বন্ধুবরণ

ছবি ৫ মিলনমেলায় লেখককে ক্রেস্ট উপহার দিচ্ছেন তার বন্ধুরা
ছবি ৫ মিলনমেলায় লেখককে ক্রেস্ট উপহার দিচ্ছেন তার বন্ধুরা

মাস কয় আগে লন্ডন ঘুরতে গিয়ে একসঙ্গে অনেক বন্ধুবান্ধবের দেখা পেলাম। আমার ছোটবেলার বন্ধুবান্ধবদের শতকরা নব্বইজন এখন লন্ডনে বসবাস করে। অবাক বিষয় হলো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এরা সবাই কীভাবে কীভাবে যেন শুধু লন্ডনেই বসত গড়েছে। কারণটা হয়তো কেউ কেউ অনুমান করতে পারেন। তারা সব্বাই সিলেটের বাসিন্দা—মানে সিলেটী। আমার উৎসও সেই একই, তবে আমি কীভাবে কোনো এক বিচিত্র ধারায় পড়ে যেন সেই সমান্তরাল লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। এসে ঠেকেছি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে, এই বিচিত্র দেশ আমেরিকায়।

সিলেট জেলার বিশ্বনাথে কেটেছে আমাদের ছোটবেলা। বিশ্বনাথ থানার রামসুন্দর উচ্চবিদ্যালয়ে আমরা সবাই একসঙ্গে পড়ালেখা করেছি। এসএসসি পাস করার পর যেন আমাদের সময়ের খাঁচা খুলে যায়। আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ি বিভিন্ন জায়গায়। আমি নটর ডেম কলেজে ভর্তি হতে ঢাকায় চলে আসি। এরপর থেকে এই বন্ধুবান্ধবদের অনেকের থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। দিন যায়, জীবন গড়িয়ে যেতে থাকে সময়ের নিয়মে।
লন্ডনে বন্ধুদের সেই মিলনমেলায় কিছু কিছু বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে প্রায় বিশ থেকে বাইশ বছর পর। ওদের প্রথম দেখার অনুভূতিগুলো ভাষায় প্রকাশ করা যেন ভার। সত্যি করে বলছি, হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার সবকটা বন্ধুকে এতগুলি বছর পর একই জায়গায় একসঙ্গে দেখতে পেয়ে আমি এতটাই আনন্দিত ও শিহরিত হয়েছি যে, মনে হয়েছে যেন ফিরে গেছি সেই পুরোনো দিনগুলোতে।
স্মৃতির খাঁচায় বন্দী ছোটবেলার সোনালি সেই দিনগুলো মোদের। স্কুলের সেই পুরোনো বিল্ডিংয়ের পেছনে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে জম্পেশ আড্ডা, খুনসুটি, অকারণ ছোটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি। বিটিভিতে দেখা এর আগের রাতের নাটক নিয়ে তুমুল আলোচনা, উচ্চবাচ্য, অযাচিত ঝগড়া, হাস্যময় তর্কাতর্কি। এরই মাঝে ঘণ্টা পড়ার টিংটিং শব্দ শুনে ক্লাসের দিকে দৌড়।
