নানান রঙের মানুষেরা

লেখিকা
লেখিকা

গেলবারের সামার থেকে এবারের সামারে তেমন কিছুই করা হচ্ছে না। সেবার ক্যাম্পিং, মাছ ধরা, হাইকিং, কেনয়ি—কত কিছু করলাম। এবার সেসবের ধারে কাছেই নেই। কোর্সের ক্লাস, থিসিস, রান্না—এসব করেই দিন কেটে যাচ্ছে দ্রুত। ভাবলাম এবার না হয় কাছে পিঠেই কোথাও থেকে ঘুরে আসি। যেই ভাবা সেই কাজ।

ডিপার্টমেন্টের এক বাঙালি বড় ভাইকে নিয়ে ফারগো থেকে ঘণ্টাখানেক দূরে পার্চ লেকের উদ্দেশে রওনা হলাম দুপুরের দিকে। আমার এখানকার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। আবার জায়গা থেকেও মানুষগুলো বেশি প্রিয় বোধকরি। ওখানে আমার আমেরিকান দাদা-দাদির ভ্যাকেশন হাউস। ছায়াঘেরা ঘন জঙ্গলের মাঝখানে চমৎকার কাচঘেরা ডুপ্লেক্স লেক হাউস।
এরা কোনো বিচিত্র কারণে লোকালয় থেকে দূরে গিয়ে একটু নির্জনতায় থাকতে পছন্দ করে। তাই যাদের সাধ্য আছে তারা একটু নির্জনতা খুঁজে নিতে দ্বিধা করেন না! আমার এই দাদা-দাদির সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশীও লেকের অন্য পাড়ে থাকেন। আশপাশে কোনো গ্রোসারি স্টোরও নেই। তাই যে কয়দিন ওখানে থাকা হয় প্রয়োজনীয় রসদ নিয়েই যেতে হয়।
এবার চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে বেরিয়েছি। গাড়ি পার্ক করে নামতেই দেখা গেল জিন বরাবরের মতো হালকা রঙের পোলো শার্ট আর অফ হোয়াইট শর্টস পড়ে আমাদের জন্য দরজায় অপেক্ষা করছে। পরনে সাদা রিমলেস কাচের চশমা আর এর সঙ্গে তার চিরাচরিত মিষ্টি হাসি ঠোঁটের কোণে। জ্যানকেও পেছনে দেখা গেল পরনে জিনের কাছাকাছি রকমের পোশাক আর জিনের সঙ্গে মিলিয়ে পরা চপ্পল। আমাদের দেখে যারপরনাই খুশি। ঘরে ঢুকতেই অরেঞ্জ জুস আর ওয়াইন অফার করল। আমরা অরেঞ্জ জুসই নিলাম। জিন জানাল, বাড়িতে আরও মেহমান রয়েছে। বিসমার্ক থেকে এক পরিবার এসেছে। তারা সাত মাইল দূরের ডেট্রয়েট লেকে গেছে। চলে আসবে সন্ধ্যা নামবার আগেই।
অবাক হয়ে দেখলাম জিন চুলায় রান্না বসিয়েছে। মেনু রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার মতো। এ যে বাসমতি চালের বিরিয়ানি! মাংসের বদলে মাশরুম দেওয়া। আমি ইমপ্রেসড। ৮টা না বাজতেই মেহমানেরা চলে আসল। পরিচয় দিলাম এবং পরিচিত হলাম। বেশ লাগল তাদের। কিন্তু কোথাও যেন একটু খটকা মতন লাগল।
বেশ খানিকটা সময় আড্ডা দেওয়ার পর বুঝতে পারলাম, এদের পাঁচজনের পরিবারের সবাই যার যার থেকে আলাদা। কারও সঙ্গে কারও কোনো মিল নেই। মা মিলি সিঙেল মাদার। বড় ছেলে স্যামি। তারপরে জোয়ি (জোসেফ থেকে সংক্ষেপে)। তারপর আনার (অনেকটা বাঙালি নাম)। আর সবচেয়ে ছোট দুই বছরবয়সী হাভানা!
এখানে নাম সংক্ষেপের নানা কায়দা। যেমন যার নাম উইলিয়াম তাকে এরা ডাকবে বিল। যার নাম রবার্ট তাকে ডাকবে বব। কত যে বব আর বিল পাওয়া যায় আশপাশে তার ইয়ত্তা নেই। যেখানেই যাই সবার নাম ডেভিড। স্কুলে আমার ডিপার্টমেন্টে নিদেনপক্ষে ৫ জন ডেভিড নামে আছে। আরেকবার এক জেসাস ফ্যামিলির সঙ্গে দেখা। তাদের মেয়ের নাম মারিয়াম আর ছেলের নাম মোজেস!

নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি ভবন
নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি ভবন

এক কথায় স্যামি চমৎকার ও হাস্যোজ্জ্বল। জোয়ি একটু বেশিই শান্ত। আনার একটু দুষ্ট আর হাভানা সবাইকে ছাড়িয়ে দস্যি মেয়ে।
ইতস্তত লাগার পরও জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, তোমরা সবাই দেখতে আলাদা কেন?
মুচকি হেসে মিলি বলল, আমি ঠিক এই প্রশ্নের অপেক্ষা করছিলাম। হয়েছে কি এদের মধ্যে শুধু জোয়ি আমার নিজের সন্তান। যদিও সে আমার মতো দেখতে হয়নি। কারণ তার জন্ম হয়েছে হাইতিতে। আমি তখন হাইতি ছিলাম। বাকিদেরও আমি নিজের বাচ্চা থেকে কম কিছু ভাবি বলে ভুল করো না। স্যামিকে আমি হাইতি থেকে অ্যাডপ্ট করেছি। বাকি দুজন আনার আর হাভানা ভাই বোন। কিন্তু তাদের মা এক হলেও বাবা আলাদা। তারা দুজনই ফস্টার কিড। দুজনেরই বাবা ও মা জেলে। আর তারা তাদের সন্তানের দেখাশোনায় অপারগ। তাই এদের দুজনকেও এক বছরের জন্য নিয়ে এসেছি। এক বছর পর এদের দাদা দাদির কাছে ফেরত দিতে হবে। এসব কিছু নিয়েই আমার ছোট্ট সুখী পরিবার। আমরা সবাই সবার বন্ধুর মতো। সবাইকে সবাই দেখে রাখি।
ডিনারে হ্যাম বার্গারে কামড় দিতে দিতেই গল্পের মতো করে সব বর্ণনা করছিল মিলি। কাচঘেরা পোরচে বসে বাইরের লেক ভিউ দেখতে দেখতে আর বিরিয়ানি খেতে খেতে তার পরিবারের গল্প শুনতে বেশ লাগছিল।
বলতে ভুলে গেছি বিরিয়ানিটা কিন্তু মন্দ হয়নি একেবারে দেশি স্বাদ। সঙ্গে অবশ্য একটু কাচা পেঁয়াজ আর লঙ্কা হলে মন্দ হতো না। চাইতে কেমন যেন লাগছিল। তাই আর চাইলাম না।
অল্প সময়েই হাভানার সঙ্গে বেশ জমেছে আমার। সে কোলে উঠে কাডল করতে ভালোবাসে। বারবারই দৌড়ে আমার কোলে চলে আসছিল। বিকেলটা ভালোই কাটল ওখানে। কিন্তু এবার যাওয়ার পালা। যাওয়ার কথা শুনতেই হাভানা আমার কোলে উঠে এসে বলল, লেটস গো। মাকে বলল, বাই মামি।
আমি বললাম, আমি তো ফারগো যাব।
হাভানা আধো আধো বুলিতে বলল, লেটস গো টু পেরগও!
কোল থেকে হাভাসাকে নামাতেই কান্না জুড়ে দিল। কিছুতেই থামান যায় না তাকে। সে ফারগো যাবেই যাবে। ওভাবেই কোনোমতে বিদায় নিয়ে নিজের শহরে ফিরে আসলাম আবারও এক ঘণ্টার ড্রাইভ করে। চমৎকার একটা সামারের দিন এভাবেই শেষ হলো চমৎকার কিছু মানুষের সঙ্গে!

*জিনাত রেহানা: নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি, নর্থ ডাকোটা, যুক্তরাষ্ট্র।