করোনাকালে ক্যারিয়ার পরিচর্যা যেমন হবে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

কিছু দিন আগে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আমার এক বন্ধুকে তার সিভি মেইল করতে বললাম। সেই বন্ধুটি জানাল, আপাতত তার সিভি আপডেট করা নেই! এ রকম অনেক সময় হুট করে সিভি বা জীবনবৃত্তান্ত পাঠানোর দরকার হয়ে পড়ে। কিন্তু হাতের কাছে আপডেট করা সিভি না থাকায় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। সময়স্বল্পতা ও ব্যস্ততার অজুহাতে নিজের সিভিটা পর্যন্ত আপডেট করার সময় থাকে না।

নিজের চাহিদামতো চাকরি কিংবা কাঙ্ক্ষিত ক্যারিয়ার গঠনের জন্য সিভি আপডেটসহ এ রকম অনেক দরকারি কাজই সময়ের অভাবে করা হয়ে ওঠে না। আবার অনেকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিতে চাচ্ছেন কিন্তু একাডেমিক পড়াশোনা বা কর্মস্থলের ব্যস্ততায় তা পরিপূর্ণভাবে করতে পারছেন না। তবে করোনার কারণে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলের পরিবেশ কিছুটা হলেও শিখিল। এখনই সময় কোয়ারেন্টিনে থেকে ক্যারিয়ারের সঠিক পরিচর্যা, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও পড়াশোনা এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে এগিয়ে রাখার।

লক্ষ্য হোক দক্ষ হওয়া
তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ যুগে যে যত বেশি দক্ষ, তাঁর জন্য তত বেশি সুযোগ। যে পেশাতেই থাকুন না কেন, কিছু দক্ষতা থাকা আপনার বাড়তি যোগ্যতা। তাই ‘কোয়ারেন্টিনে’ ঘরে বসে অলস সময় না কাটিয়ে অন্তত কিছু বিষয়ে দক্ষতা বাড়ান। যেমন কম্পিউটারে মাইক্রোসফট অফিসের পাশাপাশি এক্সেল বা পাওয়ার পয়েন্টের কাজ অনেক ক্ষেত্রেই দরকার হয়। এগুলো না জানা থাকলে নতুন করে শিখে নিতে পারেন। বাংলা বা ইংরেজিতে কম্পোজের জন্য টাইপিং স্পিডও বাড়াতেও অনুশীলন করতে পারেন এ সময়। তা ছাড়া আগ্রহ থাকলে প্রোগ্রামিং, ভিডিও এডিটিং, এনিমেশন, গ্রাফিত ডিজাইন, ফটোশপসহ অ্যাডভান্সড লেভেলের কিছু কাজ অনলাইনে টিউটরিয়াল থেকে শেখার চেষ্টা করতে পারেন।

প্রশিক্ষণে পরিপাটি
কর্মদক্ষতা বাড়াতে পেশাগত প্রশিক্ষণ অত্যন্ত সহায়ক। সময়স্বল্পতা ও কর্মব্যস্ততার অজুহাতে প্রয়োজনীয় অনেক প্রশিক্ষণে আমাদের অংশগ্রহণ করা হয়ে ওঠে না। সব প্রশিক্ষণের জন্য যে সশরীর উপস্থিত থাকতে হবে, এমনটা নয়। বিশ্বের অনেক নামীদামি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, এমনকি র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করে। এগুলোতে ‘ডিজিটাল’ সার্টিফিকেটও পাওয়া যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ পরিচালিত মুক্তপাঠ থেকেও বিনা মূল্যে চাহিদা অনুযায়ী কোর্স করে নিতে পারেন। মনে রাখবেন, সুস্থতার জন্য যেমন শরীরের পরিচর্যা ও পুষ্টি প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনি পেশাগত উৎকর্ষের জন্যও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দরকার।

যোগাযোগে যোগ্য হোন
বর্তমান সময়কে বলা হয় ‘Age of Connectivity’ বা যুক্তকরণের যুগ। অবশ্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু আগেই আকুতি জানিয়েছিলেন ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে’। সবার সঙ্গে না হোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা পেশা-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে নিজেকে সক্রিয় রেখে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারেন। ঘরে বসে ‘লিংকড ইন’ প্রোফাইলটা আপডেট করে ফেলুন। ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রেখেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন পেশা, শ্রেণি বা ইস্যুভিত্তিক গ্রুপে যুক্ত থাকতে পারেন। অংশ নিতে পারেন মেসেঞ্জারসহ চাহিদামতো চ্যাটিং গ্রুপগুলোতেও। ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে নিজস্ব মতামত, মন্তব্য ও বিশ্লেষণী উপস্থাপনা আপনার পরিচিতি বাড়ানোর পাশাপাশি একটি স্বকীয় অবস্থান তৈরি করবে। নতুন ‘নেটওয়ার্ক’ তৈরি হবে। পুরোনো সম্পর্কগুলো শাণিত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু ব্যক্তিবিশেষের নাম–ঠিকানাসহ ফোন বা মোবাইল নম্বর ডায়েরিতে লিখে রাখার সেই সনাতন পদ্ধতি বেশ কার্যকর। ভালো লাগারও বটে।

