মহামারি করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে অনেক কিছু। অন্যান্য খাতের মতো পরিবর্তন এসেছে দেশের চাকরির বাজারেও। বিদায়ী বছরের শুরুতে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র পরিসরের চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা সংকুচিত হওয়ায় চাকরির বাজার প্রায় বন্ধ ছিল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকারের জারি করা কঠোর বিধিনিষেধ গত আগস্টে উঠে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করে। ফলে কিছুটা স্বাভাবিক হয় চাকরির বাজার। তবে পরিবর্তন এসেছে চাকরির ধরনে। করোনার বিধিনিষেধে ঘরে বসে কাজের ধরন চালু হওয়ায় সব খাতের কর্মীকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছে। গতানুগতিক কর্মীর চেয়ে খাতভিত্তিক দক্ষ লোকের চাহিদা বেশি দেখা গেছে।

দেশে বসে বিদেশে চাকরি

আগে ফ্রিল্যান্সাররা বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাজ করতেন। কিন্তু করোনার কারণে এ খাতে বড় পরিবর্তন এসেছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তৃতীয় কোনো মাধ্যমে না গিয়ে সরাসরি কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে। যেহেতু সারা বিশ্বে ঘরে বসে কাজ (ওয়ার্ক ফ্রম হোম) করার ধরন চালু হয়েছে, তাই বিদেশি বড় বড় প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তারা মনে করেন, কাজটি কোথায় বসে সম্পন্ন করা হয়েছে, সেটি বড় কথা নয়; কতটা দক্ষতার সঙ্গে করা হলো, সেটি বড় বিষয়। তাই বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে সরাসরি কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে। এ সুযোগ পাচ্ছেন বাংলাদেশিরাও। অনেক বাংলাদেশি দেশে বসে বিদেশি প্রতিষ্ঠানে সরাসরি চাকরি করছেন এবং মাস শেষে মোটা অঙ্কের বেতন পাচ্ছেন। বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, শুধু তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ ব্যক্তিরা নন, অন্যান্য খাতের ব্যক্তিরাও দেশে বসে বিদেশি চাকরি করছেন। বিশেষ করে হিসাববিজ্ঞানে দক্ষ ব্যক্তিদের চাহিদা এ খাতে বেশি বেড়েছে। দেশে বসে বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তাঁরা মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন।

পণ্য ডেলিভারিতে দুই লাখ কর্মসংস্থান

করোনা যেমন বেকারত্ব বাড়িয়েছে, তেমনি নতুন কিছু কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে অন্যতম পণ্য ডেলিভারি করার পেশা। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে করোনায় চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়া বেশির ভাগের ভরসা ছিল এ পেশা। এ চাকরি করে মাসে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেছেন বলে জানান রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। করোনার কারণে চাকরি হারিয়ে এ শহরে থাকতে পেরেছি পণ্য ডেলিভারির চাকরি করার কারণে। শুধু আমি নই, আশপাশে দেখেছি, আমার মতো অনেকেই চাকরি হারিয়ে এ কাজ করে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন।’ বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, গত এক বছরে এ খাতে প্রায় দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ছোটখাটো অনলাইন শপ থেকে শুরু থেকে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানও করোনার সময় অতিরিক্ত ডেলিভারিম্যান নিয়োগ দিয়েছে।

গত এক বছরে পণ্য ডেলিভারি পেশায় প্রায় দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে
ছবি: চাকরি–বাকরি

অনলাইননির্ভর মিটিং-ট্রেনিং

করোনার বিধিনিষেধের মধ্যেও জীবিকার তাগিদে ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অনেকেই অনলাইনে অফিস করছেন। অনলাইনে করতে হয়েছে অফিসের কাজ, মিটিং ও ট্রেনিং। জুম ও গুগল মিটের মতো অপরিচিত সফটওয়্যারগুলো করোনার কারণে এখন মানুষের মুখে মুখে। অনলাইনে মিটিং করতে গিয়ে কিছু প্রতিষ্ঠান কর্মীদের নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন। কারণ, কিছু কর্মী লগইন করে হাজিরা দিয়ে আর দেখা দিতেন না। মানবসম্পদ–বিষয়ক প্রতিষ্ঠান করপোরেট কোচের মুখ্য পরামর্শক যিশু তরফদার প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় অফিসগুলো অনলাইনে ডকুমেন্ট আদান-প্রদানের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় বৈঠকও করেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় কিছুটা কম ছিল।

তথ্যপ্রযুক্তির চাকরির ধরনে পরিবর্তন

করোনাভাইরাস আসার আগে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সফটওয়্যার প্রকৌশলীদের চাহিদার ধারেকাছে অন্য কোনো খাত ছিল না। কিন্তু করোনার কারণে নতুন নতুন প্রয়োজন সৃষ্টি হয়েছে, আইটি খাতে বেড়েছে আরও অনেক ধরনের চাকরির চাহিদা। এর মধ্যে অন্যতম আইটি নেটওয়ার্কিংয়ের কাজ। করোনা দেখিয়েছে, ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া প্রতিষ্ঠান অচল। সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ওএস ক্লিকসের এমডি তথ্যপ্রযুক্তিবিদ রূপম রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছরের স্থানীয় বাজারে তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট কাজের চাহিদা বেড়েছে। এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ইন্টারনেট কানেকশন প্রোভাইডার ও সার্ভার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাজের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। এ ছাড়া ই-কমার্সের জন্য ওয়েবসাইট তৈরি, ফেসবুক ও ইউটিউবে পণ্যের মার্কেটিং, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন এবং ভিডিও তৈরির চাকরির চাহিদা বেড়েছে। কল সেন্টার–নির্ভরতা আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়েছে।

