সূচক নাকি পিই রেশিও, কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ

প্রতীকী ছবি
সংগৃহীত

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে সূচক দেখবেন নাকি কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) দেখবেন? বিতর্ক এখন বাজারজুড়ে। একদল বলছে, সূচক দেখে বাজার সম্পর্কে মন্তব্য করা উচিত নয়। বাজার সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে দেখতে হবে কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত। আরেক দল সূচককে বিবেচনায় নিয়ে নানা মন্তব্য করছে। এ কারণে বাজারে এখন সূচক ও পিই রেশিওর আলোচনা জমজমাট।
চলুন তবে জেনে নিই সূচক কী। কেন বাড়ে সেটি। সূচকের বৃদ্ধি কী ইঙ্গিত দেয়। আবার পিই রেশিও বা মূল্য আয় অনুপাত কী? কেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মূল্য আয়ের অনুপাত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শেয়ারবাজারে বেশ কয়েকটি সূচক আছে। এর মধ্যে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) রয়েছে তিনটি সূচক। এগুলো হলো প্রধান সূচক ডিএসইএক্স, শরিয়াহভিত্তিক সূচক ডিএসইএস ও বাছাই করা ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক। এর মধ্যে ডিএসইএক্স সূচকটি সামগ্রিকভাবে বাজারের চিত্র প্রকাশ করে। বাকি দুটি সূচক নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির দামের উত্থান-পতনের বার্তা প্রকাশ করে। অর্থাৎ একেকটি সূচকের বার্তা একেক রকম।

সূচক কি সঠিক বার্তা দেয়

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি রয়েছে ৩৪৩টি। এর মধ্যে প্রধান সূচক ডিএসইএক্সে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৩০৯টি কোম্পানি। বাকি ৩৪টি কোম্পানি এখনো সূচক গণনার হিসাবের বাইরে রয়েছে। ডিএসইএক্স সূচক গণনায় যে ৩০৯টি কোম্পানিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়, সেগুলোর সব শেয়ারকে আবার দৈনন্দিন সূচকের হিসাবে ধরা হয় না। দৈনন্দিন সূচক গণনায় হিসাবে ধরা হয় কেবল শেয়ারের লেনদেনযোগ্য অংশকে। এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, লেনদেনযোগ্য শেয়ার আবার কী? সব শেয়ারই তো লেনদেনযোগ্য। এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে সব শেয়ার লেনদেনযোগ্য শেয়ার হলেও সূচক গণনায় সব শেয়ারকে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। একটি কোম্পানির মোট শেয়ারসংখ্যা থেকে উদ্যোক্তা-পরিচালক, সরকার, কৌশলগত বিনিয়োগকারী এবং ৫ শতাংশ বা তার বেশি শেয়ারধারীর হাতে থাকা শেয়ার বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট যে শেয়ার থাকে, সেগুলোকেই কেবল দৈনন্দিন সূচক গণনায় হিসাবে ধরা হয়। তাতে যে কোম্পানির লেনদেনযোগ্য শেয়ার যত বেশি, সূচকে তার প্রভাবও তত বেশি।

ধরা যাক, কোম্পানি ‘এ’। তার মোট শেয়ারসংখ্যা ১০০। এর মধ্যে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে আছে ৪০টি, সরকারের হাতে রয়েছে ১৫টি, কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ১০টি এবং ৫ শতাংশের বেশি শেয়ারধারীর হাতে আছে ৫টি শেয়ার। সব মিলিয়ে এ চার শ্রেণির হাতে রয়েছে ৭০টি শেয়ার। কোম্পানির ১০০ শেয়ারের মধ্যে বাকি ৩০টি শেয়ার। এ ৩০ শেয়ারকে লেনদেনযোগ্য শেয়ার হিসেবে দৈনন্দিন সূচক গণনায় হিসাবে নেওয়া হয়। এবার ধরা যাক, এ কোম্পানির শেয়ারের দাম ১০ টাকা বেড়েছে। শেয়ারের দামের এ উত্থানকে লেনদেনযোগ্য শেয়ার (৩০টি) দিয়ে গুণ করে প্রাপ্ত যোগফল সূচক গণনায় হিসাব করা হয়। অর্থাৎ শেয়ারের পরিমাণ যতই হোক, সূচক প্রভাবিত করে লেনদেনযোগ্য শেয়ার।