বেশির ভাগ সময় আমরা সৌজন্যের খাতিরে ‘ভিজিটিং কার্ড’ বিনিময় করি ঠিকই কিন্তু সেভাবে সংরক্ষণ করা হয়ে ওঠে না। দেখা যায়, প্রয়োজনের সময় আর কার্ডটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখনই সময়, কার্ডগুলো একটা ‘কার্ড হোল্ডার’–এ গুছিয়ে রাখুন আর সেখান থেকে প্রয়োজন অনুসারে কিছু নম্বর আলাদা করে ডায়েরিতে লিখে রাখুন। কে জানে, ক্যারিয়ারের জন্য কাকে কখন দরকার পড়ে।

সুখের খোঁজে শখের কাজ
আমার এক সহকর্মী কয়েক দিন ধরে গিটার নিয়ে গান গেয়ে তা ফেসবুকে আপলোড করছেন। বন্ধুদের ইতিবাচক মন্তব্যে তিনি আরও অনুপ্রাণিত হয়ে আরও গান করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। করোনাকালে এ রকম অনেকেই ঘরে বসে শখের কাজ করতে পারেন। শখের বশে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ যেমন লেখালেখি, আঁকাআঁকি, গিটারে সুর তোলা আপনাকে চাঙা করে তুলতে পারে। এতে মনোবল, মনোযোগ ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে। এ ছাড়া ছাদ থাকলে গাছ লাগিয়ে পরিচর্যা করতে পারেন। টবের গাছ, বারান্দা, পড়ার ঘরটি পরিষ্কার কিংবা বুকশেলফে বই সাজানোর মতো টুকিটাকি কাজও পরোক্ষভাবে আপনার ক্যারিয়ারের জন্য সহায়ক হতে পারে।

পড়াশোনার শেষ নেই
ঘরে বসে পুরো পৃথিবী পরিভ্রমণ কিংবা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে বিচরণের জন্য বই হলো সর্বোত্তম মাধ্যম। যথাসম্ভব বেশি ও বৈচিত্র্যময় বই পড়তে পারলে নিজের চিন্তার জগৎ পাল্টে যায়; পরিশীলিত হয়। কিন্তু কথা হলো, এত বই পড়ার সময় কোথায়? একাডেমিক পড়াশোনা বা অফিসের ব্যস্ততার ফাঁকে নিরবচ্ছিন্ন বই পড়া আসলেই কঠিন, কষ্টসাধ্য। এখন তো আর সেসব ঝামেলা নেই, হাতে সময়ও অনেক। ঘরে বসে কিছু বই পড়ে ফেলুন না। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি কিংবা পেশাসংশ্লিষ্ট যেকোনো বই পড়তে পারেন। ক্যারিয়ারে কোনো না কোনোভাবে কাজে দেবে। পছন্দসই সব বই হয়তো সংগ্রহে না–ও থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে ই-লাইব্রেরি বা ই-বুক অ্যাপসগুলোর সহায়তা নিয়ে পিডিএফ ভার্সন পড়তে পারেন। আর যাঁরা বিসিএস, ব্যাংকসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁদের জন্য সময়টি খুবই কার্যকর হতে পারে। এ সময় একাধিক বই পড়ার পাশাপাশি জাতীয় দৈনিকের বিশেষ ফিচার ও কলাম পড়ে নোট করা বা অনলাইনে বিদেশি জার্নালের নিবন্ধ পড়ে অনুবাদ করতে পারলে প্রস্তুতির জন্য খুবই ভালো হয়। প্রতিদিন ঘরে বসে নিয়ম করে একটি পূর্ণাঙ্গ মডেল টেস্ট দিতে পারলে নিজের অগ্রগতি নিজেই বুঝতে পারবেন। দেশের এই ক্রান্তিকালে নিজেকে নিরাপদ রেখে কাঙ্ক্ষিত ক্যারিয়ারের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারলেই তো আপনি এগিয়ে থাকবেন।

*লেখক: উপপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক