বাংলায় দেখি স্বপ্ন বাংলায় বাঁধি সুর

আড্ডার দৃশ্য
আড্ডার দৃশ্য

একজন মানুষ দেশে থাকতে নিজের দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা তেমন একটা না অনুভব করতে পারলেও বিদেশে আসার পর মনেপ্রাণে সেগুলোর প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেটাকে কীভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায় সেই উপায় খুঁজতে থাকে। যাতে করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সেটা চলতে থাকে আর নিজ দেশের মাহাত্ম্য প্রচার করতে থাকে।

অস্ট্রেলিয়াতে আসার পর নিজের মেয়েকে কীভাবে বাংলা ভাষা শেখানো যায় অথবা দেশ থেকে যতটুকু শিখে এসেছিল, তা কীভাবে শান দেওয়া যায় সেই ভাবনাটা ছিলই মনে মনে। সিডনিতে আসার দুই সপ্তাহের মধ্যেই খবর পেলাম, মিন্টোতেই বাংলাদেশি কমিউনিটির একটা স্কুল আছে। নাম ক্যাম্বেল্টাউন বাংলা স্কুল। প্রতি রোববারে সকাল ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত চলে তার কার্যক্রম।
সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ভাষা শিক্ষা তারপর ছোট একটা বিরতি। তখন বাচ্চাকাচ্চারা টিফিন খায়, খেলে বা হইচই করে। দেখলে নিজেদের শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়। বিরতির পর শেখানো হয় গান। বিভিন্ন বয়সী অনেকগুলো বাচ্চা কোরাসে বাংলা গান করছে—দৃশ্যটা এতই মধুর দেখে মনে হয় যেন অস্ট্রেলিয়ার বুকে ছায়ানটের একখণ্ড শিক্ষায়তন।
যা হোক, মেয়েকে নিয়ে রোববারে হাজির হয়ে গেলাম। আমি এসেছি সবে দুই সপ্তাহ হয়েছে। এরই মধ্যে বাচ্চাকে বাংলা স্কুলে নিয়ে এসেছি শুনে সবাই খুবই বাহবা দিল। কারণ বাংলা ভাষা এখানে কোনো কাজে আসে না বলে সিংহভাগ অভিভাবকই বাংলা স্কুলে আসার ব্যাপারে চূড়ান্ত অনীহা প্রকাশ করেন। তা ছাড়াও নিজের ছেলেমেয়ের মেধাকে আরও শাণিত করে ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার বানানোর ছুঁচোর দৌড়ে শামিল করানোর জন্য ছুটির দুই দিন শনি ও রোববারে থাকে বিভিন্ন প্রকার কোচিং ক্লাস ও টিউশনির দৌড়ঝাঁপ। এরপর আর এনার্জি থাকে না বাংলা স্কুলে আসার। না বাচ্চার না তার অভিভাবকের। এ ছাড়া চক্রাকারে চলা দাওয়াতের পালাতো থাকেই। আর তা না হলে পরিবার নিয়ে কোথাও ঘুরতে যায়। তার মধ্যে বাংলা স্কুলে বাচ্চা নিয়ে আসলে সেই দিনটাই মাটি। তাই মিন্টোতে বসবাসকারী বেশির ভাগ বাংলাদেশি বাচ্চাকাচ্চারা বাংলা স্কুলে আসতে চায় না।
প্রথম দিন গিয়েই ভাই–ভাবিদের সঙ্গে দ্রুত খাতির জমে গেল। আসলে একই মানসিকতার মানুষ হলে তাদের মধ্যে সখ্যতা হতে সময় লাগে না। বাচ্চারা ক্লাসে থাকে। সেই ফাঁকে চলে আমাদের আড্ডা আর তার সঙ্গে চা ও বাংলাদেশের টোস্ট বিস্কুট। দেখে মনে হতে পারে গ্রামের বাড়ির খানকা ঘরে (বৈঠকখানা) বসে কিছু মানুষ আড্ডা দিচ্ছেন।
এখানে আড্ডার বিষয়বস্তু তথাকথিত বিষয়বস্তু থেকে একটু ভিন্ন। কার কয়টা বাড়ি, কার বাচ্চার রেজাল্ট ভালো, কার গাড়ি কেমন এগুলো কখনো ভুলক্রমে এসে পড়লে খুবই সাবধানে সরিয়ে রাখা হয়। এখানে আড্ডা চলে বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বিবর্তন ও বিস্তার নিয়ে। উপন্যাস–কবিতায় বাংলা ভাষা কীভাবে এসেছে সেটা নিয়েও চলে বিস্তর গবেষণা।
একবার আড্ডা শুরু হলে আর সময়জ্ঞান থাকে না। বাচ্চাদের ক্লাস শেষ হয়ে যায় কিন্তু অভিভাবকদের আড্ডা চলতেই থাকে অবিরাম। আর সঙ্গে সঙ্গে চলে চা-টোস্টের শ্রাদ্ধ। এখানে যারা আড্ডা দেন তাদের আড্ডা শুধুমাত্র নিজেদের বিনোদনের খোরাক নয় বরং সেগুলো বাংলা ভাষাকে এই ভিনদেশে আরও কীভাবে সমৃদ্ধ করা যায় সেটা নিয়ে। প্রত্যেকের পড়াশোনা ও জ্ঞানের গভীরতা থাকায় আড্ডাটা হয় খুবই প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য।

