সনদ না নেওয়ায় জরিমানা বিদেশি জাহাজের প্রতিনিধিকে, ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা

দুই বছর আগের নতুন আইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে ‘অব্যাহতি সনদ’ না নেওয়ায় একটি বিদেশি জাহাজের প্রতিনিধিকে জরিমানা করেছে নৌ বাণিজ্য দপ্তর। এই জরিমানা নিয়ে এখন শিপিং খাতে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।

আইন মেনে গত মঙ্গলবার এ জরিমানা করা হলেও বিষয়টি বাংলাদেশের আমদানিকারক ও শিপিং এজেন্টদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। কারণ, সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন যেভাবে হয়, তাতে বিদেশের বন্দরে পণ্যবোঝাইয়ের নির্ধারিত ১৫ দিন আগে সনদ নেওয়া প্রায় অসম্ভব বলে জানিয়েছেন শিপিং এজেন্ট ও আমদানিকারকেরা। এ হিসেবে যেসব বিদেশি জাহাজে পণ্য আমদানি হয়, সেগুলোর সিংহভাগ জাহাজের প্রতিটিকেই জরিমানা গুনতে হবে।

যে জাহাজটির জরিমানা করা হয়েছে, সেটি হলো ‘এমভি বিবিসি পেরু’। ‘এন্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা’র পতাকাবাহী জাহাজটি পরিচালনা করছে জার্মানির বিবিসি চার্টারিং কোম্পানি। এ জাহাজে করে ইউরোপের বন্দর বেলজিয়ামের এন্টওয়ার্প থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশের মোংলা দিয়ে পণ্য আমদানি করা হয়েছিল।

বেলজিয়ামের বন্দরে জাহাজটিতে পণ্য বোঝাই করার সময় সেখানে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ছিল না। তাতে নতুন আইন অনুযায়ী, নৌ বাণিজ্য দপ্তর থেকে পণ্য বোঝাই করার ১৫ দিন আগে অব্যাহতির সনদ নিতে হবে। তবে মোংলা বন্দরে জাহাজটি পৌঁছানোর তিন দিন আগে অব্যাহতি সনদ নেওয়ার জন্য আবেদন করে জাহাজটির স্থানীয় প্রতিনিধি কনভেয়র শিপিং লাইনস। এ জন্য আড়াই হাজার টাকা ফি জমা দেওয়া হয়। আবার জাহাজটি ছাড়পত্র পেয়ে তিন মাস আগে মোংলা বন্দর ছেড়ে যায়। এরপরও জাহাজটির দেশীয় এজেন্ট কনভেয়র শিপিং লাইনসকে জরিমানা করেছে নৌ বাণিজ্য দপ্তর।

জানতে চাইলে নৌ বাণিজ্য দপ্তরের মুখ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি জাহাজে পণ্যবোঝাইয়ের নির্ধারিত সময়ের আগে অব্যাহতি সনদ না নেওয়ায় আইন অনুযায়ী এ জরিমানা করা হয়েছে।

আইনে জাহাজমালিক বা পণ্য ভাড়াকারীর ওপর জরিমানা আরোপ করার কথা থাকলেও শিপিং এজেন্টকে জরিমানার বিষয়ে তিনি বলেন, শিপিং এজেন্ট হলো জাহাজের প্রতিনিধি। ফলে শিপিং এজেন্ট এ জরিমানা পরে জাহাজমালিক বা পরিচালনাকারী বা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আদায় করে নিতে পারবে।

কেন অসম্ভব বলছেন ব্যবসায়ীরা

বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থ সুরক্ষা) আইন, ২০১৯–এর তিন ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্যে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ পণ্য দেশীয় জাহাজে পরিবহন করতে হবে। তবে বাংলাদেশি জাহাজ পাওয়া না গেলে বিদেশি জাহাজে পণ্যবোঝাইয়ের ১৫ কার্যদিবস আগে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে অব্যাহতির সনদ নিতে হবে।

নৌ বাণিজ্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ রয়েছে ৮০টি। শুধু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত অর্থবছরে চার হাজার জাহাজে পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। বাংলাদেশি জাহাজের ১০ শতাংশও পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা নেই। ফলে আইন অনুযায়ী, সিংহভাগ জাহাজকেই অব্যাহতি সনদ নিতে হচ্ছে। আইনে থাকলেও বাস্তবে ১৫ কার্যদিবস বা কমবেশি ১৭-১৯ দিন আগে অব্যাহতি সনদ নেওয়া প্রায় অসম্ভব বলে মনে করেন শিপিং এজেন্ট ও আমদানিকারকেরা।

দুই বছর আগে আইন হলেও তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করেনি নৌ বাণিজ্য দপ্তর। এখন হঠাৎই আইন বাস্তবায়নের কারণে আমদানিকারকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শিপিং এজেন্ট নৌ বাণিজ্য দপ্তরে চিঠি দিয়ে আইন কেন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, তা তুলে ধরেছে। আইন সংশোধনের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।

শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, কোন জাহাজে পণ্য বোঝাই করা হবে, তা নির্ধারণ হয় এক থেকে চার-পাঁচ দিন আগে। সে ক্ষেত্রে ১৫ কার্যদিবস বা ১৭ থেকে ১৯ দিন আগে সুনির্দিষ্ট করে কোনো জাহাজের নাম বলা অসম্ভব। শিপিং সম্পর্কে যাঁদের ন্যূনতম জানাশোনা আছে, তাঁরা বিষয়টি জানেন। আইন যদি মানতে হয়, তাহলে ১৭ থেকে ১৯ দিন আগে জাহাজ ভাড়া করে রাখতে হবে। তাতে পণ্যের দামের চেয়ে জাহাজভাড়াই বেশি দিতে হবে।

বাংলাদেশে আমদানিপ্রক্রিয়া তুলে ধরে তিনি বলেন, সাধারণত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি হয় বাংলাদেশের বন্দর পর্যন্ত ভাড়া হিসাব করে। এ ক্ষেত্রে বিদেশের রপ্তানিকারকেরা জাহাজ ভাড়া করেন। এতে হাত নেই বাংলাদেশের আমদানিকারকদের। আবার জাহাজে পণ্যবোঝাইয়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হয় কয়েক দিন আগে। ১৫ দিন আগে জাহাজ ভাড়া করার নজির পাওয়া কঠিন। তাহলে ১৫ দিন আগে কীভাবে বলা সম্ভব, কোন জাহাজে পণ্য বোঝাই করা হচ্ছে? সনদ নেওয়া তো পরের কথা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের হার অনুযায়ী দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা খুব নগণ্য। সক্ষমতা অর্জনের পর এ নিয়ম বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ১৫ দিন আগে অব্যাহতি সনদ নেওয়া বাস্তবসম্মত নয়।’