বাবার মুখে এক ফোঁটা পানিও দিতে পারিনি

লেখক
লেখক

শুরুতেই বলে রাখা খুবই প্রয়োজন, আমার বাবা একজন কৃষক ছিলেন। তিনি ডাক্তার বা ব্যাংকার ছিলেন না। এ জন্য আমার কোনো আফসোসও নেই। সম্ভবত তিনি নিজেও আফসোস করতেন না। আরও সুন্দর করে বললে বলা যায়, আমি একজন কৃষকের সন্তান। এ জন্য আমি খুবই গর্বিত।

বিশ্ব বাবা দিবসে কিছু লিখতে চাইনি। বাবাকে নিয়ে আমার স্মৃতিগুলো খুবই বেদনাদায়ক। আমার চোখ থেকে আমার বাবাকে সরাতে পারি না জীবনের কোনো মুহূর্তে। কারণ মৃত্যুকালে তার মুখে এক ফোঁটা পানি দিতে পারিনি। রমজান মাসে বিশ্ব বাবা দিবসে মনে পড়ে যায় বাবার সেই বেদনা পীড়িত চাহনি। তিনি খুবই ধার্মিক লোক ছিলেন। কিন্তু রোজায় আমার নিদারুণ কষ্ট দেখে তিনি খুবই কষ্ট পেতেন। তা তার চেহারা দেখে বুঝতে পারতাম। তখন আমার বয়স হবে মাত্র ১০-১২ বৎসর। সম্ভবত রোজা ফরজ হয়ে গিয়েছিল। তাই রোজা ভেঙে ফেলার কথা বলতে তিনি সাহস পেতেন না আল্লাহর ভয়ে ঠিকই, কিন্তু বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতেন যে, আমার কষ্ট হলে রোজা আমি ছাড়তে পারব এবং পরে কোনো একসময় রাখলেও চলবে। বাবার স্নেহ কী তখন বুঝতে পারিনি পুরোপুরি। যখন বাবাকে পুরোপুরি বুঝতে পারলাম, তখন আর বাবা দুনিয়াতে বেঁচে নাই।
আমার মেয়ে যখন জন্ম নিল তখন আমিও হসপিটালে ছিলাম ওর নানির সঙ্গে। তো ওকে একটি চুমু দিয়েই ওর মাকে চলে যেতে হলো অপারেশন থিয়েটারে। ওই ছোট্ট শিশুর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক! আমি ওকে পেটেও ধরিনি ১০ মাস। সে তার মার পেটে ছিল এবং সেই মা তখন তার পাশে নাই। এখানে ছিলাম আমি আর ওর নানি। নার্স ওকে রেখে গিয়েছিল ছোট একটি বেডে। আর ওকে কোলে নিতে আমাদের নিষেধ করে গিয়েছিল। কিন্তু এ মেয়েটি কেন জানি শুধু বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল আর কাঁদছিল, যেমন করে আরও দশটি শিশু জন্মগ্রহণের পর কান্নাকাটি করে। শিশুরা জন্মের পর এত কান্নাকাটি করে কেন আল্লাহই ভালো জানেন। এক অজানা কারণে আমার তার জন্য মায়া হলো। কী সেই অজানা কারণ আমার জানা নেই। আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। হাত তো ধোয়া ও পরিষ্কার ছিল, তাহলে কোলে নিতে অসুবিধা কি। আমি ওকে কোলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে কান্না বন্ধ করে দিল। চমৎকার অনুভূতি! তখন বিশেষভাবে আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেল। সেই থেকে আমার মেয়ের সঙ্গে আমার যে বন্ধন, সেই বন্ধন আমাকে বারবার বাবার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এখন বাবার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমার বাবা আমাদের সবকিছু শিক্ষা দিতেন এবং যেকোনো শিক্ষাই তিনি আমাদের খুবই কঠিনভাবে দিতেন। একটা উদাহরণ দিলে হয়তো আপনাদের কাছে আরও পরিষ্কার হতে পারে। ভাদ্র মাসে আমাদের