নতুন বউ, পাসপোর্ট ও একটি বেওয়ারিশ ফোন

স্ত্রীর সঙ্গে লেখক
স্ত্রীর সঙ্গে লেখক

জার্মানি থেকে এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে ছুটে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল একটাই। বয়স বেড়ে চলেছে তাই উপযুক্ত সময়ে বিয়েটা সম্পন্ন করা৷ তখন ধরতে গেলে জার্মানিতে আমার নতুন চাকরি৷ মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সে পলিমার ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণা সেক্টরের বৈজ্ঞানিক গবেষক (পিএইচডি)৷ তখনো গবেষণায় আমার মেধা অপরিপক্ব৷ অধ্যাপকের কাছ থেকে এক মাসের ছুটিও নিয়েছিলাম। ছুটির কারণ দেখিয়েছিলাম ভ্যাকেশন ফর ওয়েডিং৷ আমার অধ্যাপক আবার খুব মিশুক মানুষ। সুশ্রী ভদ্রমহিলার বয়স আনুমানিক ৫০ বছর৷ অধ্যাপকের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই অনলাইনে চ্যাট হতো। আমাদের দেশ এবং দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কৌতূহলী মানুষ তিনি৷ আমাকে অনেক স্নেহ করেন৷ কাজেই ছুটি পেতে খুব একটা অসুবিধা হলো না৷

প্রায় তিন বছর পর আমার দেশে ফেরা৷ ঢাকায় পৌঁছে বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়েই খুব শখ হলো ঢাকা শহরটা ঘুরে দেখব৷ দেশের মানুষ দেখব, ব্যস্ত রাস্তা দেখব, মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকান দেখব, চায়ের দোকানের চা পান করা মানুষগুলো দেখব, ফুটপাথের দোকান দেখব৷ যা ভাবা তাই কাজ। ট্যাক্সি ক্যাবে করে চলে গেলাম কাওলার রেলগেট থেকে কারওয়ান বাজারের কাছে। ট্যাক্সি থেকে নামার সময় অজ্ঞাতে ট্যাক্সিতে আমার শখের স্যামসাং এস সেভেন মোবাইল ফোনটা রেখেই নেমে গেলাম। যখন পকেট হাতড়ে টের পেলাম পকেটে ফোন নেই ততক্ষণে ট্যাক্সি বহু দুরে চোখের সীমানা পেরিয়ে চলে গেছে।
আমার তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। চোখ তখন শূন্যে। দীর্ঘ পনেরো ঘণ্টা প্লেন জার্নি করে শরীর তখনো ক্লান্ত। চোখে মুখে ঘুম ঘুম ভাব৷ চোখের সামনে দিয়ে সাই সাই করে ছুটে চলা সিএনজি আর প্রাইভেট কারের দিকে তাকাতে মনে হচ্ছিল একেকটা অস্পষ্ট জেট বিমান ছুটে চলেছে৷ আশপাশের মানুষগুলো সবাই ব্যস্ত। কারও দিকে ফিরে তাকাবার সময় নেই৷ পকেটে তখনো আমার হাত ঢোকানো। কি করব? ট্যাক্সি যেদিকে গেছে সেদিকে দৌড় দেব, নাকি ফোনের আশা ছেড়ে দেব? ফোনটা জার্মানিতে কন্ট্রাক্টে কেনা। এখনো দাম শোধ করতে পারিনি। পুরোটা শোধ করতে দুবছর লেগে যাবে৷
হঠাৎ কি মনে করে ফুটপাথ ছেড়ে মেইন রোড ধরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আশপাশের সিএনজি-মিনিবাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জোরে দৌড় শুরু করলাম। আশপাশের মানুষদের লক্ষ্য করলাম। তারা এবার ব্যস্ততা ভেঙে আমার দিকে তাকিয়ে। তারা সেদিন হয়তো নতুন কিছু দেখছে, অদ্ভুত কিছু দেখছে৷ তখন আমি জিনস টিশার্ট পরা উসাইন বোল্ট৷
