তরুণেরা চাকরি না পাওয়ার কারণ কী?

চাকরিপ্রার্থীদের অবশ্যই একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, কখনো একই সিভি সব চাকরিতে দেওয়া যাবে না। চাকরির বিজ্ঞাপনের সঙ্গে মিল রেখে সিভি দেওয়াই সবচেয়ে ভালো। ছবি: প্রথম আলো
চাকরিপ্রার্থীদের অবশ্যই একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, কখনো একই সিভি সব চাকরিতে দেওয়া যাবে না। চাকরির বিজ্ঞাপনের সঙ্গে মিল রেখে সিভি দেওয়াই সবচেয়ে ভালো। ছবি: প্রথম আলো

পড়াশোনা শেষ করে চাকরির প্রতিযোগিতায় প্রতিবছর ঢুকছেন লাখ লাখ তরুণ। ঘুরেফিরে বারবার একটি কথাই বেশি শোনা যাচ্ছে, কেন চাকরি পাচ্ছেন না তরুণেরা। কোন কোন দক্ষতার অভাবে তাঁদের কাছে ধরা দিচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত চাকরি। তরুণদের নানা সমস্যা ও তাঁর সমাধান নিয়ে কথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা।

দেশের সবচেয়ে বড় চাকরির পোর্টাল বিডি জবসের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর জানান, প্রতিবছর চাকরির বাজারে প্রায় তিন লাখ তরুণ যুক্ত হচ্ছেন। এই তরুণদের জন্য চাকরির বাজার বাড়ছে না। সম্প্রতি কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের নিয়োগ কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হয়তো পদ আছে ১৫ থেকে ২০টি। কিন্তু তাতে সিভি জমা পড়ছে এক লাখ থেকে দেড় লাখ।

ফাহিম মাশরু বলেন, চাকরির বাজারে তরুণদের দক্ষতা নিয়ে একটি প্রশ্ন উঠছে। তরুণদের মধ্যে কেউ কেউ দক্ষতা দেখিয়ে চাকরি পেলেও একটি বড় অংশ দরকারি নানা দক্ষতার অভাবে চাকরি পাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব সিভি জমা পড়ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে তরুণেরা প্রত্যাশিত বেতনের অংশে বড় অঙ্কের টাকা দাবি করে বসছেন। কিন্তু চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের হয়তো ওই পদের জন্য সে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ নেই। তখন চাকরিপ্রার্থী যত ভালো যোগ্যতাসম্পন্ন হোন না কেন, তাঁর সিভি এড়িয়ে যান চাকরিদাতারা। আবার চাকরিপ্রার্থী হয়তো ভালো ফল নিয়ে পাস করেছেন, কিন্তু যখন লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়, তখন দেখা যাচ্ছে, তিনি ভালো ইংরেজি বা বাংলায় কিছু লিখতে পারছেন না। এসব কারণে তরুণেরা চাকরি পাচ্ছেন না।’

তরুণদের জন্য চাকরির পরামর্শ দিতে গিয়ে ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘আমাদের দেশের তরুণদের বেশি বেতনের চাকরির ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রথমে বেতন কম হোক, একটা চাকরিতে ঢুকে যেতে হবে। এটি করলে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কিছু একটা যোগ হয়। আর এটি দেখিয়ে আরও ভালো চাকরিতে আবেদন করতে পারেন তিনি। এভাবে নিজেকে এগিয়ে নেওয়া যায়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি যোগাযোগ দক্ষতা, ভালো ইংরেজি বা বাংলা লেখার দক্ষতা গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভিন্ন স্থানে চাকরির মেলায় অংশ নিয়ে নিজের নানা দক্ষতা বাড়িয়ে নিতে পারেন। এভাবে এগিয়ে গেলে পড়াশোনা শেষে চাকরি পাওয়া সহজ হবে।’

তরুণদের নানা ধরনের দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেন করপোরেট কোচের মুখ্য পরামর্শক ও মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ যিশু তরফদার। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা সব সময় তরুণদের কাজে আসছে না। যেসব তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বা দর্শন পড়ছেন, তাঁরা পড়াশোনা শেষে সাহিত্য সমালোচক বা দার্শনিক হচ্ছেন না। চাকরির পড়াশোনা করে কেউ কেউ চাকরি পেলেও একটি বড় অংশ চাকরি পাচ্ছে না। এই তরুণেরা যদি পড়াশোনার পাশাপাশি কম্পিউটারের বিভিন্ন দক্ষতা, ভিডিও এডিটিং, ফটোগ্রাফি, নানা বিষয়ে স্বল্পমেয়াদি কোর্স করেন, তাহলে পড়াশোনা শেষে এসব দক্ষতা দেখিয়ে চাকরি নিতে পারেন। এসব দক্ষতাই তাঁকে আর দশজন থেকে এগিয়ে রাখবে। এ দেশের প্রচলিত পড়াশোনা করে তরুণেরা চাকরি না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি।

