অর্থ মন্ত্রণালয়–বিএফআইইউ
পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের কৌশলই ঠিক হয়নি
৭ বছরে পাচার হয়েছে ১ বছরের বাজেটের সমান অর্থ।
প্রতিবছর পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা।
প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে মাত্র ৫০ অর্থ পাচারকারীকে।
তথ্য চেয়ে ১৮ দেশে অনুরোধপত্র পাঠানো হয়েছে।
অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে।
বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও তা থেকে সরকার এক টাকাও উদ্ধার করতে পারেনি। এমনকি উদ্ধার করার কৌশলই ঠিক করতে পারেনি এখনো। তবে প্রতি মাসেই এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
ঢাকায় সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের একটি বক্তব্যে অর্থ পাচারের আলোচনা আবার সামনে আসে। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে, তার কিছুটা সত্যতা তিনি পেয়েছেন এবং পাচারকারীদের মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি।
দুদকে যোগাযোগ করা হলে সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে জানান, এ পর্যন্ত ৫০ অর্থ পাচারকারীর সন্ধান মিলেছে। এর মধ্যে ২৮ জনের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। পাচারকারীদের তথ্য পেতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), মালয়েশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ ১৮টি দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে।
দেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হচ্ছে। সরকার তা ঠেকাতে পারছে না। পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করে দেশে আনতে পারছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) সবশেষ তথ্যানুযায়ী অর্থ পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। গত ৭ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ২৭০ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসাবে)। এই অর্থ বাংলাদেশের প্রায় এক বছরের বাজেটের সমান।
জিএফআইয়ের গত মার্চে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে পাচার হয় ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার, যা দেশের ৬৪ হাজার কোটি টাকার মতো।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগও গত মাসে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করে বলেছে, সুইস ব্যাংকসহ অনেক দেশেই অর্থ পাচার হচ্ছে। এই অর্থ উদ্ধারে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে আর্থিক ও কর–সংক্রান্ত গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে মত দেয় অর্থ বিভাগ।
বৈঠকে বলা হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশ এ ব্যাপারে যেসব কৌশল অনুসরণ করে, বাংলাদেশও তা অনুসরণ করতে পারে। এ ব্যাপারে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে দুদক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), জননিরাপত্তা বিভাগ, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয়কে (আরজেএসসি) বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে মতামত দিতে বলা হয়েছে।
বৈঠকে বলা হয়, যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, সেসব দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত চুক্তি করতে হবে। প্রয়োজনে কর তথ্যবিনিময় চুক্তিও করতে হবে।
সচিব আসাদুল ইসলাম বৈঠকে বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমেই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি অর্থ পাচার হয়েছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস নামের কোম্পানির মাধ্যমে। জিএফআইয়ের প্রতিবেদন ও সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ রয়েছে।
বৈঠকে আরও বলা হয়, দুদক, বাংলাদেশ পুলিশ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা করে যাচ্ছে, বিচারকাজও চলমান। ৩৭টি অভিযোগ পেয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তদন্ত করছে। বিএসইসি কোনো মামলা করতে পারেনি। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন–সংক্রান্ত মামলার তদন্ত এবং এগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে সবাইকে তাগিদ দেওয়া হয় বৈঠকে।
এদিকে বৈঠকে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সাইবার, পর্নোগ্রাফি, জুয়া ও অনলাইন জুয়া–সংক্রান্ত অপরাধকেও মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। বিচার ও সংসদবিষয়ক বহির্বিভাগের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করবে এ ব্যাপারে।
যোগাযোগ করলে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসান সম্প্রতি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থ পাচার ঠেকাতে ও অর্থ উদ্ধারে একটা কৌশলপত্র করতে বলা হয়েছিল আমাদের। আমরা সেটা করে দিয়েছি। বাস্তবায়ন পর্যায়ে কী সমস্যা হচ্ছে, সে জন্য মতামত আসবে বলে অপেক্ষা করছি।’