আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত সম্পত্তি প্রদর্শন না করলে আছে বিপদ

অনেকে বুঝে না–বুঝে নিজের বৈধ সম্পত্তি আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকেন। বর্তমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আগের থেকে অনেক শক্তিশালী হচ্ছে এবং অনেক অথরিটির সঙ্গে ডেটাবেইস বিনিময় করছে। যেমন জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ইত্যাদি।

ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে, গাড়ি আছে, কিন্তু আয়কর ফাইলে নেই। সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেছেন; হয়তো দেখাননি বা কম দেখিয়েছেন। একাধিক ফ্ল্যাট আছে, হয়তো কোনোটি বাদ পড়েছে। এখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিভিন্ন অথরিটির ডেটাবেইস নিয়ে আয়কর নথির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা শুরু হয়েছে। এটা কত বড় ক্ষতির কারণ, তা বুঝতে পারেন যখন বৈধ সম্পত্তি থেকে কোনো আয় করেন বা বিক্রি করে অন্য কোনো বৈধ কাজ করতে যান। যদি সার্ভে করে আপনার অপ্রদর্শিত সম্পত্তি পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে জরিমানাসহ ক্ষেত্রবিশেষে জেলও হতে পারে।

বৈধ সম্পত্তি অর্জিত বছরে আয়কর রিটার্নে না দেখালে সেটা অনেকটা অবৈধ সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়ে যায়, যেটাকে আমরা অফিশিয়াল ভাষায় বলি অপ্রদর্শিত সম্পত্তি।
চলতি বছরের অর্থ আইনে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪–এর ১৯ ধারায়-১৯ অঅঅঅ নামে একটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছে (সূত্র: আয়কর পরিপত্র-২০২১-২০২২)। ওই ধারায় অপ্রদর্শিত সম্পত্তি প্রদর্শন করার জন্য কতিপয় সুযোগ রয়েছে। এতে করদাতা আগের যেকোনো সময়ে আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত সম্পত্তি (জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট, নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ইত্যাদি) নির্ধারিত হারে কর পরিশোধ করে এ বছর আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করতে পারবেন। এ সুযোগ সম্পত্তির এলাকা বা অবস্থানভেদে কিছুটা তারতম্য আছে। যেমন:

১. জমি বা ভূমির ক্ষেত্রে

ক) ঢাকার গুলশান মডেল টাউন, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও দিলকুশা এলাকার ভূমির জন্য প্রতি বর্গমিটারে ২০ হাজার টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

খ) ঢাকার ধানমন্ডি এলাকা, ডিওএইচএস মহাখালী, লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি, উত্তরা মডেল টাউন, পূর্বাচল, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, সিদ্ধেশ্বরী, কারওয়ান বাজার, বিজয়নগর, ওয়ারী, সেগুনবাগিচা, নিকুঞ্জ এবং চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ, খুলশী, আগ্রাবাদ, নাছিরাবাদ এলাকায় অবস্থিত ভূমির জন্য প্রতি বর্গমিটারে ১৫ হাজার ৫০০ টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

গ) উপরিউক্ত ‘ক’ এবং ‘খ’ ক্রমিকে উল্লেখ করা এলাকা ব্যতীত সব সিটি করপোরেশন এলাকার ভূমির জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৫ হাজার টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

ঘ) সব পৌরসভা বা জেলা সদর এলাকায় অবস্থিত ভূমির জন্য প্রতি বর্গমিটারে ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং এর ওপর নির্ধারিত ৫ শতাংশ অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

ঙ) উপরিউক্ত ক্রমিক নম্বর ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ এবং ‘ঘ’-তে উল্লেখ করা এলাকার ভূমি ব্যতীত অন্য সব এলাকায় অবস্থিত ভূমির জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৫০০ টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

২. বিল্ডিং ও অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে

ক) ঢাকার গুলশান মডেল টাউন, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত অনধিক ২০০ বর্গমিটার প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৪ হাজার টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

খ) ঢাকার গুলশান মডেল টাউন, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত ২০০ বর্গমিটারের অধিক প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৬ হাজার টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

গ) ঢাকার ধানমন্ডি এলাকা, ডিওএইচএস মহাখালী, লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি, উত্তরা মডেল টাউন, পূর্বাচল, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, সিদ্ধেশ্বরী, কারওয়ান বাজার, বিজয়নগর, ওয়ারী, সেগুনবাগিচা, নিকুঞ্জ এবং চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ, খুলশী, আগ্রাবাদ, নাছিরাবাদ এলাকায় অবস্থিত প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৩ হাজার টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

ঘ) ঢাকার ধানমন্ডি এলাকা, ডিওএইচএস মহাখালী, লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি, উত্তরা মডেল টাউন, পূর্বাচল, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, সিদ্ধেশ্বরী, কারওয়ান বাজার, বিজয়নগর, ওয়ারী, সেগুনবাগিচা, নিকুঞ্জ এবং চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ, খুলশী, আগ্রাবাদ, নাছিরাবাদ এলাকায় অবস্থিত ২০০ বর্গমিটারের অধিক প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

