সিডনিতে একুশে বইমেলা

প্রথমা প্রকাশনের স্টল
প্রথমা প্রকাশনের স্টল

যথাযোগ্য ভাব-গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও অমর একুশ উদ্‌যাপন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রোববার একুশে একাডেমি অস্ট্রেলিয়ার আয়োজনে সিডনির অ্যাশফিল্ড পার্কে দিনব্যাপী এক বইমেলার আয়োজন করা হয়।

উল্লেখ্য, একুশে একাডেমি গত উনিশ বছর ধরে অ্যাশফিল্ড পার্কে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, শিশুদের জন্য চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও বইমেলার আয়োজন করে আসছে। এ বছর একুশে ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ায় মঙ্গলবার কর্ম দিবস হওয়ায় একুশে একাডেমি উনিশ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে।
বইমেলায় মোট সাতটি বইয়ের স্টল, একটি আর্ট প্রদর্শনী, কিছু খাবারের দোকান ও শিশুদের জন্য একটি খেলনার দোকান বসেছিল। বাংলাদেশের মতো এখানেও প্রতি বছর নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হয়। এ বছর আশা নাজনীনের উপন্যাস স্বামীসূত্র, এডওয়ার্ড অশোক অধিকারীর রম্যরচনা চাপাই ভরসা ও শাফিন রাশেদের উপন্যাস মেঘের দুপুর–এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। মোড়ক উন্মোচন করেন কলামিস্ট অজয় দাশগুপ্ত, সংগীত শিল্পী সিরাজুস সালেকিন ও কথাসাহিত্যিক-কলামিস্ট ড. শাখাওয়াৎ নয়ন।
একুশে একাডেমি অস্ট্রেলিয়া আয়োজিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে ইকরিমিকরি বুক স্টুডিওর পক্ষ থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সিডনির বাঙালি কমিউনিটির জনপ্রিয় তরুণ নেতা মোহাম্মাদ শাহে জামান টিটু মেলায় আগত প্রচুর সংখ্যক শিশুকে বই উপহার দিয়েছেন। এমন শিশুবান্ধব নেতৃত্ব গুণের কারণে অনেকেই তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। অনেক বাবা-মাকে বলতে শোনা গেছে, সত্যি তিনি একটি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।

ইকরিমিকরির স্টল
ইকরিমিকরির স্টল

বইমেলায় অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী লেখকদের মধ্যে অরুণ মৈত্রর কিশোরদের চে গুয়েভারা, কবি আবুল হাসনাৎ মিল্টনের কাব্যসমগ্র জলের কবিতা, আশা নাজনীনের উপন্যাস স্বামীসূত্র, শাখাওয়াৎ নয়নের গল্পগ্রন্থ ব্যাপটিস্ট চার্চ এবং একটি টিকটিকির গল্প, ইসহাক হাফিজের গল্পগ্রন্থ খণ্ডিত সময়, কবি এম এ জলিলের কাব্যগ্রন্থ গাঁও গেরামের কথা, শাফিন রাশেদের উপন্যাস মেঘের দুপুর, এডওয়ার্ড অশোক অধিকারীর চাপাই ভরসা বেশি বিক্রি হয়েছে।
উল্লেখ্য, এ বছর বাংলাদেশ থেকে প্রথমা প্রকাশনী এবং শিশু-কিশোরদের বই প্রকাশনী ইকরিমিকরি বুক স্টুডিও এই মেলায় অংশগ্রহণ করেছে। যা ছিল সিডনি একুশে বইমেলায় নতুন সংযোজন। বুকস্টলগুলোর মধ্যে প্রথমা প্রকাশনীর বুকস্টলটি ছিল দৃষ্টিনন্দন। অনেকেরই তা নজর কেড়েছে। বই বিক্রির দিক থেকে সাতটি বুকস্টলের মধ্যে দুপুরের পরপরই ইকরিমিকরি বুক স্টুডিওর সব বই শেষ হয়ে যায়। তবে প্রথমা প্রকাশনী, বর্ণমালা, আনন্দ পাবলিশার্স, মুক্তমঞ্চ ও হ্যাপি বই ঘর ভালো পরিমাণ বই বিক্রি করেছে। স্টল মালিকদের বই বেচাকেনায় বেশ ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।
ইকরিমিকরি বুক স্টুডিওর কাছে তাদের বই শেষ হয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে, ইকরিমিকরির পক্ষ থেকে আনীলা পারভীন জানান, বাংলাদেশ থেকে ডিএইচএল-এর মাধ্যমে আমরা ২৪৫টি বই এনেছিলাম। দুপুরের মধ্যেই আমাদের সকল বই বিক্রি হয়ে যায়। প্রচুর সংখ্যক শিশু ও তাদের অভিভাবকদের কাছে করজোড়ে অপারগতা প্রকাশ কিংবা ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না। আমরা বলতে বাধ্য হয়েছি, প্লিজ আপনাদের ফোন নম্বর রেখে যান, আমরা বই এনে দেব। অনেকেই বইয়ের অর্ডার দিয়ে গেছেন। কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন, সাধারণত বইমেলায় আসা হয় না, শুধুমাত্র ইকরিমিকরির বই কিনতে এসেছি। আপনারা এত কম বই এনেছেন কেন? আমাদের মুখে কোনো উত্তর ছিল না।
আনীলা পারভীন আরও জানালেন, একজন গর্ভবতী মা স্বামীর হাত ধরে ইকরিমিকরির স্টলে এসে তার গর্ভের সন্তানের জন্য বই কিনলেন। তার স্বামী তাকে জিজ্ঞেস করলেন—এখনই কেন? এখনো তো আমাদের সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি।—তাতে কী? গল্পগুলো জোরে জোরে পড়ব, তাহলেই আমার সোনামানিক শুনতে পাবে। সংগত কারণে আমি তাদের নাম প্রকাশ করছি না। অনুমতি ছাড়া কীভাবে বলি? তবে সেই গর্ভবতী মায়ের কথায় আনন্দাশ্রু ধরে রাখতে পারিনি। ভালো লাগায় কখন জানি চোখে পানি এসে গেছে। মনে মনে বলেছি, তার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
একজন বাবা তার ছেলেকে নিয়ে ইকরিমিকরির স্টলে এসেছেন। বাবা একটি অথবা দুটি বই কিনে দিতে চাচ্ছেন কিন্তু ছেলে নিতে চায় চার-পাঁচটি। বাবা বলছেন, এত বই দিয়ে তুমি কি করবে? তুমি তো পড়তে পার না। ছেলে বলল—আমি পড়তে পারি না, তাতে কি হয়েছে? তুমি পড়ে শোনাবা বাবা...। এরপর বাবা আর না করতে পারলেন না। একটু পরে সেই শিশু তার এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছে বই কিনতে। তার বন্ধুও বই কিনেছে। ইংরেজি ভাষাভাষী একটি দেশে আমাদের শিশুরা যে বাংলা বই এত পছন্দ করবে, আমরা তা ধারণা করতে পারিনি। তাই মাত্র ২৪৫টি বই এনেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে ৫০০ বই আনলেও বিক্রি হয়ে যেত। কারণ কোনো শিশুই একাধিক বইয়ের কম কেনেনি। একটা ধরে ডান হাত দিয়ে তো, আরেকটি বাম হাতে।