দুঃখে ভরা পরবাসে এক পশলা বিনোদন
প্রিয় মাতৃভূমি থেকে বহু দূরে। আপনজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরবাসে নানা দুঃখ-কষ্ট-বেদনা ও ব্যস্ততা ভুলে ক্ষণিকের আনন্দ খোঁজা! তবে সেটা প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতির দেওয়া প্রতিদানহীন নির্মল সে আনন্দ ক্ষণকালের জন্য সকল অপ্রাপ্তি যেন মিটিয়ে দিয়েছে। অতি চমৎকার, নৈসর্গিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্য, যা কল্পনাকেও হার মানায়। এর মাঝে অনুকূল আবহাওয়া অভূতপূর্বভাবে আমাদের সহায় হওয়ায় আনন্দের কোনো ঘাটতি হয়নি। কোথায় যেন পড়েছিলাম—‘যদি স্রষ্টাকে পেতে চাও, সৃষ্টির দিকে তাকাও।’ সত্যি বিচিত্র স্রষ্টার সৃষ্টি। সুন্দর, কল্পনাতীত ও বর্ণনাতীততো বটেই।
সত্যি দেখার মতো ফ্রান্সের ‘ভোল লে রোজ’ (Veules les roses) সামুদ্রিক অঞ্চল। উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডির সেইন মেরিটাইম বিভাগে এটি অবস্থিত। ২৪৭ একর এলাকা নিয়ে গঠিত এ অঞ্চলে রয়েছে হ্রদ, পুকুর, হিমবাহ ও সমুদ্র সৈকত। ২০০৬ সালের হিসাব অনুযায়ী এখানে ৫৪৬ জন লোক বসবাস করেন। সাজানো-গোছানো পাহাড়, সমুদ্র সৈকত, ঘরবাড়ি, ফোয়ারা, নদী, গাছপালা, প্রকৃতির অপরূপ সাজ। এমনকি সমুদ্র পাড়ে ছোট বাচ্চাদের জন্য রয়েছে সুইমিং পুল। কচিকাঁচাদের আনন্দ রব ও লাফালাফিতেই চোখ আটকে যায়। পাশেই নীল জলরাশির বিশাল সমুদ্র। অথচ স্বাভাবিক প্রকৃতির কোনো রকম ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সবকিছুই যেন নিজের মতো করে প্রযুক্তি দিয়ে প্রাকৃতিক করে সাজিয়ে নিয়েছে।
অবশ্য ফ্রান্সের যেখানেই গিয়েছি এরূপই দেখেছি। পাহাড়, পর্বত, প্রকৃতি যেখানে যে অবস্থায় আছে; সে অবস্থানে রেখেই তা বসবাসযোগ্য করা হয়েছে। প্যারিস শহরটাও অনুরূপ। ওপর থেকে দেখলে দেখা যায় কত উঁচু–নিচুতে স্থাপনা গড়া হয়েছে।
প্যারিস থেকে ভোল লে রোজ বাস যোগে প্রায় দুই শ কিলোমিটার পথ। কখনো পাহাড় কখনো পর্বতের নিচ দিয়ে আবার কখনো পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বিশাল বিশাল রাস্তা। অরণ্য পাড়ি দিয়ে সেথায় যাওয়া। আগেও অন্যান্য দুর্গম এলাকায় গিয়ে খেয়াল করেছি, এখানে এসেও দেখলাম। ফ্রান্সের সীমানায় যে কোথাও থাকেন না কেন; সেখানকার এবং শহরের নাগরিক সুবিধা সব একই রকম। যাবতীয় উপাদান ও সুযোগ-সুবিধা একই।
অবশ্য এখানে নির্মল প্রকৃতির বাড়তি সুবিধা। এসব দেখলে অবাক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কত শত বছরে তারা এমনটি করতে পেরেছে! ফ্রান্সে যা দেখি তাতেই অবাক হই। আসলে দেশপ্রেম, সততা, নিষ্ঠা-আন্তরিকতা আর পরিকল্পিত পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। যাক, মূল প্রসঙ্গে আসি।
গত রোববার ফ্রঁসে আবেক রাব্বানী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ভোল লে রোজ সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণ ও বনভোজনের এ আয়োজন করা হয়।
প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আন্তরিক ও বুদ্ধিদীপ্ত সৌহার্দ্যে ভরপুর ছিল এর সার্বিক আয়োজন। প্রতিটি মুহূর্ত যেন কেটেছে পারস্পরিক মধুরতাপূর্ণ এক সজীব-নির্মলতায়। এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ফ্রঁসে আবেক রাব্বানীর প্রতিষ্ঠাতা রাব্বানী খান। তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন আহমেদ আলী আকবর সুমন, জাহিদ, মিলন, অরণ্য আমীর ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কান্ট্রি ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল মামুন খান প্রমুখ।