সৃষ্টিকর্তা সেদিন কপালটা হয়তো ভালো রেখেছিলেন। ঢাকার দুর্বিষহ ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে এটা ছিল একটা ভালো দিক। চুরি করে পালিয়ে যাওয়ার পথ বের করা বড়ই শক্তের কাজ৷ দৌড়ে অনেক দুরে যেতেই দেখি অনেকগুলো ট্যাক্সি, মিনিবাস, সিএনজি জ্যামে আটকে আছে। ঘুরে ঘুরে ট্যাক্সির সন্ধান করছিলাম৷ চালকের চেহারা আমার মনে নেই। দুই-একবার লুকিং গ্লাসে দেখেছিলাম। গায়ের রং কালো। চেহারার গড়ন ভুলে গেছি। আসলে পৃথিবীতে মনে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস অনেক কিছুই আছে। তার তুলনায় ট্যাক্সির চাণকের চেহারা মনে রাখার ব্যাপারটা আমার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে হয়নি।
গায়ে হলুদ চেক টিশার্ট, তার টিশার্টের রং আর গাড়ির বাহ্যিক চেহারা মেলানোর অক্লান্ত চেষ্টা করছিলাম। গোটা পঞ্চাশেক বিভিন্ন চেহারা ও আকৃতির গাড়ির মাঝে শতভাগ মেলানো সত্যিই দুষ্কর ছিল৷ গাড়িগুলো তখন জ্যাম কাটিয়ে এগোনোর জন্য উৎকণ্ঠিত। মিনিট পাঁচেক খোঁজার পরে, অবশেষে একটা ট্যাক্সি দেখে সন্দেহ হলো। চালকের গায়ে লক্ষ্য করলাম হলুদ চেক টিশার্ট৷ তার সিট বরাবর যেতেই দেখি ড্রাইভার আমার ফোন তার কোলে নিয়ে তৃপ্তিসহ বসে আছে। ফোনের তখন পাওয়ার অফ। নিজের পরিচিত ফোনটা চিনতে আমার বেগ পেতে হলো না৷
জানালায় টোকা দিতেই বেচারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। হয়তো বিশ্বাস করতে পারেনি, এত বড় শহরে একলা আমি এত দুরে অলৌকিকভাবে চলে আসতে পারব৷ ভূত দেখার মতো চেয়ে রইল৷ ঘোর কাটিয়ে ভয়ার্ত চোখে বলল, ফোনটা নিয়া আপনারেই খুঁজতা ছিলাম। যদিও তার কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল পেলাম না৷ চালক খুব ভয় পেয়েছিল। হয়তো ভাবছিল লোকজন ডেকে ধোলাই টোলাই দিই কিনা৷ যা হোক, তাকে আর কিছু বললাম না, ওই যাত্রায় কোনো রকমে ফোনটা নিয়ে চলে আসলাম৷
তীব্র শীতের দেশ থেকে ভ্যাপসা গরমের দেশে নেমে এক সপ্তাহ কেটে গেল আবহাওয়া ও প্রকৃতির সঙ্গে শরীর মানিয়ে নিতে৷ প্রথম কয়েকটা দিন আসলেই অনেক কষ্টের ছিল। রাস্তার অতিরিক্ত ধুলা, রোদের তীব্র উত্তাপ আর ভ্যাপসা গরমে যথেষ্ট কষ্ট পাচ্ছিলাম৷ আস্তে আস্তে সব মানিয়ে নিয়ে বুঝতে পারলাম, এই চিরচেনা আলো বাতাস গায়ে লাগিয়েই আমি ছোট থেকে বড় হয়েছিলাম৷
এদিকে আমার বিয়ের প্রস্তুতি চলছিল৷ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো স্বল্প সীমাবদ্ধতার মধ্যে মোটামুটি আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিল৷ বিয়েতে আনুষ্ঠানিকতা বলতে সবকিছুই খুব সাধারণ মানের ছিল। তবে উল্লেখ করার মধ্যে যেটা ছিল তা হলো, বিশ জন মতো অনাথ শিশুকে আমার নিমন্ত্রণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল৷ বিয়ের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পেয়ে তাদের নিষ্পাপ মুখের হাসিটা আজও মস্তিষ্কে জায়গা করে নিয়েছে। স্বপ্ন আছে তাদের জন্য জীবনে কিছু একটা করার৷ সাধ্যের মধ্যে কিছু৷
