পরির সঙ্গে সাক্ষাৎ

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

রাত দুটোর পর এক পরির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পরি কোনো মানবী নয়। একদম ডানাসহ পরি। অনিন্দ্য সুন্দরী সেই পরি। যার সঙ্গে বন্ধু রবিনের প্রেম-ভালোবাসা। আমি, বিপু ও মানিক আমরা এখন রবিনদের ড্রয়িংরুমে রুমে বসে আছি। সেদিন মঙ্গলবার। রাত দুটো বাজবে। আমরা ঘর থেকে বের হবো পরি দেখার জন্য।

রবিনদের বাংলোর পেছন দিকে বেশ কিছুটা হেঁটে গেলে বিশাল এক কড়ই গাছ। সে গাছের ডালে পরি পা ঝুলিয়ে বসে থাকবে। আমরা ওপরের দিকে তাকিয়ে পরিকে দেখব ও সালাম দেব। এই হচ্ছে সেই রাতের আমাদের কর্মপরিকল্পনা। বন্ধু বিপু ও মানিক একটু ভিতু টাইপের। ওরা এই আয়োজনের বিপক্ষে। সমস্যা বেঁধেছে আমাকে নিয়ে। আমি জিদ ধরেছি পরিকে দেখব এবং সে অনুষ্ঠানে আমরা চার বন্ধুই উপস্থিত থাকব।
পরিদের কথা ছোটবেলা থেকেই আমি শুনছি কিন্তু দেখার সুযোগ হয়নি। তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আমার চাপে পড়ে ওরা সেদিন ওখানে এসেছে। এই সাক্ষাতের জন্য রবিন অনেক কষ্টে পরিকে রাজি করিয়েছে। কারণ পরিরা সবার সঙ্গে দেখা দেয় না। পরিকে রাজি করানোর জন্য রবিনকে নাকি পরির পা পর্যন্ত ধরতে হয়েছে। বুঝলাম মানুষ হোক বা পরি হোক, সকল মেয়েগুলি একই। সুযোগ পেলে সময় মতো ছেলেদের পা ধরিয়েই ছাড়বে।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

রবিন, মানিক, বিপু ও আমি ইমু—আমরা এই চারজন লালমনিরহাট সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। রবিন হচ্ছে আমাদের গ্রুপের অর্থমন্ত্রী। ওর বাবা রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। প্রচুর উপরি উপার্জন। সেসব টাকা পয়সা থেকে কিছু টাকা পয়সা রবিন সুকৌশলে বের করে আনে। যা দিয়ে আমাদের সারা দিনের চা-সিগারেটের খরচ চলে যায়। যে কারণে রবিনকে আমরা তিন বন্ধু খুবই পছন্দ করি। তবে মানিক আর বিপু শুধু রবিনকে পছন্দই করে না। সেই সঙ্গে কিছুটা ভয়ও পায়। কারণ আর কিছুই নয়, কারণ হচ্ছে ওই পরি।
বেশ কিছুদিন থেকে রবিনের সঙ্গে এই পরির সম্পর্ক। সে নাকি অনিন্দ্য সুন্দরী। মাথায় ঘন কালো লম্বা চুল। রবিনকে সে পাগলের মতো ভালোবাসে। আগে সব সময় রবিনের সঙ্গেই থাকত। কিন্তু এখন বাংলা সিনেমার মতো ওদের প্রেমের মাঝে এক ভিলেনের আবির্ভাব ঘটেছে। সে ভিলেন আর কেউ নয়। সে হচ্ছে রবিনের বাবা। তিনি মস্ত বড় এক হুজুরের কাছে রবিনকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই হুজুর তাবিজ দিয়েছেন। বলেছেন ওই তাবিজ সব সময় সঙ্গে রাখতে। তাহলে পরি কাছে ভিড়তে পারবে না। তবে রবিন ওই পরির প্রেমে এতই মশগুল যে, দিনেরবেলা বাবার ভয়ে তাবিজ পড়লেও রাতে ওই তাবিজ সে খুলে রেখে দেয়। কারণ পরির সঙ্গে বাসর কোন বোকা মিস করে!
এই পরি এক রাতে রবিনকে তার দেশে নিয়ে গিয়েছিল। রং-ঝলমলে সুন্দর সেই দেশ। চারদিকে শুধু রঙের খেলা। সুন্দর সুন্দর পরিরা রাস্তায় বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ হাঁটছে, কেউ উড়ছে। কেউ গান করছে, কেউ নাচ করছে। ফুলে ফলে ছেয়ে আছে চারদিক। সে সব দেখে রবিন তো মুগ্ধ। পরি অবশ্য ওকে বলেছিল, ওখানে থেকে যেতে। কিন্তু রবিন থাকতে চায়নি। কারণ কলেজে জাহানারা নামের এক মেয়ের সঙ্গে তার প্রেম ছিল। আর জাহানারাকে সে কষ্ট দিতে চায় না। পরি অবশ্য জাহানারার কথা জানে। জাহানারাও পরির কথা জানে। প্রথম প্রথম দুজনেই দুজনের ব্যাপারে জোর আপত্তি জানিয়েছিল। কারণ পরি হোক বা মানুষ হোক মেয়েরা সতিনের সঙ্গে থাকতে রাজি নয়। পরে অবশ্য দুজনই দুজনকে মেনে নিয়েছে।
রবিনদের বাসাটা ব্রিটিশ আমলে তৈরি রেলওয়ের একটা দোতলা বাংলো। লাল ইটের তৈরি। বিশাল এরিয়া নিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাউন্ডারি দেওয়া। ভেতরে এত গাছগাছালি যে দিনেরবেলায়ও পর্যাপ্ত আলো পৌঁছে না। গা ছমছমে একটা পরিবেশ। দেখলেই মনে হয় এটা লালমনিরহাট জেলার জিন, পরি, ভূত ও পেত্নিদের জেলা সদর দপ্তর।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