লাঞ্চের বিরতিতে কোনো কোনো দিন বন্ধুরা মিলে হেঁটে হেঁটে বিশ্বনাথ বাজারের শেষ প্রান্তের রেস্তোরাঁয় চলে যেতাম, সেখানে বসে বসে আড্ডা। দুই টাকায় দুটি শিঙাড়া আর এক কাপ চা। আর পকেটে যদি দুই টাকার বেশি থাকে তো ভাসিয়া নদীর ছোট্ট সেতুটি পার হয়ে ওপারে গিয়ে ঠোঙা দোকানের সামনের ভাঙা বেঞ্চে বসে বসে গরম-গরম ছোলা বিরিয়ানি। আহা সেই সব দিনগুলি মোদের স্মৃতির সোনালি খাঁচায় বন্দী!
বিরতির সেই সংক্ষিপ্ত সময়ে রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়া আর আড্ডা শেষে যদি হাতে সময় থাকে তো, ওই যে আরেকটু হাঁটিহাঁটি করে এগোলেই সামনে গার্লস স্কুল! আমাদের স্কুল ছিল শুধু বয়েজ, গার্লস স্কুল আলাদা। বন্ধুরা মিলে কোনো কোনো দিন লুকিয়ে চুপিচুপি গার্লস স্কুলের সামনে দিয়ে হেঁটে আসতাম। ওখানে স্কুলের সামনের কমিউনিটিতে আমাদের কজন বন্ধুর বাসা। ওদের বাসা ঘুরে আসতাম আর গার্লস স্কুলের হাফ ওয়ালের সামনে দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে যাওয়া, ঘাড় বাঁকিয়ে একটু একটু তাকানো। এরপর ক্লাসে এসে মাওলানা স্যারের বকুনি! স্যারের কাছে কীভাবে কীভাবে যেন খবর চলে যেত আমাদেরকে আজ গার্লস স্কুলের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা গেছে!
ক্লাস নাইন টেনে ওঠার পর নিজেদের কেউকেটা মনে হতো। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তখন আমরা মাঝেমধ্যে সিলেট জেলা শহরে চলে যেতাম সিনেমা দেখতে। টিফিনের বরাদ্দ করা টাকা থেকে এক টাকা, দুই টাকা বাঁচিয়ে মাসান্তে যখন বিশ পঁচিশ টাকা জমা হতো, তখন আমাদের আর পায় কে! বন্ধুরা মিলে চম্পট মেরে দিতাম। সকালবেলা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সোজা মুড়ির টিন বাসে করে রওনা দিয়ে দিতাম সিলেটের উদ্দেশে। এসবই খুব চুপিসারে এবং গোপনীয়তার সঙ্গে করতে হতো আমাদের। বাসায় অথবা স্কুলের স্যাররা জানলে আমাদের কপালে খারাবি আছে। তবু পরদিন ক্লাসে রঞ্জিত স্যারের গম্ভীর কণ্ঠ, সুস্থির চাহনি, আর অবশেষে বকুনি। স্যারের কাছে খবর আছে আমাদের সিলেটে নন্দিতা সিনেমা হলের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা গেছে!

