হেলভেশিয়ার পথে প্রান্তরে

ফুরকা পাসে লেকের ধারে
ফুরকা পাসে লেকের ধারে

সুইজারল্যান্ডের আরেক নাম হেলভেশিয়া। লাতিন ভাষার প্রভাব এখানেও দেখা যায়। অফিশিয়ালি সুইজারল্যান্ডকে লাতিন ভাষায় ‘কনফয়েডেরাশিয়ো হেলভেশিয়া’ বলা হয়। ইউরোপের সেল্টিক উপজাতির একটি উপজাতিকে দ্য হেলভেশিয়ান বলা হতো। তারাই প্রধানত সুইজারল্যান্ডের আদি অধিবাসী। তবে সুইজারল্যান্ডে মূল বসতি শুরু হয় রোমান সাম্রাজ্যের পতনের শুরুর দিকে ৪০০ খ্রিষ্টাব্দে। ১২৯১ সালের পয়লা আগস্ট সুইজারল্যান্ড একটি রাষ্ট্রে রূপ লাভ করে এবং এই দিনকে সুইসরা জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন করে। ১৬০০ শতাব্দী পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে গণ্য করা হতো না। ১৬৪৮ সালের ইউরোপিয়ান শান্তি চুক্তির মাধ্যমে সুইজারল্যান্ড অফিশিয়ালি একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৮১৫ সালের ভিয়েনা কংগ্রেস অনুযায়ী সুইজারল্যান্ড একটি নিরপেক্ষ দেশ, যারা নিজ থেকে কোনো যুদ্ধে জড়ায় না এবং যুদ্ধের সময় বিশেষ কোনো পক্ষকে সমর্থনও করে না। কিন্তু তারা দুই পক্ষের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করে। তবে সুইস সেনাদল ন্যাটোর শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে কাজ করে।

ফুরকা পাসে লেকের ধারে
ফুরকা পাসে লেকের ধারে

এই সুইজারল্যান্ডের পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে ধরিত্রীর অপার সৌন্দর্য। যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আবার চর্মচক্ষে দেখলেও স্বপ্ন মনে হয়। ৭ হাজার মিঠা পানির হ্রদসমৃদ্ধ সুইজারল্যান্ডকে লেক বা হ্রদের দেশও বলা যায়। এর মাঝে ১০৩টি হ্রদের আয়তন ৩০ হেক্টরের চেয়ে বেশি। লেকের স্বর্গ্যরাজ্যে পাহাড়-পর্বতেরও কমতি নেই। অন্য দেশেও পাহাড়-পর্বত-হ্রদ আছে। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে পার্থক্য কোথায়? সুইসরা প্রকৃতির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাটাকে এমনভাবে সাজিয়েছে যে, একজন ভ্রমণকারী চাইলেই ট্রেনে চেপে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ১৫৮ মিটার উঁচু ইউনফ্রাউতে (কুমারী রমণী) পৌঁছে যেতে পারবেন।
ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের রূপও বদলাতে থাকে। শীতে যে রমণী দুধসাদা তুষারের চাদর জড়িয়ে থাকে সেই আবার সবুজের মখমল জড়ায় গ্রীষ্মে। হেলভেশিয়ার এই রূপ যেন ঈশ্বরের নিজ হাতের পরম মমতায় গড়ে ওঠা। যেখানে আলো, বায়ু আর মেঘের সুষম বণ্টন সবুজকে করে তোলে আরও সবুজ আর সাদাকে করে তোলে দুধ সাধা। সৃষ্টিকর্তা ঠিক যেন একমুঠো রোদ্দুর, দুই চিমটি বায়ু আর আধা লিটার বৃষ্টিতে সাজিয়েছেন হেলভেশিয়ার প্রকৃতি। যা হ্রদ, পাহাড় আর নদীগুলোকে ভার্নিয়ার স্কেল দিয়ে মেপে সঠিক পুষ্টি দান করে আর প্রকৃতি ভরে ওঠে অপার স্বর্গীয় সৌন্দর্যে।

বাসেল বাংলা স্কুলের বাৎসরিক বনভোজনে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ
বাসেল বাংলা স্কুলের বাৎসরিক বনভোজনে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