বাসার দোতলায় রবিনের বাবা-মা ও বোন ঘুমিয়ে আছে। আর আমরা নিচতলায় পরির আগমনের অপেক্ষা করছি। এ বাসার অন্য কেউ জানে না আজ আমরা কোন কারণে একত্র হয়েছি।
রবিন বলল, চল আমার বেডরুমে, একটা জিনিস দেখবি।
আমরা ওর বেডরুমে ঢুকলাম। তীব্র ফুলের গন্ধে সারাটা রুম মৌ মৌ করছে। পরিপাটি করে সাজানো সবকিছু। টেবিলের ওপর একটি প্লেটে কয়েকটি মিষ্টি রাখা।
—গতকাল রাতে পরি এসেছিল। দেখ ওর গায়ের গন্ধ এখনো পুরোটা রুম ভরে আছে। রবিন বলল।
—কি কইতাছোস দোস্ত? এত সুন্দর গায়ের গন্ধ! আর ওই মিষ্টি কার জন্য?
মিষ্টিগুলি দেখিয়ে রবিনকে প্রশ্ন করলাম আমি। মিষ্টি দেখলেই আমার জিভে পানি এসে যায়।
—খেলে খা। পরি গতরাতে আমার জন্য এনেছিল। রবিন বলল।
এ কথা শুনে বিপু ও মানিকের মুখ আতঙ্কে শুকিয়ে গেল। ওরা কিছুতেই পরির আনা মিষ্টি খাবে না। তবে আমার চাপে পড়ে দুজনে দুটি মিষ্টি হাতে নিল।
মিষ্টি মুখে দেওয়ার আগ মুহূর্তে রবিন বলে উঠল, আমি কিন্তু ওই মিষ্টি খাইনি। কারণ পরি জাদুর মাধ্যমে গোবর দিয়ে ওই মিষ্টি বানিয়েছে।
এ কথা শুনে দুজনেই মিষ্টি প্লেটে রেখে দিল। ওরা খাবে না। কিন্তু আমারতো খেতে হবে, মিষ্টি বলে কথা। টুপ করে একটা মিষ্টি মুখে দিলাম। অসাধারণ। গোবরের মিষ্টি এত সুস্বাদু! সম্ভবত এই পৃথিবীতে আমিই একমাত্র সৌভাগ্যবান, যে গোবরের তৈরি মিষ্টির স্বাদ গ্রহণ করছি। সুযোগ পেলে পরির কাছ থেকে গোবর থেকে মিষ্টি তৈরির রেসিপিটা জানতে হবে।
ঘড়িতে তখন রাত দুইটা। রবিন বাংলোর বাইরের সব বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। কারণ পরিরা আলোকে এড়িয়ে চলে। আমরা ঘর থেকে বের হলাম। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখের সামনে নিজের হাত ধরলেও দেখা যাচ্ছে না। দূরে কোথাও একটা কুকুর করুণ স্বরে ডাকছে। গা ছমছমে অবস্থা। মানিক অনবরত আয়াতুল কুরছি পড়ে যাচ্ছে। বিপুর মুখ থেকে কেঁপে কেঁপে আওয়াজ বের হচ্ছে। কিন্তু কি পড়ছে বোঝা যাচ্ছে না। সম্ভবত কোনো দোয়া পড়ছে। আমরা একে অপরের হাত ধরে হাঁটছি। মাঝে মাঝে পায়ের তলায় শুকনো পাতা পড়লেই মচমচ করে আওয়াজ করছে। বিপু হঠাৎ করে ‘ও মারে’ বলে চিৎকার করে উঠল।
—ওই ব্যাটা এখানে মা পাইলি কই? কি হইছে? আমি ধমকের সুরে বললাম।
—হারামজাদা আমি ভয়ে মরি, আর তুই আমার লগে মজা লস। মনে হলো কি যেন আমার পায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে গেল। বিপু বলল।
—দোস্ত আমার হাত ছাড় আমি যামু না। মানিক বলে।
—চল ফেরত যাই। রবিন কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে।
—চুপ কর শালারা। এত দূর আইসা ভাবির লগে দেখা না করে যামু না। আচ্ছা রবিন আমি বুঝলাম না, ওরা ভয় পায় সেটা ঠিক আছে, কিন্তু তুই ভয় পাইতাছোস ক্যা। আমি রবিনকে উদ্দেশ্য করে বলি।
—আমিও বুঝতাছি না। রবিন বলে।