সরকারির চাকরির পরীক্ষাজট

করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত সেপ্টেম্বর থেকে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয় চাকরির পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে। একই সঙ্গে সব প্রতিষ্ঠান পরীক্ষার সূচি প্রকাশ করায় বিপাকে পড়েন শিক্ষার্থীরা। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে প্রতি শুক্রবার গড়ে ১৫টি প্রতিষ্ঠানের চাকরির পরীক্ষা পড়ে। কোনো কোনো পরীক্ষার্থীকে একই দিনে চার-পাঁচটি চাকরির পরীক্ষা দিতে হয়। একই দিনে সব পরীক্ষার সূচি থাকায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েও অনেকে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি।

টেলিমেডিসিনে ঘরে বসেই রোগী দেখা–সেবা দেওয়া

পেশা হিসেবে চিকিৎসা একটি বড় স্থান দখল করে আছে। উন্নত বিশ্বে আগে থেকেই টেলিমেডিসিন সেবা বহুল ব্যবহৃত হলেও বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে গত এক বছরে। লকডাউনে চিকিৎসকেরা চেম্বার খুলতে না পারায় ঘরে বসে রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন। রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও রোগনির্ণয় অনলাইনেই করেছেন চিকিৎসকেরা। দেশের যেকোনো জায়গা থেকে চিকিৎসক ও রোগী দুই প্রান্তে ভিডিও বা ভয়েস কলের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে সমস্যা বলে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিছু হাসপাতাল ২৪ ঘণ্টাই অনলাইনে রোগীদের সেবা দিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চর্মবিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট আফজালুল করিম বলেন, করোনার সময় টেলিমেডিসিন একটি বড় আশার বিষয়। অনেক সময় মানুষের তাৎক্ষণিক সেবা প্রয়োজন হয়, যা টেলিমেডিসিনে সম্ভব। আবার রোগীকে যেসব পরীক্ষা দেওয়া হয়, তার জন্যও রোগীকে সব সময় চিকিৎসকদের আছে আসা জরুরি নয়। এটিও টেলিমেডিসিনে সম্ভব। সব মিলে এই টেলিমেডিসিন যেমন সময় বাঁচিয়েছে, তেমনি সেবা অনেকটাই নিশ্চিত করেছে। আবার অনেক ধরনের যাতায়াত ব্যয় ও সময় বাঁচিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এটি আরও ভালোভাবে করাটাই চ্যালেঞ্জ।

চাকরি হারিয়ে আর ফিরে পাননি

করোনাভাইরাসের কারণে প্রতিষ্ঠানের আয় কমে যাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছিল। তবে সবচেয়ে বেশি ছাঁটাইয়ের শিকার হন মধ্যম সারি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, যাঁদের বেশির ভাগের বয়স ৪৫-৬০ বছর। তাঁদের কারও কারও বেতন লাখ টাকার বেশি এবং ছিল গাড়ির সুবিধা। প্রতিষ্ঠানের ব্যয় কমাতে গিয়ে তাঁদের কপাল পুড়েছে। তেমনি একজন ইসমাইল হোসেন। রাজধানীর একটি নামকরা করপোরেট প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে দেড় লাখ টাকা বেতনে চাকরি করতেন। ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসে করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় নিজের বেতন থেকে টাকা দিয়ে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু পরের বছর করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে চাকরি হারিয়ে পথে বসেন। তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি হবে কল্পনায়ও ভাবিনি। জমানো টাকা দিয়ে কত দিন চলা যায়। যে পদে চাকরি করতাম, সে পদে নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো নিতে চায় না। তাই এখনো আর চাকরি পাওয়া হয়নি।’

যেসব চাকরির চাহিদা বেশি

স্বাস্থ্যসেবা, তথ্যপ্রযুক্তি ও লজিস্টিকস খাতে চাকরির চাহিদা বেশি দেখা গেছে। ওষুধ প্রস্তুত, চিকিৎসক, নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের চাহিদা সরকারি, বেসরকারি—সব সেক্টরেই বেড়েছে। চিকিৎসকের সংকট মেটাতে এই করোনাকালে বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে সারা দেশে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরও চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার আলোচনা চলছে। ঘরে বসে কাজের ধরন চালু হওয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আকাশচুম্বী চাহিদা বেড়েছে। এ ছাড়া লজিস্টিকস খাতে পণ্য সরবরাহব্যবস্থা বা সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টে প্রতিনিয়ত কর্মী দরকার হচ্ছে। অনলাইনে ইংরেজি ও বাংলা কনটেন্ট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের চাহিদাও বাড়ছে।

সরকারি খাতে বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি

লকডাউন উঠে যাওয়ার পর বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ও বাংলাদেশ ব্যাংক জনবল নিয়োগের জন্য আটকে থাকা পরীক্ষা নেওয়া শুরু করার পাশাপাশি নতুন নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে থাকে। ফলে নতুন চাকরির দ্বার খুলে যায়। গত এক বছরেই পিএসসি তিনটি বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত ৮টি ব্যাংক ও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৫ হাজার ৮৬ কর্মী নিয়োগের জন্য বিশাল বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, লকডাউন উঠে যাওয়ার পর একই সঙ্গে সব প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা নেওয়া ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিতে শুরু করেছে। এ জন্য এখন মনে হচ্ছে, অনেক সরকারি চাকরি—এমনটা ভাবা ভুল। কারণ, এগুলো সব আগের নিয়োগ, যা করোনার কারণে দেড় বছর আটকে ছিল। এটা হয়তো এ বছরেই শেষ হয়ে যাবে। নতুন বছরে তাদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কমে আসবে। তখন সরকারি চাকরির সংখ্যাও কমে যেতে পারে।