বিসিএসে শেষ হলো কোটা যুগ

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বিসিএসে শেষ হলো কোটার যুগ। এখন সামনে যেসব বিসিএস পরীক্ষা আছে, এতে কোটার ব্যবহার আর থাকছে না। গত মঙ্গলবার ৩৮তম বিসিএসের ফলাফলের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা কোটা যুগের অবসান হলো। ২০১৭ সালের ২০ জুন ৩৮তম বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতি আনা হয়। আগে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা রাখা হয়।

কোটা যুগের অবসানের বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারি কর্ম কমিশনের(পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, ৩৮তম বিসিএস হচ্ছে শেষ বিসিএস, যেখানে কোটার ব্যবহার ছিল। ৩৯তম বিসিএস ছিল বিশেষ বিসিএস। এর কার্যক্রম শেষ হয়েছে। সামনে আসছে ৪০তম বিসিএস। এর বিজ্ঞপ্তির সময় বলা হয়েছিল, পিএসসি সরকারের সর্বশেষ কোটার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। যেহেতু সরকার ওই বিসিএস চলাকালে কোটা বন্ধ করেছে, তাই ৩৮তম বিসিএসের থেকে পরের বিসিএসে কোটা থাকছে না।

মন্ত্রিসভায় কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন হওয়ার প্রায় এক মাস আগে ১ হাজার ৯০৩টি পদে নিয়োগের জন্য ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন ২০ হাজার প্রার্থী। তাঁরা এখন সেই ফলের অপেক্ষায় আছেন। ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, ফলাফল দেওয়ার সময় সরকারের সর্বশেষ কোটা নীতি ব্যবহার করা হবে।

কোটা নিয়ে আন্দোলন

কোটার কমানোর দাবিতে ২০১৮ সালে ‍বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীরা কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলেন। 'বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ' নামের একটি সংগঠন এতে নেতৃত্ব দেয়। আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ।

আন্দোলনের একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল সংসদে বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতিই আর রাখা হবে না। তবে পরে সংসদে তিনি বলেন, 'কোটা পদ্ধতি থাকবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ রাখতে হাইকোর্টের রায় আছে।'

আন্দোলনের একপর্যায়ে সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের ২ জুন একটি কমিটি গঠন করা হয়।

২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এর ঠিক পরের দিন নবম গ্রেড ও দশম থেকে ১৩তম গ্রেডে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করে আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এরপর সরকারি চাকরির নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত, অর্থাৎ, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে কোনো কোটা না রেখে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করতে ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ জমা দেয় কমিটি। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলার পর তা পাস হয়।

সরকারি চাকরিতে অষ্টম থেকে তার ওপরের দিকে, অর্থাৎ, প্রথম গ্রেড পর্যন্ত সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা থাকবে না বলে গত ২০ জানুয়ারি সিদ্ধান্ত দেয় মন্ত্রিসভা।

কোটায় ফাঁকা পড়ে থাকে পদ

একসময় বিসিএসে কত জনকে কোটায় আর কত জনকে মেধায় নিয়োগ দেওয়া হলো, তা প্রকাশ করা হতো। কিন্তু পিএসসি সূত্র জানায়, ৩৪তম বিসিএস থেকে তা আর প্রকাশ করা হচ্ছে না।

পিএসসি সূত্র জানায়, কোটা থাকার কারণে অনেক বিসিএসে পদ ফাঁকাই পড়ে থাকত। যোগ্যতার ভিত্তিতে  সেখানে কাউকে নিয়োগ করা যেত না। এভাবে ২৮ থেকে ৩৭তম বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে প্রায় ছয় হাজার পদ খালিই পড়ে ছিল।

কোটার প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য ৩২তম বিশেষ বিসিএস নেওয়া হলেও ওই বিসিএসেও মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮১৭টি, মহিলা ১০টি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ২৯৮টিসহ মোট ১ হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রাখতে হয়। কোটায় পদ পূরণ না হলেও তা সংরক্ষণ করে রাখার নিয়ম ছিল। তবে ৩২তম বিসিএসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পদ খালি থাকায় কোটার শূন্যপদ সংরক্ষণ করে রাখা নিয়ে পিএসসিতে প্রশ্ন ওঠে। এরপর যোগ্যতা সাপেক্ষে পিএসসি ৩৩তম বিসিএস থেকে কোটা কিছুটা শিথিল করে। কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ৩৩তম বিসিএসে ৭৭ দশমিক ৪০ শতাংশ, ৩৫তম বিসিএসে ৬৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং সর্বশেষ ৩৬তম বিসিএসে ৭০ দশমিক ৩৮ শতাংশ মেধাবী প্রার্থী নিয়োগ পান। এই তিন বিসিএস থেকে ৭১ দশমিক ৭৫ শতাংশ মেধাবী প্রার্থী নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন। শুধু বিসিএস নয়, সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও কোটার কারণে পদ শূন্য পড়ে থাকত।

সর্বশেষ ৩৮তম বিসিএসে ২ হাজার ২০৪ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। তবে এর মধ্যে কত শতাংশ কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন, তা উল্লেখ করেনি কমিশন। পিএসসি বলছে, ৫৫ শতাংশ কোটা এবং ৪৫ শতাংশ মেধা—এই নিয়ম মেনে ৩৮তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সাধারণ ক্যাডারে কোটার সব প্রার্থী পাওয়া গেলেও কারিগরি ক্যাডারে কোটার প্রার্থী যেখানে পাওয়া যায়নি, সেখানে সাধারণ প্রার্থী দেওয়া হয়েছে।