চাকরির দুনিয়ার অতীত ও আগামী

গত এক দশকে কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়েছে। সামনের দিনগুলোতে বাড়বে আরও। মডেল: আমিন ও দীপিকা। ছবি: সুমন ইউসুফ, গ্রাফিকস: প্র স্টুডিও
গত এক দশকে কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়েছে। সামনের দিনগুলোতে বাড়বে আরও। মডেল: আমিন ও দীপিকা। ছবি: সুমন ইউসুফ, গ্রাফিকস: প্র স্টুডিও
গত এক দশকে কর্মক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন এসেছে। এসেছে নতুন কাজের সুযোগ, আবার হারিয়ে গেছে অনেক পেশা। বর্তমান দশকেও যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। পুরোনো দশক পর্যবেক্ষণ করে সামনের দিনগুলোর জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবে তরুণ প্রজন্ম?

গত এক দশকে (২০১০-১৯) ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে চাকরির বাজারে। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র। একই সঙ্গে কিছু কিছু পেশা হারিয়েও গেছে। আবার আসন্ন নতুন দশকেও (২০২০-২৯) কর্মক্ষেত্রে আসবে পরিবর্তনের হাওয়া। গত দশক ও বর্তমান দশকের চাকরির বাজারের হালচাল নিয়ে ‘স্বপ্ন নিয়ে’র সঙ্গে কথা বলেছেন বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী এ কে এম ফাহিম মাশরুর

২০১০-২০১৯ 

● প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি

● ডিজিটাল মার্কেটিয়ার নামে নতুন পেশার সংযোজন

● গ্রাফিকস ডিজাইনার, অ্যানিমেটর, ভিডিও কনটেন্ট মেকার বা আলোকচিত্রীদের চাহিদা বেড়েছে

● জনপ্রিয়তা পেয়েছে আউটসোর্সিং

● ই-কমার্স বা এফ-কমার্স কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন অনেকে

● রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে আয়ের সুযোগ হয়েছে

● অ্যাপভিত্তিক সেবাদান বেড়েছে

● টাইপরাইটার, নিরাপত্তারক্ষী, ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের কাজের সুযোগ কমেছে

২০২০-২০২৯

● আরও বেশি তথ্যপ্রযুক্তিকেন্দ্রিক হবে

● তথ্য সংগ্রহের দক্ষতা থাকলেই হবে না, তথ্য বিশ্লেষণ করে কাজে লাগানোর সক্ষমতা থাকতে হবে

● তথ্য নিরাপত্তা বা সাইবার সিকিউরিটি খাতে কাজের সুযোগ বাড়তে পারে

● পরিসংখ্যান বিষয়ের চাহিদা বাড়বে

● যন্ত্র ও রোবট পরিচালনায় দক্ষ লোকবল প্রয়োজন হবে 

কী ঘটেছে গত দশকে?

গত কয়েক বছরে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে কর্মক্ষেত্রেও। ফলে প্রযুক্তিনির্ভর বেশ কিছু কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নতুন এই কাজগুলো গতানুগতিক পেশার সঙ্গে নতুন আঙ্গিকে যুক্ত হয়েছে। ধরা যাক, হিসাবরক্ষক পেশাটির কথা। আগেও যেমন এই পেশার চাহিদা ছিল, এখনো তা রয়েছে। তবে বর্তমান চাকরির বাজারে একজন হিসাবরক্ষকের শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব কিংবা বাজেট তৈরির মতো কাজগুলোয় দক্ষ হলেই হয় না, বরং হিসাবরক্ষণ–সংক্রান্ত পেশাদার সফটওয়্যারগুলো সম্পর্কেও জানতে হয়। আবার প্রকৌশলীদের কথা যদি বলি, গত এক দশকে প্রকৌশলীদের চাকরির ক্ষেত্রে অটোক্যাড সফটওয়্যারে দক্ষতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