খেতে যেতে হতো এবং আমাদের হালচাষ করতে হতো। এখনো আমার গায়ে মাটির গন্ধ লেগে আছে। তিনি বলতেন, যেহেতু আমাদের কৃষকের ঘরে জন্ম তাই হালচাষ শেখা খুবই প্রয়োজন। আরও বলতেন, জীবনে কে কী হবে কেউ জানে না। তাই ছেলেদেরও বাবার পেশা শেখা উচিত। যাতে তারা বেঁচে থাকার যে লড়াই, সে লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারে। অন্যদিকে আমাদের স্কুলেও পাঠাতেন এবং সন্ধ্যার পর পড়তে না বসলে খুবই রাগ করতেন। এটা আমাদের এবং আমার আম্মার কাছে ছিল অস্পষ্ট, যেখানে আমাদের কৃষি কাজ করতে হতো সেখানে কেন তিনি আমাদের ভালো রেজাল্টের প্রতি এত জোর দিতেন। এটা পরে বুঝতে পেরেছিলাম।
আরেকটি উদাহরণ দিতে চাই। সেই কাপনা নদীর কথা। আমাদের গ্রামের নাম কামালপুর। কাপনা নদীর তীরে অবস্থিত সুন্দর একটি ছোট গ্রাম। এই কাপনা নদী আমার জীবনে এক অম্লান স্মৃতি। শিল্পী জয়নুল আবেদীনের মতো একজন শিল্পী হতে পারলে এই নদীটির একটি সুন্দর ছবি এঁকে আপনাদের কাছে তুলে ধরতে পারতাম! কাপনা নদীর কল কল ধ্বনি কবিতার ছন্দে এখনো আঁকা হয়নি, তাই কাপনা নদী এখনো আপনাদের কাছে অচেনাই রয়ে গিয়েছে। শৈশবে এই নদীতে জাল ফেলে ও বড়শি দিয়ে অনেক মাছ ধরেছি। বাল্য বন্ধুদের নিয়ে সাঁতার কেটেছি কত। আর বর্ষাতে ডিঙি নৌকা বেয়েছি।

বাঁশের সেতু। প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
বাঁশের সেতু। প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

একবার এই নদীর ওপর নির্মিত বাঁশের পুল পার হতে গিয়ে এই নদীতে পড়ে গিয়ে প্রায় মরেই গিয়েছিলাম (ছবিতে বাঁশের পুল দেখুন, কারণ এইগুলো এখন সম্ভবত আর নেই)। কীভাবে যে বেঁচে আজ এত দূর এসেছি, আমার জানা নেই। একটি কবিতায় লিখেছিলাম যে অনেক উত্থান-পতনের মধ্যে আমার এ জীবন। অল্পের জন্য বাঁচা, অল্পের জন্য এ জীবন।
যা হোক, আমার বাবা যখন শুনলেন আমি বাঁশের পুল থেকে পড়ে গিয়েছিলাম, তিনি আমাকে স্কুল ছুটির দিনে কাপনা নদীতে নিয়ে গেলেন। তখন বর্ষাকাল নদীতে প্রচণ্ড স্রোত। বাবা আমাকে এই নদীর প্রায় মধ্যখানে ছেড়ে দিলেন আর বললেন এখন নিজে নিজে উঠে আসো। কী নিষ্ঠুর কাণ্ড চিন্তা করুন। আমি তখনো সাঁতার শিখিনি। আমার বয়স আর কত হবে—সাত-আট বছর হবে হয়তো। তো আমি অনেক টাপুরটুপুর করেও কিন্তু তীরে উঠতে পারিনি। বরং অনেক পানি খেয়ে ফেলেছিলাম ততক্ষণে। শেষে বাবা উঠিয়ে নিয়ে আসলেন। আমার কান্না দেখে সেদিন ওই যাত্রায় আমাকে ছেড়ে দিলেন।
বাবাকে অত্যন্ত কাতর দৃষ্টিতে বললাম, বাবা আমি সাঁতার শিখে ফেলব নিজে নিজে, আমাদের পুকুরে। আমাকে আর নদীতে ছেড়ে দিয়ো না। তিনি বললেন, সামনের রোববারের আগে শিখতে হবে। তা না হলে তিনি আমাকে আবার নদীতে ফেলে দেবেন। ওই সময় সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল রোববার। তার ভয়ে আমি আমাদের পুকুরে একটু একটু চেষ্টা করে সাঁতার শিখতে চেষ্টা করেছিলাম বই কী!