শিশুদের পরিবেশনা
শিশুদের পরিবেশনা

বাংলাদেশিদের বেশির ভাগ আড্ডায় যেখানে একপর্যায়ে গিয়ে হাতাহাতিতে শেষ হয় সেখানে এই আড্ডাটা শেষ হয় হয়তো রবীন্দ্রনাথ–নজরুল অথবা হালের শাহাবুদ্দিন আহমদে। আড্ডার বিষয়বস্তুরও রয়েছে ভিন্নতা। কখনো ভাষা, কখনো গান, কখনো বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িকতার ইতিবৃত্ত। তাই এক আড্ডা শেষ হলেও দেখা যায় বিষয়বস্তুর তখনো কোনো কুল কিনারা হয় না। তাই পরের সপ্তাহে আবার কখন এই আড্ডা বসবে সেটা নিয়ে সবাই মুখিয়ে থাকেন।
এরই সূত্র ধরে দল বেঁধে সব অভিভাবক একসঙ্গে মিন্টোর মসজিদে তারাবির নামাজ পড়তে যাওয়া। নামাজ শেষে সেভেন ইলেভেনে গিয়ে কফি খেয়ে কনকনে ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে মধ্যরাত অবধি আড্ডা দেওয়ারও একটা চল শুরু হয়ে গেল। এ যেন বাংলাদেশের পাড়ার কিছুর উঠতি বয়সী তরুণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। এ ছাড়াও শুরু হয়ে গেল বিভিন্ন বাসায় খাওয়ার শেষে গানের আসর বসানো।
বাচ্চারা সবাই একসঙ্গে খেলাধুলা করে। আর বড়রা দেশের রাজনীতি–অর্থনীতি নিয়ে গুষ্টি উদ্ধার না করে সংগীত চর্চা করেন। এখানে বাইরের কোনো শিল্পী বা বাদক নেই। সবই করা হয় নিজেরা নিজেরা। বাইরের কোনো শিল্পীকেও আমন্ত্রণ করা হয় না। কারণ সবাই সিডনিতে নিজ নিজ জীবিকার বাইরেও শিল্পী বা বাদক পরিচয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। বাচ্চাদের গান দিয়ে শুরু করে গান বাজনা চলতে চলতে কখন যে মধ্যরাত পেরিয়ে যায় তার কোনো হিসাব থাকে না।
এখানে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, পরবর্তী প্রজন্ম দেখছে আমাদের এই কর্মকাণ্ড এবং তারাও তাদের সাধ্য অনুযায়ী করছে অংশগ্রহণ। কেউ পড়ছে ছড়া, কেউবা কবিতা। কেউ করছে গান। যদিও তারা হাসতে খেলতে এগুলো করছে কিন্তু আমি নিশ্চিত যখন তারা বড় হবে তখন তাদের শৈশবের এই স্মৃতি বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের মমত্ববোধ ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
যেমন আমরা শৈশবে যখন খালি পায়ে শহীদ মিনারে যেতাম তখন কিছু না বুঝেই বড়দের কথার পালন করতাম। কিন্তু এখন আমরা বুঝি কেন করতাম এবং কেন করতে হবে। কিন্তু আমরা যদি শৈশবে এগুলো না করতাম তাহলে কখনোই এগুলোর প্রতি মমতা বোধ করতাম না। তাই আমরা সমমানসিকতার সাতটা পরিবার আর একজন আছেন যিনি আমাদেরও অভিভাবক ও পথ প্রদর্শক তার নেতৃত্বে চলে আমাদের এই বাংলাদেশি সংস্কৃতির চর্চা।
আমরা স্বপ্ন দেখি একদিন আমাদের এই প্রজন্ম বড় হয়ে শৈশবের এই সকল অর্থহীন কর্মকাণ্ডের মানে খোঁজার চেষ্টা করবে এবং অবধারিতভাবেই তারা বাংলাদেশি সংস্কৃতির প্রতি তাদের ভালোবাসা কাজ করা শুরু করবে। তারা চিন্তা করবে আমাদের বাবা-মায়েরা এ দেশে এসে এত সংগ্রামের জীবন বেছে নিয়েও আমাদের বাংলাদেশি সংস্কৃতির শিক্ষা দিয়েছে। তাহলে আমরা কেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সেটা শিক্ষা দিতে পারব না। কারণ আমরা এখনই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভিত্তিটা তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছি।
তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবের এই দিনে দেশ আর এখন কোনো ভৌগোলিক ভূখণ্ডের মধ্যে আটকা পড়ে নেই। একটা দেশের মানুষ যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই তৈরি হচ্ছে আলাদা একটা দেশের সংস্কৃতির। আর এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যই এখন পর্যন্ত বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই সেসব দেশের সরকারও সেগুলো সংরক্ষণের জন্য ভূমিকা রাখছে। নতুন প্রজন্ম একই সঙ্গে ভিনদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির শিক্ষা পাচ্ছে আবার ভুলে যাচ্ছে না নিজের শিকড়কে। এতে করে তারা স্থানীয় বাচ্চাদের তুলনায় প্রথমেই একধাপ এগিয়ে থাকছে। এখানে স্থানীয় বাচ্চারা অনেক কষ্ট করে দ্বিতীয় ভাষা শিখছে আর আমাদের বাচ্চারা এই বাংলা স্কুলের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেটা এমনিতেই শিখে যাচ্ছে। তাই রক্তের বিনিময়ে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আজ আর কোনো অর্থহীন বিষয় নয় বরং নতুন প্রজন্মের দিশা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এভাবেই বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সদা জাগরুক থাকবে।

*মো. ইয়াকুব আলী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।