প্লাস দ্য লা শাপেলে অবস্থিত ফ্রঁসে আবেক রাব্বানী প্রতিষ্ঠানের বটতলা থেকে এ সমুদ্র ভ্রমণ শুরু। ভোর থেকেই প্যারিসের বিভিন্ন শহর থেকে জড়ো হতে থাকেন উৎসুক ডেলিগেটরা। সকাল ৮টা থেকে কুপন সংগ্রহ, সমুদ্রের নীল জলরাশির ছাপে বর্ণিল কারুকার্য সমৃদ্ধ টিশার্ট ও সঙ্গে সেলফি স্টিক। ১২৫ জনের মাঝে এসব বিতরণ শেষে দুটি বাসের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় সকাল সোয়া ৯টায়।
এ ভ্রমণে আসা-যাওয়া এবং সমুদ্রপাড়ের সময়টুকু এমনই সৃজনশীল ছিল যে, কোনো দিন যিনি মাইক্রোফোনের কাছেও ভেড়েননি; তিনিও তার মধ্যে থাকা নানা ভাব কথন উজাড় করে দিয়েছেন। গান, গল্প, কৌতুক, কবিতা, চুটকি, আঞ্চলিক কৃষ্টি-কালচার উপস্থাপন করে! তাদের সেসব পরিবেশনায় প্রতীয়মান হয়েছে সবার মধ্যেই সৃষ্টিকর্তা কিছু প্রতিভা দিয়েছেন। আর যারা মাইক্রোফোন ধরেননি; তারা আরও বেশি সঙ্গ দিয়ে পুরো ভ্রমণকে প্রাণবন্ত করতে কার্পণ্য করেননি।
এ আয়োজনে ১২৫ জন অংশগ্রহণ করেন। সন্তান-সন্ততিসহ কয়েকটি পরিবারের সংস্রব দিয়েছে বাড়তি উৎসব। আর পুরো ভ্রমণকে পূর্ণতার আরেক উচ্চমাত্রা যোগ করেছেন ব্যাপক বাংলা ভাষা জানা ফরাসি নাগরিক জেরেমি কোডরন ও মাদাম মিতেলমান। জেরেমি বাংলার লালন, বাউল এবং চট্টগ্রাম ও সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় গান, কৌতুক পরিবেশন করে সকলকে যারপরনাই বিমোহিত করেছেন।
সমুদ্রের নীল জলরাশির উদাত্ত হাতছানি কারসাধ্য এড়িয়ে যাওয়া। তীরে এসে বাস থামতেই সকলে নেমে পড়েন। লাফালাফি, সাঁতার কাটা, ফুটবল নিয়ে মাতামাতি, সেলফি, ফটোসেশন, লম্ফঝম্ফ......। এর মাঝে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সমুদ্রের জোয়ারভাটা। ফলে আমরা যেখানে লাফালাফি, দাপাদাপি করছি কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে বিশাল মরুভূমি! ধু ধু বালুচর! প্রকৃতির মাধ্যমে স্রষ্টার একী লীলাখেলা! সত্যি অবাক করে। চিন্তায় ফেলে। এ আকর্ষণ রেখে কি ফিরতে ইচ্ছে করে? মন চায়, জোয়ারভাটার এ খেলা দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামুক। জোনাকি জ্বলুক। চাঁদের আলো পড়ুক নীল জলরাশির ঢেউয়ে। সব কোলাহলে তৃপ্তির প্রশান্তি ঘিরে কেটে যাক না সময়। কিন্তু যান্ত্রিক এ জীবনে তা কি সম্ভব? এবার যে ফেরার পালা। ফিরতে মন নাহি চায়। তবুও ফিরতে হয়। তবে আবার আসব এ আশায়।
এ ভ্রমণে তিন পর্বে ছিল খাওয়ার আয়োজন। সকালের নাশতা। দুপুরের খাবার ও ফিরতি পথে হালকা নাশতা। সবশেষে সমুদ্র পাড়ে আয়োজন করা হয় কনসার্ট ও বিশেষ আকর্ষণ লটারি। ১২৫ জনের সকলেই এতে অংশগ্রহণ করেন। প্রথম পুরস্কার ফ্ল্যাট-টিভিসহ ছিল ৪০টি নানা আকর্ষণীয় জিনিস।
উদ্যোক্তাদের প্রতি অংশগ্রহণকারীদের আবদার ছিল, প্রতি বছর যেন এ রকম আয়োজন করা হয়। আয়োজকেরা তাদের আবদার পূরণে আশার বাণী এবং এবারের মতো ভবিষ্যতে সকলের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আবেদন করে সে দিনের এ আনন্দ ভ্রমণের সুন্দর সফল সমাপ্তি হয়।