সূচক গণনার এ হিসাবের কারণে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির শেয়ারের উত্থান-পতনের যথাযথ তথ্য সূচক দেখে পাওয়া যাবে না। এ কারণে অনেক সময় দেখা যায়, অধিকাংশ শেয়ারের দাম কমার পরও সূচক বেশ ঊর্ধ্বমুখী। একইভাবে অধিকাংশ শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির পরও সূচক বেশ নিম্নমুখী। বেশির ভাগ শেয়ারের দাম কমার পরও যখন সূচক ঊর্ধ্বমুখী থাকে, তখন বুঝতে হবে সূচকে যেসব কোম্পানির প্রভাব বেশি, সেসব কোম্পানির দর বেড়েছে। যে কারণে বেশির ভাগ শেয়ারের দরপতনের পরও সূচক ঊর্ধ্বমুখী ছিল। একইভাবে বেশির ভাগ কোম্পানির মূল্যবৃদ্ধির পরও সূচকে বেশি প্রভাব ফেলে, এ রকম কোম্পানির শেয়ারের দরপতনে সূচকও বেশ কমে যেতে পারে। তাই শুধু সূচক দেখে বাজারের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। তাই শুধু সূচক দেখে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত আপনাকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে। সূচক বাজারের একটি নির্দেশক বটে, তবে একমাত্র নির্দেশক নয়। এ কারণে বাজারে বিনিয়োগের আগে অন্য নির্দেশকগুলোকেও বিবেচনায় নিতে হবে।

পিই রেশিও কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সূচকের বাইরে বিবেচনাযোগ্য আরেক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক ‘মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও’। এটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে জেনে নিন মূল্য আয় অনুপাতের মানে কী। শেয়ারবাজারের একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম এবং ওই কোম্পানির আয়ের অনুপাতের তুলনাটিই পিই রেশিও হিসেবে পরিচিত। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো বছরে চারবার আয়ের হিসাব প্রকাশ করে। এর মধ্যে বার্ষিক আয়ের হিসাবটিই একমাত্র নিরীক্ষিত। বাকি তিনটি আর্থিক প্রতিবেদন সাধারণত অনিরীক্ষিত থাকে। এসব আর্থিক প্রতিবেদন ও আয়ের ভিত্তিতে কোম্পানির পিই রেশিওর পরিবর্তন ঘটে। সাধারণভাবে পুঁজিবাজার বিশ্লেষকেরা বলে থাকেন, যে কোম্পানির পিই রেশিও যত কম, সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগে ঝুঁকিও তত কম। এ কারণে যেকোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের ওই কোম্পানির পিই রেশিও খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা।

শেয়ারবাজারে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের অনেকে ঋণসুবিধাও নিয়ে থাকেন। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রেও ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো পিই রেশিও বিবেচনায় নেয়। সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, কোনো কোম্পানির পিই রেশিও ৪০ বা তার বেশি হলে ওই কোম্পানির শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে ঋণসুবিধা পাওয়া যায় না।
আসুন, এবার জেনে নিই কীভাবে পিই রেশিও হিসাব করা হয়। ধরা যাক, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ‘এ’ কোম্পানির আর্থিক বছর শেষ হয়েছে। বছর শেষে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস দাঁড়িয়েছে ৫ টাকায়। বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৫০ টাকা। তাহলে কোম্পানিটির পিই রেশিও দাঁড়াবে ১০-এ। অর্থাৎ একটি কোম্পানির শেয়ারের দামকে ওই কোম্পানির ইপিএস দিয়ে ভাগ করে যে ভাগফল পাওয়া যায়, তা-ই কোম্পানিটির পিই রেশিও।

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পিই রেশিও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক সূচক। তবে আমাদের শেয়ারবাজারে অনেক কোম্পানির ক্ষেত্রে পিই রেশিওর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। কারণ, যে ইপিএসের ভিত্তিতে পিই রেশিও হিসাব করা হয়, বেশির ভাগ কোম্পানির ক্ষেত্রে সেই ইপিএসের বিশ্বাসযোগ্যতা বড় বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। তাই সূচক হোক বা পিই রেশিও—শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ এ দুই নির্দেশকের কোনোটিই পরিপূর্ণ, নির্ভুল ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের আগে দেখতে হবে আরও অনেক কিছু।