ঙ) উপরিউক্ত ক্রমিকে উল্লেখ করা ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ এবং ‘ঘ’ এলাকা ব্যতীত সিটি করপোরেশন এলাকায় অনধিক ১২০ বর্গমিটারের প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য ৭০০ টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

চ) উপরিউক্ত ক্রমিকে উল্লেখিত ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ এবং ‘ঘ’ এলাকা ব্যতীত সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত ১২০ বর্গমিটার, তবে অনধিক ২০০ বর্গমিটারের প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য ৮৫০ টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

ছ) উপরিউক্ত ক্রমিকে উল্লেখিত ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ এবং ‘ঘ’ এলাকা ব্যতীত সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত ২০০ বর্গমিটারের অধিক প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতি বর্গমিটারের জন্য ১ হাজার তিন ৩০০ টাকা এবং এ করের ওপর ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করা;

জ) কোনো জেলা সদরের পৌরসভা এলাকায় অবস্থিত অনধিক ১২০ বর্গমিটারের অধিক প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৩০০ টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

ঝ) কোনো জেলা সদরের পৌরসভা এলাকায় অবস্থিত ১২০ বর্গমিটারের অধিক তবে অনধিক ২০০ বর্গমিটারের প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৪৫০ টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

ঞ) কোনো জেলা সদরের পৌরসভা এলাকায় অবস্থিত ২০০ বর্গমিটারের অধিক প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৬০০ টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

ট) ক্রমিক নম্বর ‘ক থেকে ঞ’ পর্যন্ত উল্লেখ করা এলাকা ব্যতীত অন্য যেকোনো এলাকায় অবস্থিত ১২০ বর্গমিটারের প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ২০০ টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

ঠ) ক্রমিক নম্বর ‘ক থেকে ঞ’ পর্যন্ত উল্লেখ করা এলাকা ব্যতীত অন্য যেকোনো এলাকায় অবস্থিত ১২০ বর্গমিটার, কিন্তু অনধিক ২০০ বর্গমিটারের প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৩০০ টাকা এবং এ করের ওপর ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করা;

ড) ক্রমিক নম্বর ‘ক থেকে ঞ’ পর্যন্ত উল্লেখ করা এলাকা ব্যতীত অন্য যেকোনো এলাকায় অবস্থিত ২০০ বর্গমিটারের অধিক প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৫০০ টাকা এবং ওই পরিশোধযোগ্য অঙ্কের ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার মাধ্যমে;

৩. অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে

ক) নগদ, ব্যাংকে রক্ষিত অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইন্সট্রুমেন্ট, সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিট, সেভিং ইন্সট্রুমেন্ট বা সার্টিফিকেট (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্টক, স্টক শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট ও অন্যান্য সিকিউরিটিজ, পুঁজিবাজারে ক্রয়–বিক্রয়যোগ্য সব ধরনের সিকিউরিটিজ ও বন্ড এবং যেকোনো ধরনের অগ্রিম ও ঋণ প্রদান আর্থিক ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে প্রদর্শন করা যাবে)। এর মোট মূল্যের ওপর নির্ধারিত কর ২৫ শতাংশ এবং পরিশোধযোগ্য করের ওপর অতিরিক্ত ৫ শতাংশ হারে কর পরিশোধ করার মাধ্যমে।

উপরিউক্ত ক্ষেত্রগুলোর আওতায় কর পরিশোধ করার ফলে করদাতার অনুকূলে যেসব সুবিধা থাকবে—
ক) নগদ অর্থ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ফরমে (আইটি-১০ বি) হাতে নগদ, ব্যাংকে জমা বা ব্যবসায়ের পুঁজি হিসেবে দেখাতে পারবেন;

খ) এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত কর পরিশোধ করে সম্পত্তি প্রদর্শন করার জন্য কোনো ধরনের ঘোষণার প্রয়োজন হবে না। যথানিয়মে সংশ্লিষ্ট ফরমের নির্ধারিত কলামে সম্পত্তির নির্ধারিত মূল্য দেখানো যাবে এবং অন্যান্য প্রাপ্তির ঘরে আয়ের উৎস হিসেবে দেখানো যাবে;

গ) প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যাংক বিবরণী বা দলিলাদি বা প্রমাণাদি দাখিল করা যেতে পারে;

ঘ) এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সব কর পরিশোধ করে সম্পত্তি প্রদর্শন করলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪–এর অন্য কোনো ধারায় কোনো ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করবে না।

আপনার কষ্টে অর্জিত সম্পত্তি আয়কর রিটার্নে দেখানো থেকে বিরত থাকবেন না।

লেখক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, আয়কর আইনজীবী, নির্বাহী পরিচালক, গোল্ডেন বাংলাদেশ