বাবাকে বললাম, বাবা আমি সাঁতার শিখে ফেলছি। আমাকে আর নদীতে সাঁতার দিতে নিয়ো না। তিনি কিছু বললেন না। এতে আমি ধরেই নিলাম মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। কিন্তু পরের রোববারে তিনি আমাকে নিয়ে আবার সেই নদীতে ফেলে দিলেন। তারপর অনেক টাপুরটুপুর করে স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতরে কিনারে আসলাম আর আমার সে কী কান্না আর বাবাকে ভয়!
বড় হয়ে বুঝতে কষ্ট হয়নি কেন তিনি আমাকে কঠিন করে সাঁতার শিখিয়েছিলেন। নদীমাতৃক আমাদের দেশে বর্ষায় বন্যা হতো আর সঙ্গে সঙ্গে নদীনালা, মাঠঘাট, বিলঝিল আর হাওরগুলো পানিতে থই থই করত। এখনো কি সেরকম হয়! বড্ড জানতে ইচ্ছে করে। শুনেছি ভারত পানি বন্ধ করে দিয়েছে আর আমাদের অনেক নদীই আজ শুকিয়ে গিয়ে মরুভূমির মতো হয়ে গিয়েছে কালের সাক্ষী হয়ে।
এই দুটি উদাহরণ হলো আমাদের কোনো কিছু শেখানোর আমার বাবার নিজস্ব রীতি। আপনারা যারা পড়ছেন তাদের কাছে এটি গল্প মনে হতে পারে, কিন্তু সেই স্মৃতি লিখতে আমার কী যে কষ্ট হচ্ছে, সেটা শুধু অনুভবের বিষয়, প্রকাশ করা খুবই কঠিন। যখন ল্যাপটপে লিখছি তখন অক্ষরগুলো ভিজে যাচ্ছে আমার চোখের জলে।
আমাদের অনেকেরই ছেলেমেয়েদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকে যে, সন্তান বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার অথবা বড় কর্মকর্তা হবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার বাবার কোনো বড় প্রত্যাশা ছিল না। তিনি চাইতেন বড় হয়ে আমরা মানুষের মতো মানুষ হব। তিনি কোনো দিন বলেননি যে, আমাকে ডাক্তার হতে হবে অথবা ইঞ্জিনিয়ার। তিনি সন্ধ্যা হলে আমাদের বই নিয়ে বসতে তাগিদ দিতেন। তিনি চাইতেন আমাদের ভালো রেজাল্ট। কারণ ভালো রেজাল্ট ছাড়া ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়া যাবে না।
আমার বাবা আজ নেই। তিনি চাইতেন আমরা স্বাবলম্বী হই এবং পরনির্ভরশীল না হই। এ জন্য তিনি বলতেন, কৃষকের ছেলে কৃষি কাজ শিখতে হবে। কৃষি কাজ শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পড়াশোনায়ও মনযোগ দিতে তাগিদ দিয়েছেন। বাবা আমাদের পড়াশোনা করিয়েছেন অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করে। আমরা সেই বাবার জন্য কী করতে পেরেছি, যিনি চাষাবাদ করে আমাদের লালন পালন করেছেন এবং আমাদের পড়াশোনা করিয়েছেন। আজ আমি ব্যারিস্টার আর আমার ছোট ভাই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং এখন ইন্টেল করপোরেশনে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। জানি না কতটুকু মানুষের মতো মানুষ হতে পেরেছি!