সবাই মিলে কড়ই গাছের নিচে দাঁড়ালাম। আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সবাই মাটির দিকে তাকিয়ে থাকবে। পরি অনুমতি দিলে রবিন আমাদের বলবে। আমরা ওপরের দিকে তাকাব।
—আমার চোখ বন্ধ। আমি দেখব না। ভয়ে বিপুর কণ্ঠ কাঁপছে।
—আমিও দেখব না। মানিক বলে।
—কিরে রবিন সিগনাল দে। তাকামু? বলে রবিনের উত্তরের অপেক্ষা করছি।
কোনো সাড়া নেই। পর পর কয়েকবার রবিনকে ডাকলাম কোনো কথা বলছে না। কি আর করা। অনুমতি না নিয়েই ওপরের দিকে তাকালাম। তাকিয়ে পরিকে উদ্দেশ্য করে টেনে টেনে বললাম, আ-সা-লা-মু-আলাইকুম। কাইফা হালুকা। হাউ আর ইউ, আফা শরীলডা ভালা।
পরিরা কোন ভাষায় কথা বলে তা তো আর জানি না। তাই বাংলা-ইংলিশ-আরবি মিলিয়ে বললাম। পরির কাছ থেকে সালামের উত্তর পাওয়ার আগেই কোরাসে শুনতে পেলাম, লা ইলাহা ইল্লা আনতা (ধপাস করে একটি আওয়াজ)। আরেকটি কণ্ঠে, লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবাহনাকা ইন্নি (ধপাস করে আরেকটি আওয়াজ)। মানে এই কণ্ঠটাও পুরো দোয়াটা শেষ করতে পারল না। এদিকে কে যেন ওরে মারে বলে দৌড়ে চলে গেল।
তবে আশপাশে কি হচ্ছে সেটা আমার কাছে মোটেই মুখ্য না। আমি পরির কাছ থেকে সালামের উত্তর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম কিন্তু চারদিকে কারও কোনো সাড়া শব্দ নেই। এদিকে সিগারেটের তেষ্টা পেয়েছে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালাম। বড় করে একটা টান দিলাম। লাইটারের আলোয় দেখলাম, দুই মটকু মানিক আর রবিন মাটিতে পড়ে আছে। সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছে। পাতলাখান বিপুকে আশে পাশে দেখলাম না। সম্ভবত দৌড় দিয়ে ওই উজবুকটাই পালিয়েছে।
ইচ্ছে হচ্ছে ভিলেনের মতো একটা হাসি দিই। কিন্তু বন্ধুদের বিপদে এইভাবে অট্টহাসি দেওয়াটা মনে হয় ঠিক হবে না। তাই মুচকি একটু হাসলাম। প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছে। পরির সঙ্গে কথা বলতে আর ইচ্ছে করছে না। দুই মটকুকে ওঠানোর চেষ্টা করলাম। উঠল না। তারা এখন গভীর ঘুমে। এই দুই মটকুকে কাঁধে করে নেওয়াও আমার কম্ম নয়। তাই ওদের ফেলে একাই ফিরলাম। রবিনের বেডরুমে ঢুকতেই আবার সেই তীব্র ফুলের গন্ধে মন ভরে গেল। খিদে পেট চোঁ চোঁ করছে। গোবরের বাকি মিষ্টিগুলো শেষ করলাম। বিছানায় শুয়ে লাইট বন্ধ করে দিলাম। বলাতো যায় না, হয়তো সালামের উত্তর দেওয়ার জন্য পরি চলে আসতে পারে। লাইট থাকলে তো আর আসবে না। চোখ জুড়ে ঘুম নামছে। মনে হলো একটা গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়ি। গুন গুন করে গান ধরলাম, আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী...সাথি মোদের নীল পরি...নীল পরি লাল পরি...।
বি. দ্রষ্টব্য: আল্লাহ মানুষকে সর্ব শ্রেষ্ঠ করে বানিয়েছেন। অতএব জিন, পরি, ভূত, পেত্নি এদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এরাই মানুষকে ভয় পাবে। আমরা নই।