বিবর্ণ ছায়া

সিডনির প্রিন্স অফ ওয়ালস হসপিটাল
সিডনির প্রিন্স অফ ওয়ালস হসপিটাল

হঠাৎ করে বেশ গরম পড়েছে। পড়ন্ত বিকেল। বড় বড় গাছের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়ে আছে। হালকা বাতাস। তবুও গরম কমছে না। ব্লু-মাউন্টেনের দিকে বুশফায়ার হচ্ছে। ওই এলাকার লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে নিরাপদ স্থানে। টিভিতে কিছুক্ষণ পরপর নিউজ আপডেট হচ্ছে। বাসার সামনে ছোট্ট গার্ডেনে চেয়ার পেতে বসে আছি। হাতে ওরহান পামুকের ‘তুষার’ বইখানা। তবে চেষ্টা করেও মনযোগ দিতে পারছি না। ঠিক তখনই দেখি ডাক্তার নজরুল। এদিকেই আসছেন।

তিনি আমার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু সৈকতের বড় ভাই। বয়স পঁয়ত্রিশ পার হয়ে গেছে হয়তো। এখনো অবিবাহিত। এক বছর হতে চলল তিনি অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে আছেন। ফোন করলে রেগে যান। তাই সন্ধ্যার পর বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হয়। আমাদের বাসা থেকে মাত্র দেড় শ মিটার দূরে তাঁর বাসা। ঈদ উৎসবে বেশ কয়েকবার দাওয়াত করে এলেও তিনি আসবেন কিনা বলা যায় না। না এলে খাবার বাসায় দিয়ে আসি। ফিরতে হয় কয়েকটা গালি খেয়ে। আমার বড় ভাইও ডাক্তার। ঠিক এই ধরনের। তাই তাঁকে বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। তিনি যত বকাঝকাই করুন, তাঁর জন্য আমার মন কাঁদে। তাঁর ভেতরের সরল মনটা আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারি। তারপরেও মাঝে মাঝে তাঁর রহস্যময় আচরণের কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে, মনে প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা, নজরুল ভাই এমন করেন কেন। এই অস্ট্রেলিয়ায় আমি ছাড়া তাঁর কে আছে।
গার্ডেনের ভেতরে এসেই বললেন, আরেকটা চেয়ার নিয়ে এসো।
আমি অবাক নাকি হতবাক, কিছুই বুঝতে পারছি না। এ সময়ে নজরুল ভাই! সূর্য আজ পশ্চিমে উদয় হলো নাকি?
চেয়ারটায় বসে দু-একবার চোখ মুছে বলতে লাগলেন, ছোট ভাই, তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তোমার হেল্প না পেলে আজ আমি অস্ট্রেলিয়ার মাইগ্রেশন নিতে পারতাম না।
এসব পুরোনো কথা বহুবার শোনা হয়েছে। প্রতিবারই বিরক্ত হয়েছি। এই পরবাসে তিনি আমার বড় ভাই। এই সম্মানটুকু দেখাতে গিয়ে প্রতিবার নীরবই থেকেছি। তবে আজ তার কথাবার্তা কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।
বললাম—ভাই, হঠাৎ এ সময়ে। কেমন আছেন, দেশে সবাই ভালো তো?
আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ছোট ভাই। আমি আজ দেশে যাচ্ছি।
—দেশে যাচ্ছেন!
—হ। দেশে যাচ্ছি। অস্ট্রেলিয়ায় আর ফিরব বলে মনে হয় না। হলিডে করার জন্য যদি কখনো ইচ্ছে হয়, তবেই হয়তো আসব। যে সুখের আশায় এ দেশে আসা। আমার বেলায় তা বুঝি আর হয়ে উঠল নারে ভাই।
—মানে? বলেন কি এ সব!
