ্ছে। তবে রাসায়নিকসহ অন্যান্য উপকরণ কম খরচে আনতে পারলে তাতে দেশের অভ্যন্তরে কাঁচামালের জোগান বাড়ানো সম্ভব হবে। তখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও অলংকার রপ্তানির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাবে।
ব্যাংকিং কার্যক্রমে যুক্ত নেই অধিকাংশ ব্যবসায়ী
ভাকুর্তার অলংকারশিল্পের সঙ্গে যুক্ত বেশির ভাগ ব্যবসায়ী আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছেন। এ এলাকার ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন গড়ে লাখ টাকার বেশি অলংকার বেচাকেনা করলেও আর্থিক লেনদেনের পুরোটাই হয় নগদ অথবা মুঠোফোন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। ফলে লেনদেনের ব্যাংকিং কোনো রেকর্ড বা বিবরণীও থাকে না তাঁদের। এ কারণে ব্যাংকের ঋণ পান না এসব ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা।
ভাকুর্তা ইমিটেশন জুয়েলারি সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক দুলাল রাজবংশী জানান, তাঁদের ইউনিয়নের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ব্যাংকের শাখা নেই। আগে একটি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা ছিল, দুই বছর আগে সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। একটি মাত্র এটিএম বুথ আছে এ এলাকায়। এ অবস্থায় ব্যাংকের কাজের জন্য হেমায়েতপুর বা আমিনবাজার যেতে হয়। ব্যাংকিং কাজে নিয়মিত হেমায়েতপুর বা আমিনবাজারে যেতে হলে ব্যবসায় আর সময় দেওয়া হবে না। এ ছাড়া এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ ব্যবসায়ীর কোনো ট্রেড লাইসেন্স নেই বলেও জানান তিনি। আর ট্রেড লাইসেন্স না থাকায় ব্যাংকঋণ প্রাপ্তিসহ নানা কাজের ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়তে হয় তাঁদের।
আরও যেসব সমস্যা ঘিরে আছে এ শিল্পকে
কারিগরেরা ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কিছু নকশার অলংকার তৈরি করেন। প্রশিক্ষণের অভাবে তাঁরা পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে পারছেন না। আবার ভাকুর্তায় কাজের মজুরিও তুলনামূলক কম। একজন পুরুষ কারিগর দৈনিক গড়ে ১২ ঘণ্টা কাজ করে পান সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা। সে ক্ষেত্রে নারী কর্মীর দৈনিক মজুরি আরও কম, সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। কম মজুরির কারণে কারিগরেরা বেশি দিন এ পেশায় থাকতে চান না। ব্যবসায়ীরা জানান, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় লাভ একেবারে সীমিত হয়ে গেছে। তাই কর্মীদের মজুরি বাড়াতে পারছেন না তাঁরা। দেশের বড় বিপণিবিতানগুলোতে উচ্চমূল্যে বিদেশি কৃত্রিম অলংকার বিক্রি হয়। আর ভাকুর্তায় তৈরি অলংকার বিক্রি হয় শুধু পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে। ফলে দাম নিয়ে দর–কষাকষির সুযোগও সীমিত।
পাশে দাঁড়িয়েছে এসএমই ফাউন্ডেশন
হাতে তৈরি অলংকারের বাজার বড় করতে ভাকুর্তার গয়নাশিল্প এলাকাকে ক্লাস্টার বা বিশেষ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে এসএমই ফাউন্ডেশন। সেখানকার সমস্যা জানতে ও রপ্তানির সম্ভাবনা যাচাইয়ে গত ২৬ জানুয়ারি অঞ্চলটি পরিদর্শনে যান এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মাসুদুর রহমান। ওই সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মফিজুর রহমান, মহাব্যবস্থাপক ফারজানা খান, পরিচালক মির্জা নুরুল গণী ও ফ্যাশন হাউস কে–ক্র্যাফটের স্বত্বাধিকারী খালিদ মাহমুদ খান প্রমুখ।
অঞ্চলটি পরিদর্শনকালে মাসুদুর রহমান বলেন, দেশের বাজারে ভাকুর্তার গয়না নির্মাতাদের পণ্যের চাহিদা আছে। এ পণ্যের বাজার বাড়াতে এখনই তাঁদের সমস্যাগুলো দূর করা প্রয়োজন। সমস্যাগুলো দূর হলে কয়েক বছরের মধ্যে এখানকার অলংকার রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এ জন্য তাঁদের অসুবিধাগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরা হবে।
মফিজুর রহমান বলেন, ‘ঢাকার কাছের শতবর্ষের পুরোনো সম্ভাবনাময় এ অলংকারশিল্প এলাকাটি একপ্রকার আলোচনার বাইরেই রয়ে গেছে। এখানে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ালে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। এ শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এখানকার ব্যবসায়ীদের আমরা প্রশিক্ষণ দেব। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা যাতে স্বল্প সুদে ঋণ পেতে পারেন, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।’