তরুণদের জন্য চাকরির বাজার বাড়ছে না। তবে প্রতিবছর হাজারো চাকরিপ্রত্যাশী তরুণের মধ্যে কেউ কেউ দক্ষতা দেখিয়ে চাকরি পেলেও একটি বড় অংশ দরকারি নানা দক্ষতার অভাবে চাকরি পাচ্ছে না। প্রথম আলো ফাইল ছবি।
তরুণদের জন্য চাকরির বাজার বাড়ছে না। তবে প্রতিবছর হাজারো চাকরিপ্রত্যাশী তরুণের মধ্যে কেউ কেউ দক্ষতা দেখিয়ে চাকরি পেলেও একটি বড় অংশ দরকারি নানা দক্ষতার অভাবে চাকরি পাচ্ছে না। প্রথম আলো ফাইল ছবি।

যিশু তরফদার বলেন, তরুণেরা যদি কারিগরি শিক্ষায় নিজেদের শিক্ষিত করে একটি ডিপ্লোমা কোর্স করেন, পাশাপাশি ইংরেজি দক্ষতা, যেমন আইইএলটিএস পরীক্ষা দিয়ে মোটামুটি মানের একটা স্কোর করেন, তাহলে অনায়াসেই বিদেশে ভালো চাকরি জুটিয়ে নিতে পারেন। এমনকি এসব চাকরি নিয়ে অন্য দেশের নাগরিকত্বও নিতে পারবেন। যে সময় এসব শিক্ষা নিয়ে তিনি এগিয়ে যাবেন, সেই সময় হয়তো তাঁর আরেক বন্ধু চাকরিই পাচ্ছেন না। শিক্ষাজীবনকে তারুণ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বিবেচনা করে যিশু তরফদার বলেন, এই সময় একজন তরুণ যতটা নিজেকে এগিয়ে নিতে পারবেন, অন্য সময় ততটা পারবেন না। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি নানা ধরনের সফট স্কিল, যেমন: যোগাযোগ দক্ষতা, নেতৃত্বের গুণাবলি, ভালো কথা বলা, লেখা—এসব দক্ষতা অর্জন করেন, তাহলে চাকরি পেতে তাঁর সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

তরুণদের নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি)। সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট এজাজ আহমেদ বলেন, দেশে যে পরিমাণ পাস করা তরুণ প্রতিবছর বের হচ্ছেন, চাকরি সে পরিমাণ নেই। সে জন্য বেকারের পরিমাণ বাড়ছেই। বিশ্ববিদ্যালয় একজন তরুণকে একাডেমিক পড়াশোনার শিক্ষা দিচ্ছে, কিন্তু চাকরিতে কীভাবে আবেদন করবেন বা কোনো কোনো দক্ষতা অর্জন করলে তরুণদের চাকরি পাওয়া সহজ হবে, সে শিক্ষা দিচ্ছে না। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি তরুণদের নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তরুণদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তারা ৮০টি চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা বলেছে, তারা যে ধরনের চাকরিপ্রার্থী খুঁজছে, তা পাচ্ছে না। চাকরির আবেদনকারীদের মধ্যে তারা নানা দক্ষতার ঘাটতি দেখছে। ভালো বলতে পারা, লিখতে পারার দক্ষতার অভাব দেখছে তারা। তারা চায় উদ্যমী আর চৌকস তরুণ, যে তরুণকে কাজ করার কথা বলতে হবে না। নিজেই নিজের উদ্যোগে উদ্ভাবনী দক্ষতায় কাজ করবেন—এমন তরুণদের চাকরি দিতে চায় তারা।

ভবিষ্যতে চাকরির বাজার আরও কঠিন হবে বলে মনে করেন এজাজ আহমেদ। তিনি বলেন, বর্তমানে অনেক সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে, যা মানুষের কাজ কমিয়ে দিয়েছে। মানবসম্পদ বিভাগে আগে অফিসের কর্মীদের যাওয়া-আসা, ছুটি নেওয়া, সময় ব্যবস্থাপনা দেখভাল করার জন্য আলাদা কর্মী নিয়োগ দেওয়া থাকত। কিন্তু এখন সফটওয়্যারের মাধ্যমে এ কাজ কম্পিউটারে করা সম্ভব হচ্ছে। হিসাব বিভাগের অনেক কাজ সফটওয়্যারে সম্পন্ন করা হচ্ছে। এভাবে চাকরির বাজারে কর্মীর সংখ্যা কমছে। তাই সামনের দিনগুলোতে চাকরি পেতে তরুণদের এমন হতে হবে, যা অন্যদের থেকে তাঁকে আলাদা করে। উদ্ভাবনী শক্তি বা সমস্যা সমাধানের জন্য এমনভাবে দক্ষ হতে হবে, যা দেখে চাকরিদাতারা তাঁকে চাকরি দেবে। নিজেদের সময়ের সঙ্গে গড়ে তুলতে পারলেই চাকরি দেখা পাবেন তরুণেরা।

