সেশনজটে ক্ষয়ে যায় সমাজ

লেখক
লেখক

আমি যখন স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা শুরু করি, আমার বয়স তখন ২৯। লক্ষ্য করে দেখলাম, আমার সহকর্মীদের বয়স ২৪ কী ২৫। বয়সের এই পার্থক্যটুকু হওয়ার কথা ছিল না। আমার শিক্ষাজীবন দেরি করে শুরু হয়নি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো ফেল করেছি তাও নয়। তবে আমি জন্মেছিলাম এক হতভাগ্য সমাজে যেখানে সেশনজট নামে একটি শব্দ আছে। দুনিয়ার কোথাও এই শব্দটির অস্তিত্ব নেই। কোনো সভ্য শিক্ষিত দেশের মানুষজন সেশনজট বিষয়টি বোঝেন না। অথচ আমার দেশের অসংখ্য ছেলেমেয়ের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এই সেশনজটে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর দেখলাম জীবন থেকে অতিরিক্ত চারটি বছর ক্ষয় হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় যে সনদ দিয়েছে, সেখানে এই হারিয়ে যাওয়া সময়ের কথা লেখা ছিল না। এই হারিয়ে যাওয়া সময়ের জন্য আমি যে পরবর্তী জীবনে ধুঁকেছি, সে জন্য কোনো শিক্ষক, কর্তৃপক্ষ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় আমার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। কোনো দিন কেউ এসে বলেনি, ‘উই আর সরি!’

গবেষণায় আগ্রহ ও সাফল্য দেখে আমার সুপারভাইজার আমাকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন আমি চার-পাঁচ বছর দেরি করে পিএইচডি শুরু করেছি। তাকে আমি কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করেও এই সেশনজট বিষয়টা বোঝাতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয় যে অকারণে বন্ধ থাকতে পারে, কোনো দেশ সেটা কল্পনাও করতে পারে না। নিয়মিত পরীক্ষা না হওয়া, সময়মতো ফলাফল না দেওয়া, উপাচার্য অপসারণের জন্য ধর্মঘট ইত্যাকার হীন ও ঘৃণ্য ঘটনা আমাদের দেশ ছাড়া কোথাও হয় না। আমরা জেনেশুনে ছেলেমেয়েদের জীবন নিয়ে হেলাফেলা করি। এর চেয়ে বিষাদময় আর কি হতে পারে, আমার জানা নেই।
সারা দুনিয়ার ছেলেমেয়েরা ২৫-২৬ বছর বয়সে পিএইচডি শেষ করে ফেলে। অথচ এই বয়সে আমাদের দেশের বহু ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেই বের হতে পারে না। এর মাশুল দিতে হয় এই শিক্ষার্থীদেরই। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তাঁরা পিছিয়ে পরে অনেক। স্কুলে আমাদের ‘সময়ের মূল্য’ রচনা পড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বুড়ো করা হয়। অথচ এই প্রবঞ্চনার জন্য শিক্ষার্থীরা দায়ী নয়। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য আছেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আছে। কিন্তু হতভাগ্য শিক্ষার্থীদের দেখার কেউ নেই। তাদের সময়ের কথা ভাবার কারও সময় নেই।
বহু শিক্ষার্থী তাদের মনের কষ্ট নিয়ে ইমেইল করেন। জীবনের দুর্বিষহ অবস্থার কথা জানান। তাদের এই সব কথা পড়ে হাহাকার লাগে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। সেশনজটের কারণে বহু ছেলেমেয়ে সময়মতো পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে না। দেশের অনেক পরিবার তাদের একটি উপার্জনক্ষম সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই সন্তান যখন মাসের পর মাস শুধু পরীক্ষা বা ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করে তখন সে পরিবারগুলোতে হতাশার ছায়া নামে। ইউজিসির চেয়ারম্যান কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা কি এইগুলো কখনো ভাবেন? তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের যতটুকু সক্রিয় করে রাখেন, শিক্ষার্থীদের জীবনকে সহজ ও সুগম করার কাজে ততই নিষ্ক্রিয় করে রাখেন।
আমাদের বহু শিক্ষার্থী বিশ্বমানের শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ পান না। তদুপরি যদি যৌবনের মোক্ষম সময় থেকে কয়েকটি বছর ক্ষয়ে যায়, তাহলে নিজেকে প্রস্তুত করার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়। আর এমন সামষ্টিক বঞ্চনার কারণে অনেকের ভেতর নেমে আসে নৈরাশ্যের অন্ধকার। এই তরুণগুলোকে এভাবে বঞ্চিত করার কোনো অধিকার কি আমাদের আছে? এটা কি অপরাধ নয়? সমাজের তরুণদের জীবন থেকে সময় কেড়ে নিয়ে পরোক্ষভাবে সমাজেরই ধ্বংস ডেকে আনছি আমরা। সে সমাজের তরুণেরা হতাশা ও নিরাশায় মাথা ঝুঁকিয়ে রাখে, সে সমাজ সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করছি, তরুণদের জীবন থেকে সেশনজট শব্দটি মুছে দিতে দৃঢ় পদক্ষেপ নিন। উপাচার্যদের কাছে করজোড়ে বলছি, শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্যবান সময়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন। অকারণে তাদের জীবনের সময় যেন নষ্ট না হয় সেদিকে কঠোর নজর দিন। রাজনীতির কাছে নিজেকে বিকিয়ে না দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনকে সুগম করুন। তারা যেন দুনিয়ার মঞ্চে উঠে দেশের জয়গান গাইতে পারে, সেই বিষয়টুকু মাথায় রাখুন। সেশনজট নামক এই নিকৃষ্ট শব্দটিকে আমাদের সমাজ থেকে মুছে ফেলুন। অসংখ্য শিক্ষার্থীদের হয়ে, মিনতি করে বলছি!

*ড. রউফুল আলম: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <rauful. [email protected]>, ফেসবুক: <facebook.com/rauful15>