স্মৃতির পাতায় শিউলি গাছ

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

শিউলি তলায় ভোরবেলায়/ কুসুমও কুড়ায় পল্লীবালা...। কাজী নজরুল ইসলামের এই গানটি শুনলেই মনে পড়ে যায় আমাদের পুরোনো বাড়িটির কথা। আমাদের বাড়িটা ছিল পুরান ঢাকার অনেক বছরের পুরোনো একটা বাড়ি। আমার দাদা এক হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে বাড়িটা কিনেছিলেন। বাড়ি বিক্রির পর বাড়ির সেই হিন্দু মালিক দাদার কাছে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ বাড়িতে তাঁকে থাকতে দিতে। দাদা তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ওই বাড়িতে নিজ বাড়ির মতো কাটিয়েছিলেন।

আমাদের সেই পুরোনো বাড়িতে ছিল এক জোড়া শিউলি গাছ। গাছ দুটো আমার দাদার লাগানো ছিল। বছরের পর বছর শিউলি গাছ দুটো আমাদের পরিবারের সুখ-দুঃখের সাথি হয়ে ছিল।
একটা সময় ছিল যখন আমাদের এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বেশি বসবাস করত তখন আমাদের বাড়ির শিউলি গাছ পূজারিদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল। মনে পড়ে, ভোর রাতে আমাদের উঠোন জুড়ে শিউলি ফুলের মেলা বসত। আলো-আঁধারির মাঝে ফুলে ফুলে ভরা উঠোনটাকে মনে হতো যেন একটা সফেদ বিছানা। কানায় কানায় শিউলি ফুলের কোমল বিছানায় পা ফেলাই যেন দায় ছিল। ছেলেবেলায় খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়তাম শিউলি ফুল কুড়ানোর লোভে। যেন সেই পল্লিবালার মতো! আমরা কত যে শিউলি ফুলের মালা বানিয়ে গলায় পড়েছি। মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা যখন ফুল কুড়াতে উঠতাম তখন আমাদের প্রতিবেশীরাও আমাদের উঠানে ভিড় করত। ছেলে-বুড়ো সব বয়সীদের মেলা বসত আমাদের ভোরের আঙিনায়। পূজার জন্য আমাদের বাড়ির শিউলি গাছ দুটো ছিল তাদের অনেক বেশি প্রিয়। রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ত সবাই ফুল কুড়াতে গিয়ে। কত দিন যে আমাদের ভাগের ফুল মাসি-পিসিদের দিয়ে দিয়েছি। তাঁরা সেই ফুল পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে গেছেন। আজও সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়লে ঠোঁটের কোণে এক অজানা তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমরা যারা পুরান ঢাকায় বেড়ে উঠেছি, তাদের প্রতিটি স্মৃতির পাতায় লেগে আছে পুরান ঢাকার স্বাদ, গন্ধ ও ঐতিহ্য। পুরান ঢাকায় সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব খুব একটা চোখে পড়ে না। এর কারণ, শৈশব থেকে আমরা হিন্দু-মুসলমান এক সঙ্গে বড় হয়েছি। আমাদের ঈদ, হিন্দুদের পূজা কিংবা বিয়ে সব অনুষ্ঠানেই সবাই আনন্দ করেছি। আমরা যার যার ধর্ম শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করেছি কিন্তু মানুষ হিসেবে সবাই সবাইকে ভালোবেসেছি। ইসলাম শান্তির ধর্ম। আমাদের ধর্ম অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করার শিক্ষা দেয় না।
আগে আমাদের দেশে সব ধর্মাবলম্বীর মানুষ এক সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করত। তখন এখনকার মতো এত হানাহানি, রক্তারক্তি ছিল না। সমগ্র বাংলা ছিল এক শান্তির নীড়। হয়তো সে কারণেই সেই প্রিয় গানটা রচিত হয়েছিল: গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!
যে শিউলি গাছ দুটো নিয়ে আমার লেখার সূচনা, সেই গাছ দুটো কিন্তু ধর্মীয় ভেদাভেদ, মতবিরোধ বোঝেনি। শরতের ভোরে যে শিউলি মুসলিম বাড়ির আঙিনায় সুবাস ছড়িয়েছে তেমনি সে শিউলিই আবার কারও অঞ্জলিতে শোভা পেয়েছে।
আমরা বাঙালিরা যদি সবাই এক আকাশের নিচে মিলেমিশে বাস করি তাহলে কোনো অপশক্তি আমাদের কোনো অমঙ্গল করতে পারবে না। চারদিকে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তা মোকাবিলা করতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ভালোবাসার বন্ধন সুদৃঢ় হলেই না বাংলার আকাশ থেকে দুর্যোগের কালো মেঘ সরে গিয়ে সোনালি সূর্যের দেখা মিলবে।