চিরায়ত মার্কেটিং পেশার ধারণাও পাল্টে গেছে। বিপণনের গতানুগতিক মাধ্যমের মধ্যে যুক্ত হয়েছে অনলাইন মাধ্যম। ফলে ডিজিটাল মার্কেটিয়ার নামে নতুন একটি পেশার সৃষ্টি হয়েছে। কোনো একটি পণ্যের প্রচারণার জন্য গতানুগতিক মাধ্যমগুলোর বদলে বর্তমানে অনলাইন মাধ্যমকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে চাকরির বাজারে ডিজিটাল মার্কেটিয়ারের কদর এখন ব্যাপক। 

প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বর্তমানে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সরব। ফলে সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার নামেও নতুন একধরনের কাজের সূচনা ঘটেছে গেল দশকেই। প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম পেজ কিংবা ইউটিউব চ্যানেলের জন্য বিভিন্ন ধরনের পোস্ট লেখা, কনটেন্ট তৈরির কাজগুলো সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবস্থাপক) করে থাকেন।

একই সঙ্গে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে গত কয়েক বছরে গ্রাফিক ডিজাইনার, অ্যানিমেটর, ভিডিও কনটেন্ট মেকার কিংবা ফটোগ্রাফার নিয়োগ করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ১০ বছর আগেও দেশের চাকরির বাজারে এই কাজগুলোর এতটা গুরুত্ব ছিল না। 

এদিকে ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে ঘরে বসে অনেকেই হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তা। গত দশকেই আমাদের দেশে ই-কমার্স কিংবা এফ-কমার্সের ধারণা (ফেসবুক–নির্ভর ব্যবসা) পরিচিতি পেয়েছে ব্যাপকভাবে। তরুণদের অনেকেই ইন্টারনেটে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। 

এ ছাড়া ফ্রিল্যান্সিং কিংবা আউটসোর্সিং বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং অ্যাপের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে প্রাইভেট কার কিংবা মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন অনেকেই। আবার অ্যাপের কল্যাণে দেশের সাপ্লাই চেইনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। পণ্য দ্রুত পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের অ্যাপভিত্তিক সেবা এখন বেশ জনপ্রিয়। ফলে পণ্য পৌঁছে দিতে এখন অনেকেই কাজের সুযোগ পাচ্ছেন।

মোবাইল অ্যাপ আর সফটওয়্যারের ব্যবহার যখন বেড়েছে, তখন অ্যাপ ডেভেলপার, সফটওয়্যার ডেভেলপারের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া সব ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটের ব্যবহার বেড়েছে। ফলে ওয়েব ডেভেলপার, ওয়েব ডিজাইনারের কদর বেড়েছে চাকরির বাজারে। 

গেল দশকে মোবাইল ব্যাংকিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাড়ির দোরগোড়ার ব্যাংকের সুবিধা পৌঁছে দিচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট হিসেবে কাজের সুযোগ পেয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। 

দেশের গার্মেন্টস খাতে মার্চেন্ডাইজার, কোয়ালিটি কন্ট্রোলার, ফ্যাশন ডিজাইনারের মতো কাজের জায়গাগুলো আগে ছিল বিদেশি কর্মীদের দখলে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশিরাই এই খাতগুলোতে কাজ পেতে শুরু করেছেন। উন্নতি ঘটেছে ভারী শিল্প খাতেও। সিমেন্ট, কাচ, স্টিল খাত গেল দশকে ব্যাপক বিস্তৃত হয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।

নতুন কাজের সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনিভাবে বিদায় নিতে চলেছে অনেক পেশা। টাইপরাইটার, নিরাপত্তারক্ষী, ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের মতো পেশাগুলোতে কাজের সুযোগ কমে গেছে অনেকাংশে। চাকরিপ্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও গত দশকে নতুন কিছু বিষয় আমলে নিতে দেখা গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো যোগাযোগ দক্ষতা। কয়েক বছর ধরে যেকোনো ধরনের চাকরিতে যোগাযোগদক্ষতাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির পাশাপাশি মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্টসহ বিভিন্ন ধরনের মাধ্যমিক পর্যায়ের সফটওয়্যার দক্ষতাও বেশ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া একাধিক ভাষাদক্ষতা এখন আবশ্যক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি অন্য আরেকটি ভাষায় দক্ষতা কর্মক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখতে সাহায্য করছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে তরুণদের নিয়োগ দেওয়ার মানসিকতাও তৈরি হয়েছে গত এক দশকে। 

কী ঘটতে পারে এই দশকে?

