হারমনি ডে ও ব্রিং এ প্লেট সংস্কৃতি

হারমনি ডের অনুষ্ঠান
হারমনি ডের অনুষ্ঠান

‘সুন্দরই সত্য, সত্যই সৌন্দর্য’—জন কিটসের এই কথার মাধ্যমে বলা যায় মানুষ সব সময় সত্য ও সুন্দরের পিয়াসি। সমাজে বাস করতে গেলে মিলে মিশে থাকতে হয়। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা দেখানো সমাজের একটা অংশ। সেটা যেকোনো সংস্কৃতির হোক না কেন। অন্যের সংস্কৃতিকে সম্মান দেখাতে পৃথিবীতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে অস্ট্রেলিয়া। হারমনি ডে তারই একটা অংশ। পুরো অস্ট্রেলিয়া জুড়ে মার্চ মাসে পালিত হয় হারমনি ডে।

হারমনি ডের অনুষ্ঠান
হারমনি ডের অনুষ্ঠান

অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ বেশি অভিবাসী হয়ে আসেন। তাদের সমাজ, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, ধর্ম, খাবার সবকিছু আলাদা। একে অন্যের প্রতি সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা দেখাতে এই হারমনি ডে সৃষ্টি। সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ডে কেয়ার ও চাইল্ড কেয়ারসহ সব জায়গায় হারমনি ডে পালন করা হয়। এই দিন বিভিন্ন দেশের মানুষ তাদের নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে আসেন আর তাদের সংস্কৃতি তুলে ধরা হয় গান, নাচ, অভিনয়, পোশাক ও খাবার ইত্যাদির মাধ্যমে। বাচ্চাদের স্কুলেও ছোটবেলা থেকে তাদের অন্যের সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখানো শেখাতে হারমনি ডে পালন করা হয়। হারমনি ডের মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘Everyone belongs’—সবাই একই বৃন্তের ফুল।

হারমনি ডের অনুষ্ঠান
হারমনি ডের অনুষ্ঠান

আমি নাভিতাস নামে একটি সরকারি সংস্থার ক্লায়েন্ট। যারা সরকারি খরচে অভিবাসীদের ইংরেজি শেখানোসহ কীভাবে অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করা যায় সেসব বিষয়ে ধারণা দেয়। সেখানে ক্লাস করার সুবাদে বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। যেটা আমি খুব উপভোগ করি। আর নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী হওয়ার কারণে কিনা জানি না, আমার অন্য দেশের মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি ও খাবারের প্রতি আগ্রহ বেশি। তাই হারমনি ডের কথা প্রথম যখন শুনলাম আমার কৌতূহল বেড়ে গেল।

লেখিকার মেয়ে
লেখিকার মেয়ে

দেখা গেল আমার মেয়ের চাইল্ড কেয়ারে তিন ধরে পালন করা হচ্ছে হারমনি ডে। প্রথম দুই দিন মায়েদের ডেকে নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে বসে রাইম বলা, ক্র্যাফট করা, নিজেদের ভাষায় কিছু লেখা, দেয়াল লেখন ইত্যাদি করানো হয়। বাচ্চাদের সঙ্গে আমরাও অনেক আনন্দ পাচ্ছিলাম বিশেষ করে আমি আমাদের স্বাধীনতার মাসে বাংলা ভাষায় কিছু লিখতে পেরে। আমার মেয়ে রংধনু এঁকেছে আর আমি পাশে অনেক বড় করে বাংলায় লিখলাম ‘হারমনি ডে শুভ হোক’—জিতেশী। মেয়ের নাম এই প্রথম আমার বাংলায় লেখা।
আমার এই প্রথম চাইল্ড কেয়ারে হারমনি ডে, তাই বুঝছিলাম না কি করব। সেখানে একজন বাঙালি কাজ করেন। তিনি বললেন, দেয়ালে লিখলে অনেক বড় করে লিখতে। যাতে অনেক দূর থেকে সবার আগে আমাদের বাংলা ভাষা চোখে ভাসে। সেখানে আমি ছিলাম একমাত্র বাঙালি। আরও বিভিন্ন দেশের মায়েরা ছিলেন। তিনি আমাকে বড় দেখে মার্কার এনে দিলেন যাতে বড় করে লিখতে পারি। তৃতীয় দিনে ছিল ‘ব্রিং এ প্লেট’। এটা অস্ট্রেলিয়ার একটা কালচার। দুপুরের খাবারের পার্টি। সবাই নিজেদের দেশের খাবার এনে বাফেট শেয়ার করা। সবাই খুব আনন্দ করে এ সময়। গল্পগুজব ও বিভিন্ন দেশের খাবারের স্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে চলতে থাকে আড্ডা।

লেখিকার মেয়ের করা ড্রয়িং
লেখিকার মেয়ের করা ড্রয়িং

এরপর ২১ মার্চ আমদের ইনস্টিটিউটে হলো হারমনি ডের অনুষ্ঠান। আমরা সবাই নিজের দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ফ্যাশন প্যারেড করলাম। হারমনি ডে স্পেশাল গান গাওয়া হলো এবং সবশেষে নিজেদের দেশীয় আনা খাবার শেয়ার করা হলো। যাকে বলে ব্রিং এ প্লেট। এটার সঙ্গে অবশ্য আমি পরিচিত অস্ট্রেলিয়া আসার পর থেকেই। এখানে কিছু চ্যারিটি সংগঠন সপ্তাহের দুই দিন প্লে গ্রুপ করে। প্লে গ্রুপ হচ্ছে শূন্য থেকে চার বছর বাচ্চাদের জন্য স্কুলের মতো। যেখানে বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে এসে মায়েরা সময় কাটান। আমার বাচ্চার যখন ১০ মাস তখন থেকেই এই প্লে গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে যারা বাইরে কাজ করেন না সেসব মায়েদের জন্য এটা হয়ে থাকে।
যেহেতু আমি চাকরি করতাম না তাই বাইরে বাচ্চা নিয়ে সময় কাটাতে এটা করতাম। এতে সবার একে অন্যের সঙ্গে পরিচয়, বিশেষ করে নিজের কমিউনিটির মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। বাচ্চারা আর মায়েরা উপভোগ করেন। প্লে গ্রুপে সরকারি ফান্ড থাকে আবার যারা যায় তাদের কাছে থেকেও কিছু ফি রাখা হয়। এখানে বাচ্চারা খেলাধুলা, রাইম করা, ছবি আঁকা, ক্র্যাফট করা ইত্যাদি করে। সবশেষে ফলমূল ও খাবার দেওয়া হয়। সেই প্লে গ্রুপে প্রতিটি টার্ম শেষ হওয়ার আগে পার্টি হয়, যেখানে ব্রিং এ প্লেট বাফেট চলে।
এখানে এসে প্রথমত সবার যেটা কষ্ট হয়, সেটা হলো পরিচিত মানুষ না পাওয়া। নিজের ভাষায় কথা না বলতে পারা। নিজের সমাজ সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন একটা সমাজে বাস করা। অনেকে কালচারাল শকে ভোগে। তা থেকেই প্লে গ্রুপ ও লাইব্রেরি ওয়ার্কশপ ইত্যাদিতে যুক্ত থাকতে অনেককে উৎসাহিত করা হয়। আর বড় পাওয়া হচ্ছে হারমনি ডে। যার মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজস্বতা প্রকাশ করি।