—ভেবেছিলাম সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। যে দেশের আলো বাতাসে বড় হওয়া, হঠাৎ সে দেশ ছেড়ে এই এক ভিনদেশে। তাই হয়তো মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
—ভাই। এই যুগে এসে আপনি এসব কী বলছেন। এই ছোট্ট একটা পৃথিবী।
বাধা দিয়ে বললেন—তোমরা যারা সমাজ-সাহিত্য-ইতিহাস-রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা কর, তোমাদের কথা ভিন্ন। আমি যে এখনো মানবদেহ থেকে বের হতে পারিনি রে ভাই।
—ভাই। আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
একটা হালকা নিশ্বাস ছেড়ে বললেন—যেদিন অস্ট্রেলিয়ায় ফ্লাই করব, সেদিন এয়ারপোর্ট যাওয়ার আগে চেম্বারে যাই। ঢাকা শহরের মতো জায়গায় সম্পূর্ণ শূন্য থেকে শুরু করে এত শ্রমে গড়ে তুলেছি হাসপাতালটা। মায়া কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। আমার বন্ধু ডাক্তার সারোয়ারকে হাসপাতালের সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিই। বের হয়ে পড়ব ঠিক তখনই একটা রোগী এল। মাইক্রোবাসের নিচে চাপা পড়ে বাম পাটা ভেঙে গেছে। লোকটাকে আমি চিনতাম। নাম রহিম। আমাদের হাসপাতালের সামনে রাস্তায় কমলা বিক্রি করে। প্রায়ই জোর করে গাড়ি থামিয়ে ডজনখানেক কমলা আমার ড্রাইভারের হাতে ধরিয়ে দিত। পেছন থেকে একটা ট্রাকে ধাক্কা দিলে সামনের মাইক্রোবাসটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওর ওপরে উঠে পড়ে। এই আর কী। তখনো কনসাস ছিল। হাসপাতাল গেটে আমাকে দেখামাত্রই দুই হাত বাড়িয়ে কী এক চিৎকার।
—ডাক্তার সাব! ডাক্তার সাব! আমারে বাঁচান। আমার ছোট্ট দুইটা ছেলে।
আরে কী মুশকিল। কী করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এ সময় সারোয়ার বলল, দোস্ত। তোমার এখন এসব নিয়ে ভাবার সময় নয়। তুমি চলে যাও। বিষয়টা আমি দেখছি। রহিমকে যখন হসপিটালের ভেতরে নিয়ে যায়, তখনো সে রক্তবর্ণের অসহায় দুটি চোখে চেয়েছিল আমার প্রতি। তারপর সিডনি ল্যান্ড করে তোমার বাসায়। আমার ওই অস্থিরতা তোমার মনে আছে হয়তো। রহিমের ওই আকুতি বারবার কানে আসছিল। যা হোক, সপ্তাখানিক পর একদিন সারোয়ারকে ফোন দিই। নানান প্রসঙ্গ শেষে রহিমের কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল, দোস্ত তুমি চলে গেলে কেমন যেন লাগছিল। আগে বুঝতে পারিনি এতটা খারাপ লাগবে। প্রচুর রক্তক্ষরণ। হাড্ডি ভেঙে একেবারে তুষ হয়ে গেছে। এত জটিল অপারেশন সামাল দেওয়ার মতো মনের অবস্থা ছিল না। তাই রোগীটাকে সঙ্গে সঙ্গেই পঙ্গুতে রেফার করি।
—আরে দোস্ত বলিস কি?
তখনই আমার মনে সন্দেহ দেখা দেয়। কারণ পঙ্গুতে এই রোগীর চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়া—ওখানে ভর্তি বিড়ম্বনা, বিভিন্ন খরচ। এত সব এই রহিমের জন্য কে করতে যাবে। পরে আমার ড্রাইভারকে ফোন করে জানতে পাই রোগীটাকে শেষ পর্যন্ত পঙ্গুতে নেওয়া সম্ভব হয়নি। অন দ্য ওয়েতে জ্যামে আটকা থাকা অবস্থাই সে মারা যায়।
মারা গেছে। গেছে। কী আর করা। ডাক্তারদের এমন কত জন্ম, কত বীভৎস, কত অবাঞ্ছিত মৃত্যু দেখতে হয়। এসব নিয়ে ভাবলে কী আর ডাক্তারদের চলে। এমন নানান সান্ত্বনায় মনটাকে বোঝাতে চেষ্টা করি। কাজ হয় না। আমার চলে আসা আর রহিমের মরে যাওয়া—কোথায় যেন একটা যোগসূত্র ভেসে ওঠে। কেউ না বললেও মনে মনে ঠিকই বুঝতে পারছিলাম, রহিম আর নেই। বলিষ্ঠ এক টেলিপ্যাথি কাজ করছিল আমার মধ্যে।
তুমি অবশ্যই দেখেছ। আমার বেডরুমের সামনে আঙিনায় ছোট্ট বাগান। বাগানের কর্নারে ছোট্ট একটুখানি ঝোপ। বেডরুমের জানালাটা প্রচণ্ড শীতেও সামান্য খোলা রাখি। মুক্ত বাতাস বিনা ঘুমাতে পারি না। সে রাতে কেমন এক গা শিউরে ওঠা কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। মৃত্যুর সঙ্গে জীবনের লড়াই। গোঙানির ভাঙা স্বর।
—ডাক্তার সাব! ডাক্তার সাব! আমারে বাঁচান!
