মেলায় মেলে অভিজ্ঞতা

মেলায় কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাতিমা,ইফতেখার পড়েন সিলেট ল কলেজে
মেলায় কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাতিমা,ইফতেখার পড়েন সিলেট ল কলেজে

 ‘২০১৮ সালের শেষের দিকে হঠাৎ করেই আব্বুর ব্রেন টিউমারের খবর শুনি। অপারেশনের বিকল্প ছিল না। আমার তখন অনার্স শেষের দিকে। বাড়ির আর্থিক অবস্থাও ভালো না। কিছু একটা করার জন্য চেষ্টা করতে করতেই বাণিজ্য মেলায় এক মাসের কাজের সুযোগ পাই।’ বলছিলেন তাশফিয়া নুভা। সে বছর বাণিজ্য মেলায় পাওয়া ১৫ হাজার টাকা আর বাবার অস্ত্রোপচারের খরচ জোগাতে সাহায্য করতে পারার আনন্দ, তাঁর জীবনের বড় পাওয়া। এসব কথা বলতে বলতে শরীয়তপুরের মেয়ে নুভার চোখ ছলছল করল।

আমরা যখন নুভার সঙ্গে কথা বলছি, তখন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন বাণিজ্য মেলায় লাভেলোর স্টলে। এক মাসের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা—এটিই তাঁর কর্মস্থল। তাশফিয়া নুভা ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী। কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করে এখন স্নাতকোত্তর করছেন। বাণিজ্য মেলায় বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করে প্রতিদিন পান ৭০০ টাকা। শুধু যে আয় হচ্ছে তা নয়, হিসাববিজ্ঞানের এই ছাত্রীর পাওয়ার খাতায় যোগ হচ্ছে অভিজ্ঞতাও। জানালেন, বাণিজ্য মেলা শেষে বইমেলাতেও বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করবেন তিনি।

বাণিজ্য মেলায় গেলে তাশফিয়ার মতো অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গেই আপনার দেখা হয়ে যাবে। মফস্বল শহর থেকে এক মাসের জন্য ঢাকায় কাজ করতে এসেছেন, এমন ছেলেমেয়েদের যেমন পাবেন, তেমনি রাজধানীর নামী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আছেন। খণ্ডকালীন বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করছেন তাঁরা। কারও লক্ষ্য এখন থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়ানো, কেউ আবার শুধু অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যই এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন। ১২ জানুয়ারি মেলা ঘুরে আমরা কথা বলছিলাম বেশ কয়েকজন তরুণের সঙ্গে, যাঁরা পড়ালেখার পাশাপাশি বিক্রয়কর্মীর কাজ করছেন। 

বাহারি সব স্টলে ঢুঁ মারতে মারতে ব্রাদার্স ফার্নিচারের স্টলে দেখা হলো নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র মেহেদি হাসানের সঙ্গে। সেমিস্টার ব্রেকে মেহেদি প্রথমবারের মতো খণ্ডকালীন বিক্রয়কর্মীর চাকরি নিয়েছেন। মাস শেষে পাবেন ১০ হাজার টাকা। কিন্তু টাকা নিয়ে ভাবছেন না বিপণনের এই শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকেই উৎসাহ পেয়েছেন। কাছের কিছু মানুষের কটু কথাতেও থামেননি তিনি। বলেন, ‘হাতে-কলমে কাজের অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্যই আসা। আমি যেহেতু মার্কেটিংয়ে পড়ছি, এখানে মানুষের কাছে কিছু বিক্রি করতে পারার যে শিক্ষা, তা আমার কাজে লাগবে। বাসায় বসে ভিডিও না দেখে সময় কাজে লাগালাম।’