দেশে ভোগান্তির শুরুটা ছিল বিয়ের পর থেকে৷ নতুন বউকে শিগগিরই জার্মানিতে নিয়ে আসতে হবে৷ আমি জার্মানি থেকে সকল কাগজপত্র প্রস্তুত করেই দেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম৷ বড় সমস্যা দেখা দিল বউয়ের পাসপোর্ট না থাকায়৷ কালবিলম্ব না করে বিয়ের পর দিনই কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ছুটে গেলাম জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট করার জন্য৷ ব্যাংকে জরুরি পাসপোর্টের অতিরিক্ত টাকা জমা দিয়ে ফরম পূরণ করে জমা দিয়ে সেদিনই ছবি তুলে পাসপোর্ট করার প্রাথমিক কাজ শেষ করে ফেললাম৷ তবে জীবনের সব থেকে বড় ভুলটা সেদিনই করেছিলাম৷ ভুলটা ছিল বউয়ের দুই ঠিকানা ব্যবহার করা৷ স্থায়ী ঠিকানা নওগাঁতে আমার শ্বশুরের এবং বর্তমান ঠিকানা কুষ্টিয়া চৌড়হাসে আমাদের নিজ বাসার ঠিকানা৷
বাংলাদেশে সব থেকে বিরক্তিকর ও হয়রানিমূলক জিনিসটা সম্ভবত পুলিশ ভেরিফিকেশন৷ কুষ্টিয়ার বাসাতে পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা আসলেন। এসে বাসায় ফ্যানের বাতাসে বসে নানান রকমের গল্প শোনালেন। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার বিভিন্ন প্রতিবাদের গল্প। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার সোচ্চারের গল্পও শোনালেন৷ তবে সব শেষ করে বিদায়ের মুহূর্তে তিনি আমাকে হতবাক করে তার পুরোনো খাসলতবশত আমার কাছে তার মোটরসাইকেলের তেল খরচ বাবদ কিছু টাকা চেয়ে বসলেন৷ কথা না বাড়িয়ে তাকে পাঁচ শ টাকার একটা নোট চার ভাঁজ করে দিয়ে দায় মুক্ত হলাম৷
তত দিনে দশ দিন পেরিয়ে গেছে৷ পাসপোর্ট সংক্রান্ত কোনো খুদে বার্তা তখনো আমার বউয়ের মোবাইলে আসেনি৷ কৌতূহলবশত পাসপোর্ট অফিসে ছুটে গেলাম৷ তারা জানাল পুলিশ রিপোর্ট পৌঁছেনি৷ তাহলে কি করতে হবে? এবার খোঁজ নিতে হবে ডিএসবি অফিসে। নতুন বউয়ের সামনে দুই দফা তল্লাশি ও মেইন গেটের কনস্টেবলের প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে ডিএসবি অফিসের বারান্দায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকলাম। কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই খুব ব্যস্ত। কেউ গরমে তরমুজ খাওয়ায় ব্যস্ত আবার কেউ পুরোনো ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া ফাইলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু খোঁজায় ব্যস্ত ছিল৷ দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরে জানতে পারলাম নওগাঁ থেকে তখনো পুলিশ রিপোর্ট এসে পৌঁছেনি৷
নতুন বউয়ের সামনে খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। বউ হয়তো ভাবছিল, আমার থেকে পুলিশের একজন কনস্টেবলও বিয়ে করা ভালো ছিল। যেমন তাদের কথার তেজ, গুরুগাম্ভীর্য কণ্ঠস্বর। সব কথাতেই কেমন যেন হম্বি তম্বি ভাব, দেখলেই মনে হয় তারা পৃথিবীতে ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিয়ে জন্ম নিয়েছেন৷ নওগাঁতে তৎক্ষণাৎ ফোন করে জানা গেল কুষ্টিয়া থেকে তদন্তজনিত কোনো ফ্যাক্স তারা পায়নি৷ অথচ কুষ্টিয়া অফিস থেকে আমাকে ফ্যাক্সের কপি দেখানো হলো যে, তারা পাঠিয়েছে৷
আজও অবধি আমার কাছে অজানা নওগাঁ অফিস কেন কোনো ফ্যাক্স পায়নি। ফ্যাক্সের কাগজটা তাহলে কোথায় হারিয়ে গেল?