হঠাৎ ঘুম ভেঙে হিতাহিত জ্ঞান ছিল না তখন। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি ছায়ার মতো। কিছুটা অস্পষ্ট। উলঙ্গ এক মানুষ। বাম পাটা হাঁটু পর্যন্ত থেঁতলানো। বীভৎস। হাড্ডি সামান্য বেরিয়ে আছে। চেয়ে চেয়ে দেখছি কেবল। কোনো কথা বলতে পারছি না। লোকটা হামাগুড়ি দিতে দিতে আস্তে সরে গিয়ে একপর্যায়ে ছোট্ট ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। ঝোপের দিকে অপলক চেয়ে আছি।
অদূরে রাস্তার লাইট থেকে ছড়ানো আলো। দেখি অর্ধেকটা চাঁদ পূর্বাকাশে এইমাত্র মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়েছে কেবল। জোছনা আর রাস্তার আলোতে তখন মাখামাখি। ঠিক তখনই খেয়াল করে দেখি আমার সারা শরীর ভেজা। তবে? আমি কী ঘামছি? নাকি কেউ আমার ওপর পানি ঢেলে দিয়ে গেল? বুঝতে পারলাম না। একবার এমনও ইচ্ছে করছিল যে, দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখি। লোকটা হয়তো ঝোপের আড়ালেই আছে। বাইরে যেতে উদ্যত হতেই ভয়ে আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। যদিও তাপমাত্রা তখন সাত ডিগ্রি। ডোনা, ব্লাংকেট কিছুই গায়ে দিতে পারছি না। শরীরটা বিছানায় এলিয়ে নিথর।
এই অস্ট্রেলিয়া অর্থহীন মনে হচ্ছে তখন। এ যেন কোনো অপরাধের সাজা পাওয়া দ্বীপান্তর। এর বেশি কিছুই নয়। তারপর থেকে প্রায় প্রতি রাতেই ওই দৃশ্যটা দেখি। ক্লান্ত দেহে ঘুমন্ত অবস্থায় রাত প্রায় একটা থেকে দুইটার মধ্যে ওই দৃশ্যটা আমার চোখে উদয় হয়। একবার তাই রাত দুইটা পর্যন্ত বিভিন্ন হাসি-কৌতুকের নাটক দেখি। ভাবলাম, আজ হয়তোবা এমন হবে না। ঘুমিয়ে পড়তেই আবার ওই একই অবস্থা। আজ এক বছর ধরে এই দুঃস্বপ্নের অত্যাচারে আমার শান্তি, আমার স্বস্তি ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে আমার মন। যে স্মৃতি প্রায় মুছে গিয়েছিল, আজ এই পরবাসে ওই সব স্মৃতিই এক গভীর মমতায় ভেসে ওঠে মনের আয়নায়। মনটাকে বোঝাই। এত খরচ। এত সাধনায় আজ এই অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব। প্রতি রাতে কী একটা দৃশ্য দেখি। তাতেই কী সব মিছে হয়ে গেল? আত্মীয়–বান্ধবহীন পরিবেশে এমন তো হতেই পারে।
এই অস্ট্রেলিয়ায় পাবলিক হেলথের সকল দায়িত্ব সরকারের। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে কী উন্নত মানের চিকিৎসা সেবা। রোগীদের এক ডলারও দিতে হয় না। একজন মানুষকে কীভাবে সুস্থ সবল রাখা যায় এ বিষয়ে মানুষটার চেয়ে যেন সরকারের চেষ্টাই বেশি। ওই দিন দেখি, অপারেশনের ভয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়া লিভার ক্যানসারের এক রোগীকে পুলিশ দিয়ে ধরে এনে চিকিৎসা করছে। এই লোক এখন সুস্থ। পুরোদমে তার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের বাংলাদেশে, সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য ওই রকম চিকিৎসাসেবা কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে কি না জানি না। শুধু এই কথাটাই সত্য। আমার মতো ডাক্তার নজরুলের থাকা বা না থাকায় এই অস্ট্রেলিয়ানদের কিছুই যায় আসে না।
গতকাল সকালে জানতে পাই, পাশের বাড়ির আমার এক দাদি মারা গেছেন। আমার বয়স যখন তিন বছর, শেওড়াপাড়ায় আমাদের বাড়ির পেছনেই একটা ছোট্ট পুকুর ছিল। কোনো এক নীরব দুপুরে আমি ওই পুকুরে নেমে ডুবে গেলে, দাদি ওই পাড় থেকে দেখেন কী যেন একটা পানিতে নড়ছে। কী করে যেন উনি টের পান এ নড়াচড়া মাছের নয়। দাদি দৌড়ে এসে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ততক্ষণে আমি বেশ দূর তলিয়ে গেছি। বেশ কিছুক্ষণ ডুবিয়ে আমাকে তুলে আনেন।