মেহেদির সঙ্গে কথা শেষে মিনিট পাঁচেক হাঁটতে দেখা গেল স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের স্টল। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন একঝাঁক শিক্ষার্থী। ক্রেতাদের নানা পণ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। ব্যস্ততার ফাঁক গলে কথা বললেন লাবণ্য মৌ। ঢাকার একটি বেসরকারি মেডিকেলের ডেন্টাল–পড়ুয়া লাবণ্য দ্বিতীয়বারের মতো বাণিজ্য মেলায় চাকরি নিয়েছেন। গতবারের পাওয়া ১৫ হাজার টাকা দিয়ে ফোন কিনেছিলেন। এবার পাবেন ২৫ হাজার টাকা। মাস শেষেই বন্ধুদের সঙ্গে উড়াল দেবেন কোনো ভ্রমণের রোমাঞ্চের খোঁজে। কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়, এখন নাকি তা নিয়েই বন্ধুদের মধ্যে ‘গবেষণা’ চলছে। মৌ বলেন, ‘বাবার টাকায় ঘুরতে ভালো লাগে না। এক মাস এখানেই আছি। মাস শেষে টাকাও পাচ্ছি, আবার একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতাও হচ্ছে।’

মেলায় ঘুরতে ঘুরতেই চোখ গেল মার্সেলের স্টলে। ঢুকতেই হেসে এগিয়ে এলেন ইফতেখার ইসলাম চৌধুরী। জানা গেল, সিলেটের একটি কলেজের আইনের শিক্ষার্থী তিনি। প্রথম বর্ষ পেরিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পা রাখলেন এবার। কিন্তু ভর্তির টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তখন এক বড় ভাই খবর দিলেন বাণিজ্য মেলায় খণ্ডকালীন এই কাজের। সুযোগও পেলেন কিছু আনুষ্ঠানিকতা পেরিয়ে। দুপুরে খাওয়া, নাশতা, রাতে থাকার ব্যবস্থা বাদেও মাস শেষে ইফতেখার পাবেন ৩৫ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে ভর্তির বন্দোবস্ত হবে, পাশাপাশি মায়ের জন্য একটি শাড়ি কিনতে চান এই তরুণ।

মেলা ঘুরে কথা হলো আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। একেকজনের গল্পটা একেক রকম, বিচিত্র তাঁদের স্বপ্নও। ২ নম্বর গেট দিয়ে বের হওয়ার পথে ঢুঁ মারি লিভানা বিউটি বারের স্টলে। সেখানে কথা হলো বিক্রয়কর্মী ফাতিমা আক্তারের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের শিক্ষার্থী ফাতিমা দ্বিতীয়বারের মতো বাণিজ্য মেলায় কাজ করছেন। গত বছর অবশ্য ছিলেন শেষ সাত দিন। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে এবার যুক্ত হয়েছেন লিভানার সঙ্গে। মাস শেষে পাবেন ২০ হাজার টাকা। ফাতিমা অকপটে বলেন, ‘আমি টিউশনি করতাম। কিন্তু তাতে পড়াশোনার ক্ষতি হয়। এখন ক্লাস নেই। কদিন পর তৃতীয় বর্ষ শুরু হবে। এই সময়টা বসে না থেকে এখানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে আছি। ভালোই লাগছে।’

ছাত্রজীবনে এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা কেন জরুরি, সে কথা বলছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বিপণন ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তামজীদ আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি যখন দেশের বাইরে পড়াশোনা করেছি, তখন দেখেছি, সেমিস্টার ব্রেকে শিক্ষার্থীরা ক্যাফেটেরিয়াতে কাজ করছে। এ ধরনের কাজ করার সংস্কৃতি সারা বিশ্বেই আছে। একে ছোট করে দেখার মানে হয় না।’ তবে নিয়োগদাতাদেরও এ ক্ষেত্রে কিছুটা দায়িত্বশীল হতে হবে বলে মনে করেন তিনি। তামজীদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘যাঁরা শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দিচ্ছেন, তাঁরা কি শুধু টাকাপয়সা দিচ্ছেন, নাকি একটা এক্সপেরিয়েন্স সার্টিফিকেটও দিচ্ছেন—এটা দেখতে হবে। আমি যতটুকু জানি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টাকাপয়সা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে প্রতিষ্ঠানগুলো। কাজের সনদ পেলে শিক্ষার্থীরা সিভিতে যুক্ত করতে পারে।’