যা হোক, আবারও নওগাঁতে ফ্যাক্স করা হলো আমার সামনে বসে৷ এবার ফোন করে জানা গেল হ্যাঁ, এবার তারা ঠিকই ফ্যাক্স পেয়েছেন৷ আবারও অপেক্ষার পালা। তত দিনে বাংলাদেশে আমার থাকার সময় শেষ হয়ে আসছে৷ ঠিক পনেরো দিন পরে বউকে সঙ্গে নিয়ে আবারও আমি গেলাম পাসপোর্ট অফিসে৷ পুলিশ রিপোর্ট তখনো আসেনি৷ নওগাঁতে ফোন করা হলো। জানাল, তারা রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছে৷ বউয়ের সঙ্গে আবারও কুষ্টিয়া ডিএসবি অফিসে ছুটে গেলাম৷
বউয়ের সামনে আবারও দুই দফা তল্লাশি, নানাবিধ প্রশ্নোত্তর পর্ব৷ এবার মেইন গেটের কনস্টেবল আমাকে সন্দেহজনক তালিকাতে ফেলে দিল। কনস্টেবল বলে বসল, অফিসে যার কাছে যাবেন তার কাছে ফোন দ্যান। আমি বললাম কারও কাছেই যাব না। পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজ আছে। এবার ডিএসবি অফিসে গিয়ে জানা গেল তারা কোনো ফ্যাক্স পায়নি৷ তারা বুদ্ধি দিল নওগাঁতে ফোন করেন। এখনই ওখান থেকে ফ্যাক্স করতে বলেন৷ তাদের কথার ভাব দেখে মনে হলো নওগাঁর ওই তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার কথায় ওঠেন আর বসেন৷
পরবর্তীতে আবারও নওগাঁতে অনুরোধ করা হলো ফ্যাক্স করার জন্য৷ পরের দিন ফোন করে জানা গেল, তারা ফ্যাক্স করতে গিয়ে কুষ্টিয়ার ডিএসবি অফিসের নম্বর ব্যস্ত পেয়েছে। আবার বলে লাইন ঠিক নাই৷ কুষ্টিয়া অফিস বলে তাদের ফ্যাক্স মেশিন, ফোন লাইন সব ঠিক আছে৷ নওগাঁ-কুষ্টিয়ার এই লড়াইয়ের মাঝে আমি বেচারা বলির পাঁঠা৷ অবশেষে আশাহত হয়ে বাসায় ফিরে এলাম৷
পরদিন নওগাঁর তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এক হাজার টাকা উপঢৌকন দিয়ে রিপোর্ট নিয়ে শ্বশুর মশায় আমার ব্যক্তিগত ইমেইলে তা মেইল করার ব্যবস্থা করেন। সেই পুলিশ রিপোর্ট প্রিন্ট করে ডিএসবি অফিসে আবারও দুই দফা তল্লাশি ও প্রশ্নোত্তর পর্ব সেরে জমা দিয়ে এলাম৷ ততক্ষণে আমার আনুমানিক হাজারখানিক টাকা রিকশা ভাড়া বাবদ খরচ হয়ে গেছে। সেটা নওগাঁ আর কুষ্টিয়ার ডিএসবি অফিস জানে না৷ তাদের জানার এত ঠেকাও নাই৷ তারা ব্যস্ত মানুষ কতদিকে আর খেয়াল রাখা যায়৷
আবারও ফিরে আসি আমার শখের স্যামসাং এস সেভেন মোবাইল ফোনটাতে৷ নতুন বউয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। বেড়ানো শেষ করে ট্রেনে করে কুষ্টিয়াতে ফিরব। সান্তাহার স্টেশনে ভিড় ঠেলে ট্রেনে উঠলাম। দেখি আমার সিটে একজন মধ্যবয়সী লোক বসা। তাকে বললাম সিট ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আমি টিকিট ও সিট নম্বর দেখানোর পরেও তিনি সিট থেকে উঠতে নারাজ৷ তার সঙ্গে কয়েক মিনিট তর্কবিতর্ক হলো। নানান রকম যুক্তি দিলাম৷ সব যৌক্তিক চেষ্টাই ব্যর্থ হলো৷
আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না, আমার সিটে আমি বসতে পারছি না। এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে অজ্ঞাত পকেটমার সাহেব অবিশ্বাস্যভাবে আমার শখের মোবাইলটা প্যান্টের ডান পাশের পকেট থেকে অলৌকিক ক্ষমতা বলে বের করে নিয়ে চলে গেল। কি অপূর্ব তার হাতের কৌশল। আমাকে টেরটুকু পর্যন্ত দিল না। সেদিন আমি খুব অবাক হয়েছিলাম৷ এত সূক্ষ্ম হাতের কাজ মানুষ কীভাবে করে।
পশ্চিমারা সূক্ষ্ম কাজের জন্য রোবট হাত ব্যবহার করে। আর আমরা মানুষের হাত দিয়েই এমন সূক্ষ্ম কাজ অবলীলায় করে ফেলতে পারি। আমি বিস্মিত সঙ্গে ব্যথিত৷ অন্যদিকে আমার কপাল আরেক কারণে ভালোও ছিল। স্টেশনে পৌঁছেই আমার বউ আমার ওয়ালেটটা তার হাত ব্যাগে নিয়ে রেখেছিল। যেখানে আমার জার্মানির রেসিডেন্ট পারমিট কার্ড, মাস্টার কার্ডসহ ছয় সাত রকমের কার্ড ছিল৷ যেগুলা হারালে হয়তো আমার সাময়িক চিন্তায় পাগল হওয়ার মতো অবস্থা হতো৷
ফোনটার জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। করুন চোখে বউ আমার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে৷ আমার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে৷ নিজের অসহায় অবস্থাতে ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে বউয়ের সামনে খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম৷ নিজের পৌরুষ ভাব ততক্ষণে টিস্যু পেপারের মতো নেতিয়ে গেছে৷ বউ আমার উচ্চশ্রেণির বুদ্ধিমতী৷ সে প্রাইমারি ক্লাস টিচারের মতো করে বাংলা পড়া বোঝানো শুরু করে দিল—কষ্ট পেয়ো না, সামান্য একটা মোবাইল ফোনই তো গেছে। আমাদের আরও তো অনেক বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারত, তাই না? ইত্যাদি মারফতি টাইপের কথাবার্তা৷
এদিকে কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়। তৎক্ষণাৎ ঝোঁকের মাথায় বলেই বসলাম, এর থেকে বড় বিপদ মানে? ফোন হারানোর থেকে বড় কোনো বিপদ আমার জীবনে হতেই পারে না৷ আমার এ কথা শুনে বউ তখন শকড৷ বউ আসলে বড় ক্ষতি বলতে বোঝাতে চাচ্ছিল তার নিজেরও কোনো ক্ষতিটতি হতে পারত৷