আমি আমার নিজের দাদিকে দেখিনি। মাকেও খুব ভালো স্মরণ করতে পারি না। তারপর ওই দাদি আমাদের সঙ্গে এমন ভাবে মিশে ছিলেন, বেশ বড় হয়ে বুঝতে পারি যে তিনি আমাদের আপন দাদি নন। বলতে গেলে আমাকে আর সৈকতকে তিনিই লালন পালন করেন। সেই শেওড়াপাড়া থেকে তিনি প্রায়ই আমার চেম্বারে আসতেন। স্টাফদের আগে থেকে বলা ছিল। তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করত সবাই। চেম্বারে ঢুকেই রোগীদের সামনে বলতেন—কীরে, ওই পাগলা, তোর মুখটা কেমন শুকনা দেখছি। কি খাইছস। নে, তোর জন্য মুরগির তরকারি আর রুটি বানিয়ে আনছি। তারপর রোগীদের বলতেন—আপনেরা দশ মিনিট অপেক্ষা করেন। পাগলটারে দুটো খাওয়ায়ে আমি চলে যাব।

পুকুর ঘাট। প্রতীকী ছবি
পুকুর ঘাট। প্রতীকী ছবি

সপ্তাহে দুই–তিনবার তিনি আসতেন। অস্ট্রেলিয়ায় আসার আগে মনে হয়েছিল, দাদি আমাকে বিদায় দেবেন না। একেবারেই অসম্ভব। রাগে অভিমানে হয়তো চড় থাপ্পড়ও মেরে বসতে পারেন। দৃশ্যটা মানতে পারব না বলে, তাঁকে না জানিয়েই চলে আসি। আসার পর দাদির সঙ্গে আর কথা হয়নি। প্রায়ই এসে হাসপাতালটা ঘুরে যেতেন। কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। স্কাইপেতে দেখে একদিন অবশ্য চেষ্টা করেছিলাম দাদির সঙ্গে কথা বলতে। সারোয়ার ফোনটা দাদির কাছে দিতে চাইলে তিনি নীরবে সরে পড়েন। যখনই চেম্বারে বসি সারাক্ষণই আমার মনে হয়, এই বুঝি দাদি এসে ঢুকলেন। পরক্ষণেই ভাবি, না। এ আমার ভুল। এই সিডনিতে আমার দাদি আসবেন কোত্থেকে।
গতকাল দাদি মারা গেছেন। খবরটা শোনার পর থেকে বারবার নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। থেকে থেকে শুনছি কেবল দাদির আদরমাখা ডাকগুলো। কীরে। ওই পাগলা। কি খাইছস। চোখের সামনে ভেসে উঠছে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন আমার এমন হাজারো দাদি। যাদের আছে বুকভরা আদর। দেখার নেই কেউ। হাসপাতালের সামনে রাস্তায় বসে কমলা বিক্রেতা ওই রহিম মিয়া? ডাক্তার সাব। আমার ছোট্ট দুইটা ছেলে। আমারে বাঁচান।
অথচ তাদের টাকাতেই অর্জিত আমার এ ডাক্তারি বিদ্যা। আজ এই অস্ট্রেলিয়ানদের চিকিৎসা করি আমি। পৃথিবীর সব মানুষই মানুষ। তবে পৃথিবীর সকল মানুষই রহিম নয়। হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে আমার ড্রাইভারের হাতে যে ধরিয়ে দিত ডজনখানিক কমলা। আজ এই অস্ট্রেলিয়ায় আমার ওই দাদির মতো একজন নারীকেও খুঁজে পাব না, যিনি একটা ভালো তরকারি রান্না করে আমাকে না খাইয়ে নিজে খেতে পারেন না। রোগীদের আরও কত আন্তরিকতা। ভালোবাসা। পদ্মার ইলিশ। নিজেদের বাগানের পেয়ারা। পেঁপে। আম। শিমের তরকারী দিয়ে ভাপা পিঠা। টাটকা খেজুরের রস। ওই রহিম। মরে তো গেলই। তার ছোট্ট দুটো ছেলে। কৃতজ্ঞতার ঋণ। কোনো এক অদৃশ্য ইঙ্গিত আমারে ডেকে বলে। ওরে নজরুল, তুই ওদের অভিভাবক।
ও হে। আমার সময় হয়ে গেছে। একটা ট্যাক্সি ডাক তো।
এতক্ষণ কী এক স্বপ্নের ভেতর ডুবে ছিলাম আমি। বুশফায়ার হওয়া এমন গরমেও শরীরটা যেন শীতল হয়ে গেছে। টের পাই। সেই ছেলেবেলা হতে জীবনকে আজ যেন অন্যভাবে টের পাই।
হঠাৎ সচেতন হয়ে বললাম—না। ভাই। ট্যাক্সি ডাকতে হবে না। আমি যাব আপনাকে নিয়ে। চলুন।

*ইসহাক হাফিজ, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিপ্রবাসী। ইমেইল: <[email protected]>
ফেসবুক: Ishaque Hafiz <www.facebook.com/ishaque.hafiz>