আমরা সেই বাবার জন্য কী করতে পেরেছি। অন্তিম শয্যায় শায়িত বাবার মুখে এক ফোঁটা পানিও দিতে পারি নাই। আমি নিশ্চিত, মৃত্যুযাত্রী বাবা আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। আমি তো তাকে দেখতেও যেতে পারিনি। কোনো কোনো সময় মনে হয়, মৃত্যুযাত্রী বাবার মুখ না দেখেই ভালো হয়েছে। এই করুন দৃশ্য হয়তো আমি সহ্য করতে পারতাম না। আমি মনে রাখতে চাই বাবার সেই মুখ, যে মুখে হাসি ছিল আর ছিল স্বপ্ন—সন্তান মানুষ করার স্বপ্ন।
আরেকটি ছোট উদাহরণ দিয়ে আজকের বাবা দিবসের লেখা শেষ করতে চাই। আমার বয়স তখন হবে ১০-১২ বৎসর। আমি বিশ্বনাথ থেকে বাড়ি ফিরছি সন্ধ্যার পর। বিশ্বনাথ থেকে আমাদের বাড়ি আড়াই মাইল দূরে। তখন এই পথ হেঁটে যেতে হতো। তো আমি এক রাতে আসছিলাম। পথে আমাদের গ্রামের একজন লোক কাঁধে ভার নিয়ে আসছিলেন। সম্ভবত আলুর ভার। ব্যবসা-ট্যাবসা করতেন হয়তো। সঙ্গে তার এক ছেলে। আমার বয়সী হবে। সেও আসছিল তার বাবার সঙ্গে বিশ্বনাথ থেকে। তার কাঁধেও ভার।
কিছু দূর গিয়ে ছেলেটি বলল, বাবা আর পারব না। ছেলেটির বাবা বললেন, গরিবের ঘরে জন্ম নেওয়াটা হলো তোমার অপরাধ। তাই তোমাকে পারতেই হবে। আরও একটু দূরে গিয়ে ছেলেটি বসে গিয়েছিল আর কান্না শুরু করে দিল। তার বাবা তার সঙ্গে দাঁড়াল। বলল আমি নিজেও তো পারি না রে বাবা, কিন্তু কী করব, দে আমার কাঁধেই দে।
তখন আমার চোখ থেকে জল আসছিল বললে কম হয়ে যাবে। বরং দৃশ্যটা দেখে চোখের পানি থামাতে পারিনি। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। যদিও আমি নিজে অনেক ছোট ছিলাম। কিন্তু ঘটনাটা আমার কাছে খুবই হৃদয়বিদারক মনে হচ্ছিল। এ দৃশ্য আমার হৃদয়ে একটি প্রচণ্ড গভীর দাগ কেটেছিল এবং যেটা কোনো দিন শুকায়নি। মনে মনে একটি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, আমি বড় হয়ে এমন কিছু করব যাতে আর কোনো ছোট শিশুকে কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতে না হয়। কিন্তু কি করতে পেরেছি? মনে হলে একটুকরো হাসি ঠোঁট গেলে যেন ঝরে পড়ে। আজ বিশ্ব বাবা দিবসে কত মিলিয়ন বাবারা তাদের সন্তানদের একমুঠো খাবার দিতে পারছেন না। আমরা কি সবাই প্রতিজ্ঞা করতে পারি না যে, আমাদের বাবাদের স্মরণ করে আমরা নিজেরা একবেলা না খেয়ে এই সঞ্চয়টা কোনো দরিদ্র পিতাকে দিয়ে দেব, তার সন্তানের মুখে একমুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য।

মোহাম্মদ আব্দুস শহীদ: ব্যারিস্টার।