এখন বউয়ের মুখ ফ্যাকাশে আর আমার দুই কান টেনশনে লাল৷ বিয়ের পর থেকে এমনিতেই বউয়ের কাছে ভালোবাসার পরীক্ষা দিয়ে চলেছি। সে আমার সব ধরনের কাজ ও কথাতেই নম্বর দিত। তাকে কতটুকু ভালোবাসি তার নম্বর৷ আমি পাশ করলে খুশি হতো আর ফেল করলে আমার জীবনে দশ নম্বর বিপদ সংকেতের লাল ফ্লাগ টানিয়ে দিত৷ অন্যবার মোটামুটি পাস মার্ক পেলেও আজ মনে হয় এক ধাক্কাতে ফেল করেছি৷
মনের দুঃখে ঘটনা খুলে বললাম রেলওয়ে পুলিশকে৷ তাদের চোখ মুখের ভাব দেখে মনে হলো আমি পাঁচ টাকার ইকোনো বলপেন হারিয়েছি আর আমি তার শোকে বিবাগি৷ পুলিশ ডেকে কোনো সুরাহা হলো না৷ সামান্য একটা ফোনের সন্ধান করতে তারা অপারগ। তারা আসলে লাখ লাখ টাকা মূল্যের অবৈধ গাঁজা হেরোইন উদ্ধারে ব্যস্ত৷ এই যুগে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনগুলো যে কত আপন আর মূল্যবান হতে পারে তা শুধু তারাই বুঝতে পারে৷ টেনশন হচ্ছিল ফোনে ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ ক্রেডিট কার্ড অ্যাকাউন্ট সব লগইন করা ছিল৷ কোনো বড় বিপদ না হলেই হয়৷ এদিকে দেশ ছেড়ে জার্মানিতে আসার সময় ঘনিয়ে এসেছে। বউয়ের পাসপোর্ট তত দিনেও রেডি হয়নি। এর মধ্যে ফোন হারিয়ে দিশেহারা৷
সব থেকে লজ্জার বিষয় হচ্ছে ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখের দিনে বউসহ বড় একটা সময় কাটাতে হয়েছে থানার বারান্দায়৷ ফোন হারিয়ে কুষ্টিয়া থানায় জিডি করেছিলাম৷ সেই দরকারে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলার জন্য দীর্ঘ দেড় থেকে দুই ঘণ্টা থানার বারান্দায় বসে নতুন বউকে মশার কামড় খাইয়েছি। নিজেও খেয়েছি৷ সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে বিয়ে পরবর্তী দম্পতিদের সময় কাটে আনন্দ বিলাসে সমুদ্রের কাছাকাছি৷ সত্যি বলতে একটু বড় রকমের সুখের আশায় সেই শখ আহ্লাদ আমরা পূরণ করতে পারিনি৷ বিয়ে পরবর্তী দুই একটা দাওয়াত কপালে জুটে ছিল ঠিকই, তবে আমাদের মধুচন্দ্রিমার গণ্ডি ছিল পাসপোর্ট অফিস, ডিএসবি অফিস আর কুষ্টিয়া থানা পর্যন্ত৷ বড় রকমের দুর্ভাগ্য নিয়েই হয়তো দেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম৷
জার্মানিতে অধ্যাপকের কাছে ইমেইল করে ছুটি এক মাস মতো বাড়িয়ে নিয়েছিলাম৷ সব মিলিয়ে দেশে কাটিয়েছি প্রায় দুই মাস মতো৷ দুই মাসে যতটুকু বুঝলাম বাংলাদেশে প্রশাসনিক কাজগুলোতে সাধারণ মানুষ খুবই অসহায়৷ পাসপোর্ট করার সময় আমাকে অনেকেই উপদেশ দিয়ে ছিল দুই নম্বর লাইন ব্যবহার করার। অর্থাৎ দালাল ধরে কাজ করার জন্য৷ কিন্তু আমি তাদের উপদেশ উপেক্ষা করে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সঠিক পথ ব্যবহার করে নিজে যেমন ভোগান্তি সহ্য করেছি, তেমনি অন্যদের উপহাসের পাত্রও হয়েছি৷ আসলে দেশে কিছু কিছু সিস্টেম বদলানো খুব জরুরি৷ খুব বেশি জরুরি৷
