মায়ের কাছে খোলা চিঠি

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

মাগো, তোমার ছেলে আর সাহরিতে টের পায় না। শেষ রাতে কেউ হাত–পা ধরে টেনেও তোলে না ৷ প্রায় দিনই আমার সাহরি না খেয়েই রোজা রাখতে হয়৷ জার্মানির এই গ্রীষ্মকালীন ১৯ ঘণ্টার দীর্ঘ সময়ের তপ্ত রোজায় শুকনো গলায় কষ্ট পেলে কেউ আদর করে বলে না, বেশি কষ্ট হচ্ছে? কষ্ট বেশি লাগলে রোজা ভেঙে ফেলো৷

মোবাইলের অ্যালার্ম আমাকে মাঝরাতে ডেকে নিয়ে খাওয়াতে পারে না। দেশেও পারত না৷ মাগো তুমিই ছিলে আমার অ্যালার্ম ঘড়ি৷ পুরা পরিবারটারই অ্যালার্ম ঘড়ি৷ মাঝরাতে হাত–পা টেনে কেউ আর বিছানা থেকে নামিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসায় না গো, মা৷ মনে পড়ে মা, মাঝে মাঝে আমি ঘুমের মধ্যে চোখ বন্ধ করেই তোমার সামনে বসে থাকতাম আর তুমি ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতে৷ আমি খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে গেলে, সেই আধো খাওয়া এঁটো ভাতই হতো তোমার সাহরির আহার৷ তুমি হাতের তালুতে ঘষে সুন্দর করে ভাত মাখাতে পারতে। কী সুন্দর হলুদ তরকারীর ঝোলে সাদা ভাতের রং মিলিয়ে যেত। অথচ আমি এটা পারি না৷
তুমি কি জানো মা? এখন আমি ঘরে সব সময় কোক বা পেপসি কিনে রাখি। যেসব আমি রান্না করি, সারা দিন রোজা রেখে সেগুলো গলা দিয়ে শুধু শুধু নামাতে পারি না৷ অথচ তোমার রান্না সামান্য খারাপ হলে না খেয়ে থেকে তোমাকে কত শত কষ্ট দিয়েছি৷ খাবার ঠান্ডা হলেও কষ্ট দিয়েছি৷ অথচ এই আমি আজ কাউকে কোনো অভিযোগও করতে পারি না৷
রোজার মাসে প্রায়ই রাত একটা–দেড়টার দিকে ঘুম ভেঙে যেত। আমার ঘর তখনো অন্ধকার থাকত। পাশের ঘর পেরিয়ে একটু দূরেই ছিল আমাদের রান্নাঘর৷ আধো ঘুমে তখনো রান্না ঘর থেকে হাঁড়ি পাতিলের ঠুকঠুক শব্দ শুনতে পেতাম৷ বুঝতে পারতাম তুমি আমাদের সবার জন্য সাহরি রান্না করছ৷ তখনো তোমার কষ্টটা অনুভব করতে পারিনি৷ ভেবেছি, মায়েরা এমনই হয়৷ আমায় ক্ষমা করে দিয়ো মা। বিশ্বাস করো আমি এখন সব বুঝি৷ মাঝ রাতে না ঘুমিয়ে পাতিল মাজা থেকে শুরু করে প্লেট মাজার কষ্ট৷ আমি সবই এখন টের পাই৷
জানো মা, এই বিদেশে প্রতিদিনই আমি ভাবি কি রান্না করব, কি খাব। তুমি কীভাবে এত সব পারতে মা? বিরতিহীনভাবে আমাদের জন্য দৈনিক খাবারের মেন্যু তুমি কীভাবে ঠিক করতে? কী সেই বৈচিত্র্য খাবারের মেন্যুতে৷ একবারও মনে হয়নি একই জিনিস বারবার খাচ্ছি৷ তুমি যে কত বড় মাপের একজন সৃজনশীল মানুষ ছিলে, তুমি নিজেই জানতে না। তখন আমিও বুঝিনি গো মা৷ ভেবেছি মাতো, মায়েরা এমনি হয়! এখন আমি সব বুঝতে পারি৷ আমার হাতে যদি এখন পৃথিবীর সব থেকে দামি পুরস্কারটি থাকত, তাহলে আজ আমি সেটা তোমার হাতে তুলে দিতাম৷
মাগো তুমি তো জানো, আমি জার্মানিতে চাকরি করি। এখানে সপ্তাহে অফিস করি পাঁচ দিন আর বাকি দুই দিন ছুটি পাই। তুমি বিশ্বাস করবে না মা, ওই দুইটি দিন ছুটির জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করি৷ কিন্তু তুমিতো ছুটি পেতে না, মা৷ সপ্তাহের সাতটি দিনই তুমি পরিবারের ডিউটি করতে। তাও কোনো নির্দিষ্ট টাইম টেবিল ছিল না। চব্বিশটা ঘণ্টা তুমি ডিউটি করেছ৷ কীভাবে পারতে তুমি? অসুখ বিসুখেও দেখেছি তোমার রান্নার কোনো বিরতি থাকত না৷ গরম পানিতে ছ্যাঁকা লাগত, তেল ছিটে তোমার হাত পুড়ে যেত৷ আমার মনে আছে, তুমি পোড়া জায়গাতে চুন দিয়ে রাখতে। আমি তোমার দেখাদেখি কাটা জায়গাতে একদিন চুন দিয়েছিলাম, খুব যন্ত্রণা হয় মা৷ এটা খুব কষ্টের৷
মনে আছে মা? আমরা ইফতারের সময় গোল হয়ে বসতাম। আমি, আব্বা আর দাদা বসতাম খাটের ওপরে আর তুমি, মরিয়ম আপা, মলি আপা, হালিমা আপা মেঝেতে মাদুর পেতে বসতে৷ ইফতারের সময় আমি, আব্বা আর দাদার মাঝে বসতাম। তুমি চাইতে তোমার পাশে আমায় রাখতে৷ তোমার পাশে আমি কখনো বসতে চাইতাম না। তোমার শরীর থেকে কেমন যেন পেঁয়াজ আর মসলার উটকো গন্ধ আসত। আমায় ক্ষমা করো মা। আমি পেঁয়াজের গন্ধ সহ্য করতে পারতাম না৷ মাদুরের ওপর থেকেই তুমি প্রতিদিন নিজে না খেয়ে তোমার পাতের ছোলা, পেঁয়াজি, বেগুনি, কমলার কোয়া, কাটা আপেল, খেজুর হাত বাড়িয়ে আমার পাতে তুলে দিতে। আমি নির্লজ্জের মতো তোমার খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তুমি কেমন করে যেন বুঝে যেতে৷ আমি ইফতারিতে তোমার পাতের ওই সুস্বাদু খাবারগুলো খেতে খুব মজা পেতাম৷ তুমি সবই বুঝতে, তাই না?
আজ আমার ইফতারে কোনো তেলে ভাজা সুস্বাদু ইফতারি থাকে না৷ থাকে না কোনো ছোলার ঘুগনি বা মুড়ি৷ থাকে নানান রকম ফলের জুস ও ফল৷ এসব দিয়ে ইফতারি করে শরীরে হয়তো পুষ্টি পাই কিন্তু মুখে লেগে থাকা পুরোনো স্বাদটা অধরাই রয়ে যায়।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