লেখক
লেখক

সেদিন লন্ডনের ব্রিকলেনে প্রায় কুড়ি বছর পর ছোটবেলার সেই বন্ধুগুলোকে দেখার পর আমি সেই সব স্মৃতিময় দিনগুলোর মাঝে হারিয়ে যেতে থাকি, স্মৃতির লেন ধরে পেছন দিকে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি আসে, ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি। ভাবতে অবাক লাগে এতগুলো বছর কেটে গেল কীভাবে!
সময়ের শাণিত চলা, তবু স্মরণীতে মরচে ধরে। অনেক বন্ধুদেরকে প্রথম দেখায় চিনতে অনেক সময় লেগেছে। স্মৃতির আঁকাবাঁকা গলিপথ ধরে একা একা হেঁটেছি পেছনে বহুদূর। তারপর, ও হ্যাঁ, তুই? তুই তো সেরকম খাটোটিই আছিস, একেবারে লম্বা হোসনি! আরে বন্ধু, তুই? সেই যে মনে আছে ক্লাসের ফাঁকের ঝগড়া! আরে তুই? তুই তো কোনো কারণ ছাড়াই আমার সঙ্গে রেগে যেতিস! আরে দোস্ত? সেই যে শুকিয়ে মরে যাওয়া ভাসিয়া নদীর তীরে বসে শান্ত পানিতে অকারণ ঢিল ছুড়তাম! আরে লম্বু? তোর কথাবার্তা তো সেরকম লাগাম ছাড়াই আছে রে! আরও কত কথা, আহা সময় যেন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে থাকে আমাদের পেছন ফেলে।
সময় গেছে বয়ে, জীবন এসে থেমেছে আজ এই নিরন্তর পথচলার মধ্যখানে। বন্ধুদের গল্প শুনি। কেউ ব্যবসায়ী, কেউ আইনজীবী, কেউ স্বনির্ভর, আজ আমরা সবাই যে যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। বন্ধুদের কেউ লেখক, কেউ কবি, কেউ নাট্যকার, কেউ গীতিকার, কেউবা অভিনেতা। কেউ কেউ টিভিতে প্রযোজনাও করে! সেদিন সবাই মিলে লন্ডনের ব্রিকলেনের এক ছোট্ট কমিউনিটি সেন্টারে হাউকাউ করে আনন্দে মেতে উঠি। ফিরে যাই আমাদের সেই সোনালি বাল্যকালে, খুঁজে ফিরি ফেলে আসা হারানো সেই দিনগুলি।
হই হুল্লোড়, হট্টগোল আর আমাদের ছেলেমি শোরগোল যখন শেষ হলো, তখন লন্ডনে প্রায় মধ্যরাত। পেটে খিদের নাড়াচাড়া। সেদিন বন্ধুদের মহা মিলনমেলায় বেশ ভূরিভোজেরও আয়োজন ছিল। বাসায় রান্না করা দেশি খাবারদাবার। খাসির রেজালা, মুরগির রোস্ট, সিলেটের সাতকরা দিয়ে ঝোল করে রান্না বোয়াল মাছ, বিফ কারি, বিভিন্ন রকমের শুঁটকির ভর্তা, ডাল, সবজি, আর দেশি চালের ভাত, বিরিয়ানি। সঙ্গে ছিল দেশি চালতা আর জলপাইয়ের আচার। খিদের মাঝে গরম-গরম খাবারদাবার আর আমাদের আড্ডা চলতেই থাকে।
আমার বন্ধুভাগ্য আসলে ভালো। ভালো বললে আসলে কম হয়, একটু বেশি ভালোই বলতে হয়। জীবনের প্রায় প্রতিটি স্তরেই গর্ব করার মতো আমি কিছু বন্ধু পেয়েছি। সেদিন লন্ডনে বন্ধুদের সবাই বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে জড়ো হয়েছিল শুধু আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য। কেউ কেউ তিন থেকে চার ঘণ্টা, কেউ কেউ সাত থেকে আট ঘণ্টা ড্রাইভ করে অন্য শহর থেকে এসেছে শুধু আমাকে দেখার জন্য। ওরা যখন বলে, দোস্ত, শুধু তোকে একটুখানি দেখার জন্য এসেছি, কত দিন দেখিনিরে! তখন আমি ভাষা হারিয়ে স্মৃতির বালুচরে সাঁতরাতে থাকি, স্থির দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকি ওদের দিকে!
রাত গড়াতে থাকে, সময়ের করাঘাত বন্ধুত্বের জানালায়। আমাদের সবাইকে উঠতে হবে। ছোটবেলার মতো আমরা এখনো হারিয়ে যেতে চাইতে পারি বটে, কিন্তু এখন আমাদের সকলের সংসার আছে, সন্তান সন্ততি আছে। হারিয়ে যেতে আছে তাই মানা!
সবার সঙ্গে বিদায় নেবার পালা। বাতাসে বিচ্ছেদের বিষণ্নতার সুর। এরই মাঝে আমাকে অবাক করে দিয়ে ওরা জানান দিল, এটা একটা বন্ধুবরণ অনুষ্ঠান। আমাকে এত দিন পর কাছে পেয়ে বরণ করে নেবার নিমিত্তে ওরা সবাই শত ব্যস্ততার মাঝেও আজ জড়ো হয়েছে। সবাই মিলে আমাকে অবাক করে দিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল একটি স্মৃতি স্মারক। বন্ধু যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস। স্মৃতির ক্যানভাসে আঁকা চির রঙিন আলপনার রঙ্গে রাঙা হয়ে থাকিস আজীবন।
বন্ধুরা আমার, তোরাও ভালো থাকিস যেখানেই থাকিস না কেন!

*লেখক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত।

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: ইমিগ্রেশনের বিড়ম্বনা