দেশে আমার শেষ দিন৷ বউসহ ঢাকায় পৌঁছেছি৷ একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসল৷ রিসিভ করলাম। কুষ্টিয়া ডিএসবি অফিস থেকে পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা ফোন করেছেন৷ তিনি বউসহ আমি কোথায় আছি জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, ঢাকায় আছি৷ তখন তিনি আমাকে বললেন, শিগগির আপনার বউয়ের কুষ্টিয়ার নাগরিকত্বের সনদ নিয়ে ডিএসবি অফিসে চলে আসেন তো৷
আমি তখন একেবার শতভাগ হতবাক৷ বাংলা চলচিত্রের কিংবদন্তি আনোয়ার হোসেনের মতো বুক খামচে ধরে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা৷ এই রকম কাণ্ডজ্ঞানহীন লোক কি করে পুলিশে চাকরি পায়, নাকি চাকরি পাওয়ার পর কাণ্ড জ্ঞান লোপ পায়৷ তাকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিলাম, আমি ঢাকায় আছি আর আগামীকাল ভোরে আমার ফ্লাইট৷ তা ছাড়া বউয়ের নাগরিকত্বের সনদ কুষ্টিয়াতে থাকলে কেন নওগাঁর ঠিকানা ব্যবহার করতে যাব৷ তাকে মনে করিয়ে দিলাম আপনি আমাদের বাসায় এসেছিলেন। তাকে আরও মনে করানোর চেষ্টা করলাম পেট্রল খরচ বাবদ পাঁচ শ টাকা দেওয়ার কথা৷ তিনি হয়তো পাঁচ শ টাকা পকেটে রাখার কথাটা ভুলে গিয়েছিলেন। তারই বা দোষ দিই কি করে। কত জায়গা থেকেই তো কত কিছু পান। কয়টার কথাই বা তার মনে থাকে। মানুষের মন বলে কথা৷
আজ আমি জার্মানি থেকে লিখছি৷ এপ্রিলের শেষ দিকে আমি দেশ ছেড়েছি৷ আমার বউ এখনো বাংলাদেশে৷ আমার কাছে আসবার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে কখনো সরবে আবার কখনে নীরবে কাঁদছে৷ প্রতিদানে আমি কাঁদতে পারি না৷ পুরুষ মানুষের এই এক বড় সমস্যা। চোখে সহজে পানি আসতে চায় না। আর মেয়েরা চোখের পানিতে বিশ্বাসী৷ চোখে পানি নেই মানে হচ্ছে মনে কষ্ট দুঃখ নেই৷ তার ধারণা আমি অনেক ভালো আছি। যত দুঃখ কষ্ট সবই তার৷ আমার শখের মোবাইল ফোনটা আজ কে ব্যবহার করছে আমি তার কিছুই জানি না৷ তবে আমার দেশের কোনো একজন ব্যক্তি হয়তো বেওয়ারিশ ফোনটা ব্যবহার করছেন৷ যে দেশের আলো বাতাসে আমি বড় হয়েছি সেই দেশেরই কোনো একজন ব্যক্তি আমার ফোনটা ব্যবহার করছেন৷ ব্যবহারকারী ব্যক্তিটি বেওয়ারিশ নাও হতে পারেন তবে আমার ফোনটি এখনো বেওয়ারিশ৷