চাকরিদাতা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তরুণদের মধ্যে একটি সহজাত প্রবণতা দেখা গেছে, তা হলো তাঁরা সিভি কপি পেস্ট করেন। এমন কমন সিভি চাকরিদাতারা দেখলেই বোঝেন। সে জন্য তাঁরা চাকরির ডাক পান না। চাকরিদাতাদের নজরে আসতে হলে ব্যতিক্রম সিভি দিতে হবে। এ ছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, চাকরি প্রার্থীরা যে ই–মেইল ঠিকানা ব্যবহার করেন, তা হয়তো তাঁর ডাকনাম বা সাংকেতিক কিছু যেমন, ‘লিটু’, ‘ক্লেভার বয়’, ‘ভুত’—এসব নাম ব্যবহার করা। এগুলো দেখে চাকরিদাতারা চাকরিপ্রার্থী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা নেন, যা চাকরি পেতে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এ জন্য ফরমাল নাম ব্যবহার করে ই–মেইল ঠিকানা দিতে হবে।

চাকরির ক্ষেত্রে জীবনবৃত্তান্তে যে তথ্য দরকার নেই, সে তথ্য জুড়ে দেন অনেকেই। প্রথম আলো ফাইল ছবি।
চাকরির ক্ষেত্রে জীবনবৃত্তান্তে যে তথ্য দরকার নেই, সে তথ্য জুড়ে দেন অনেকেই। প্রথম আলো ফাইল ছবি।

এসিআই লিমিটেডে মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক মঈনুল ইসলাম তরুণদের উদ্দেশে বলেন, চাকরির বিজ্ঞাপনের সঙ্গে মিল রেখে সিভি পাঠান। চাকরিপ্রার্থীদের অবশ্যই একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, কখনো একই সিভি সব চাকরিতে দেওয়া যাবে না। চাকরির বিজ্ঞাপনের সঙ্গে মিল রেখে সিভি দেওয়াই সবচেয়ে ভালো। মূলত, চাকরির বর্ণনা দেখেই সিভি দিতে হবে।

মঈনুল ইসলাম বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই নতুন প্রার্থীরা একটি সাধারণ ভুল করছেন। তা হলো জীবনবৃত্তান্তে যে তথ্য দরকার নেই, সে তথ্য জুড়ে দিচ্ছেন। দরকার নেই বা প্রাসঙ্গিক নয়—এমন অভিজ্ঞতা লেখা ঠিক নয়। যে চাকরির জন্য আবেদন করছেন, কেবল তার জন্য উপযুক্ত, এমন অভিজ্ঞতা উল্লেখ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এ ছাড়া জীবনবৃত্তান্তে রেফারেন্স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকে এমন রেফারেন্স দেন যে যাঁকে ফোন করলে বা যোগাযোগ করলে দেখা যায়, আবেদনকারীকে তিনি চিনছেন না। এ ক্ষেত্রে চাকরিদাতারা ওই প্রার্থী সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। জীবনবৃত্তান্তে ছোট ছোট ভুলের কারণে চাকরিদাতারা প্রার্থীর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন।

মঈনুল ইসলাম বলেন, নতুন চাকরিপ্রার্থীরা সাধারণত তাঁদের প্রাথমিক তথ্যগুলো সিভিতে উল্লেখ করবেন। যে চাকরির আবেদন করছেন, তার সঙ্গে মিলিয়ে কোনো কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে তা উল্লেখ করবেন। এ ছাড়া তিনি শিক্ষাজীবনে কোনো প্রজেক্ট করে থাকলে তা উল্লেখ করতে পারেন। ইন্টার্নের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে পারেন। ভালো প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্ন করা থাকলে অনেক সময় ভালো চাকরির সুযোগ তৈরি হয়। মনে রাখতে হবে, সিভি লেখাও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিযোগিতা। যাঁর সিভি যত ভালো হবে, চাকরির বাজারের প্রতিযোগিতায় তিনি তত এগিয়ে থাকবেন।


আরও পড়ুন