তুমি জানো মা, আমার দুই হাতে এখন পেঁয়াজের গন্ধ লেগে থাকে৷ কতবার হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে পরিষ্কার করি, গন্ধটা যেতেই চায় না৷ রান্নার পর শরীরের মসলার উটকো গন্ধ দুর করতে গোসল করতে হয়৷ মাথার চুল শক্ত হয়ে যায় তেল মসলার বাষ্পে৷ গায়ে পারফিউম ব্যবহার করতে হয়। অথচ তোমাকে কখনোই পারফিউম ব্যবহার করতে দেখিনি৷ বিরক্তিকর হাতের গন্ধ এড়ানোর জন্য রাবারের গ্লাভস পরে রান্না করতে হয়, অথচ তোমাকে কখনো রান্নার সময় বিরক্ত হতে দেখিনি৷
মা তোমার এখন বয়স হয়েছে। মাগো তুমি এখন ডায়বেটিসের রোগী। মাঝে একবার তোমার ব্রেন স্ট্রোকও হয়ে গেছে। সবাই তোমাকে বৃদ্ধা বলে ডাকে৷ আমি বলি না মা, আমার সেই ছোট্টবেলার শক্ত সামর্থ্য মা–ই আছ আমার কাছে।
ছোটবেলায় রোজার দিনগুলোতে বাজার করা নিয়ে আব্বার মধ্যে যেই চঞ্চলতা আমি দেখেছিলাম তা আজ নিভে গেছে৷ এবার দেশে গিয়ে আব্বাকে দেখেছি সারা দিন জানালা দিয়ে বাইরে শূন্যে তাকিয়ে থাকতে। জানি না আব্বা আসলে শূন্যে কি দেখতেন। হয়তো অতীতের রঙিন দিনগুলোর কথা ভাবতেন৷ সেই অসহায় আব্বার সহায়ও এখন অসহায় তুমি৷
মাগো, রান্নাঘর থেকে তুমি ছুটি নিয়েছ৷ সৃষ্টিকর্তা তোমায় বাধ্য করেছেন ছুটি নিতে৷ আমি জানি, তুমি ছুটি নিতে চাওনি মা৷ তোমার বুকের হাহাকার আমি পাঁচ হাজার মাইল দূর থেকে এই শক্ত কংক্রিটের হালে শহর থেকেই টের পাই৷ তোমাকে মাঝরাতে আর সাহরি রান্না করতে হয় না৷ বাসায় আজ আমরা কেউ নেই। শুধু তুমি আব্বা আর মলি আপা৷
ইফতারে বসে আজ তুমি আনন্দ পাও না৷ নীরবে কাঁদো। আমি টের পাই মা৷ জানি না মলি আপা সাহরি ও ইফতারে আজ তোমাদের কি রান্না করে খাওয়াচ্ছে৷ আশা করি সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে ভালো থাকবে৷ শুধু দোয়া করবে তোমার ছেলের জন্য৷

মাহবুব মানিক: সায়েন্টিফিক রিসার্চার, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি৷