চাকরির বাজারের এই দশকের পরিবর্তন নিয়ে এখনো কেউ সেভাবে পরিষ্কার নয়। তবে আগামীর চাকরিগুলো যে আরও তথ্যপ্রযুক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে, তা নিশ্চিত করে বলাই যায়। ডেটা অথবা তথ্য–উপাত্তই হচ্ছে আগামীর ভবিষ্যৎ। যেই চাকরিপ্রার্থীর কাছে কার্যকরী তথ্য থাকবে এবং সেই তথ্যকে কাজে লাগানোর সক্ষমতা যাঁর থাকবে, চাকরির বাজারে চাকরিদাতারা তাঁকেই লুফে নেবেন। 

ভবিষ্যতে শুধু প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষতা থাকলেই চলবে না, পাশাপাশি থাকতে হবে তথ্য ব্যবহারে দক্ষতা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অনলাইন মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল মার্কেটিং অনেকেই করতে পারেন। কিন্তু অনলাইন মাধ্যমে এই বিজ্ঞাপন কতজন মানুষ দেখতে পারে, কী ধরনের প্রচারণা দেখতে মানুষ পছন্দ করে, কখন দেখতে মানুষ পছন্দ করবে ইত্যাদি তথ্য বের করার উপায় যিনি জানবেন, আর এই তথ্যগুলো মার্কেটিংয়ে কাজে লাগাতে পারবেন, সেই মার্কেটিয়ার অন্যদের চেয়ে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করতে পারবেন। 

শুধু মার্কেটিং নয়, সব ধরনের কর্মক্ষেত্রেই তথ্যের গুরুত্ব বাড়বে। বর্তমানে যেকোনো চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ, তথ্য যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণের দক্ষতা আবশ্যক। শুধু চাকরি নয়, উদ্যোক্তা হতে গেলেও এ ধরনের দক্ষতার বিকল্প নেই। যেকোনো ধরনের ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তথ্য বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়বে। আবার আরেক দিকে, প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়বে, তত বেশি তথ্য তৈরি হতে থাকবে। পাশাপাশি তৈরি হবে তথ্য চুরি, অনলাইন নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ। তথ্যনিরাপত্তা কিংবা সাইবার সিকিউরিটি খাতে আগামী বছরগুলোতে ব্যাপক কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

উন্নত দেশগুলোতে ডেটা বা তথ্য নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। পড়াশোনার মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে এই বিষয়গুলো। ডেটা সায়েন্স নামে উচ্চশিক্ষার নতুন বিষয় চালু হয়েছে উন্নত দেশগুলোতে। এ ছাড়া নিঃসন্দেহে পরিসংখ্যান বিষয়ের চাহিদাও বাড়বে সামনের দিনগুলোতে। 

প্রযুক্তির কল্যাণে কলকারখানাগুলোতে ইতিমধ্যেই মানুষের বিভিন্ন কাজ বিভিন্ন যন্ত্র ও রোবট দখল করে নিয়েছে। ভবিষ্যতে এর পরিধি বাড়বে। তবে ওই যন্ত্র আর রোবটগুলোকে নির্দেশনা দিতে লোকবলের প্রয়োজন পড়বে। 

আমি মনে করি, বর্তমান দশকে পুরোনো কর্মক্ষেত্রগুলো যে একদম হারিয়ে যাবে, তা নয়, ওই কর্মক্ষেত্রগুলোই থাকবে, তবে সেগুলো ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে আরও তথ্য ও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক। 

অনুলিখন: জাওয়াদুল আলম