এই অকৃত্রিম সৌন্দর্যমণ্ডিত দেশে যেসব বাংলাদেশিদের বাস তাদেরও আপ্রাণ চেষ্টা থাকে খুব কাছ থেকে প্রকৃতিকে অবলোকন করা। একা, পরিবার নিয়ে অথবা দল বেঁধে। বিভিন্ন শহরে বসবাসকারী বাংলাদেশি প্রবাসীরা বাৎসরিক বনভোজনের আয়োজন করে থাকেন দল বেঁধে সুইজারল্যান্ডের রূপ-লাবণ্য উপভোগ করার জন্য। এতে করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে পারস্পরিক সম্প্রীতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের মতো একটি ব্যয়বহুল দেশে অল্পখরচে প্রকৃতিকে উপভোগ করা যায়।
বাসেল ‘বাংলা স্কুলের’ উদ্যোগে বাৎসরিক বনভোজন আয়োজিত হয়ে গেল কিছুদিন আগে। সুইজারল্যান্ডে বনভোজনের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো গন্তব্যের প্রয়োজন হয় না। বাস নিয়ে যেকোনো একদিকে রওনা হয়ে গেলে পথিমধ্যে ৫-১০টা লেকের দেখা মিলবে। সেই সঙ্গে পাহাড় আর নীল আকাশের গভীর মিতালি। যেকোনো লেকের ধারে বসে বনভোজনের ভোজনটা সেরে নিলেই হয়ে গেল।

ফুরকা পাসে লেকের ধারে
ফুরকা পাসে লেকের ধারে

তারপরও গন্তব্য ঠিক করা হলো বালিস ক্যান্টন। জার্মান ভাষায় বালিস লিখতে ইংরেজির ডব্লিউ ব্যবহার করা হয়। আমার মতো ২-৪ আনা জার্মান জ্ঞানের অধিকারীরা যাকে উচ্চারণ করে ওয়ালিস। ওয়ালিস হোক আর বালিসই হোক সেই ক্যান্টনে সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে ভয়ংকর রাস্তা বেয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ১৫৮ মিটার উচ্চতায় ওঠা যায় গাড়ি নিয়ে। বালিসের সেই জায়গাকে বলা হয় ফুরকা পাস। বালিস প্রকাশ্য গন্তব্য হলেও ফুরকা পাস ছিল গোপন গন্তব্য। কেননা যাদের উচ্চতা ভীতি আছে তারা গন্তব্যের কথা জানলে হয়তো বেকে বসতে পারেন। তাই ফুরকা পাসের কথা গোপন রাখা হয়।

বাসেল বাংলা স্কুলের বাৎসরিক বনভোজনে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ
বাসেল বাংলা স্কুলের বাৎসরিক বনভোজনে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

০০৭ খ্যাত জেমস বন্ডের অন্যতম মুভি গোল্ড ফিঙ্গারের একটি বহুল আলোচিত দৃশ্যের শুটিং করা হয় এই ফুরকা পাসে ১৯৬৪ সালে। তখন থেকেই হয়তো ফুরকা পাস বিখ্যাত। পাহাড়ের চূড়া জলকণা ভর্তি মেঘে ঢাকা। সেখানে উঠে চক্ষু চড়কগাছ। ইয়া বড় এক হ্রদ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ১০০ মিটার উচ্চতায় পাহাড়ের চূড়ায় হ্রদ। এখানকার পানির উৎস হলো বৃষ্টি ও গ্লেসিয়ার। এই ভয়ংকর সৌন্দর্য দেখে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে গেল—‘ঈশ্বর এই দুই চক্ষু যেমন দিয়েছিলেন, আজ তার সার্থক করিলেন’।
এত কিছুর পরেও হৃৎপিণ্ডে কেমন যেন শূন্যতা অনুভব হয়। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো অবচেতন কোনো এক ছায়ায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। সে ছায়া বাংলাদেশের নদ-নদী, পাহাড়-সাগর আর সবুজের ছায়া।
প্রকৃতির এ নিবিড় সান্নিধ্যে আসার পরও এই শূন্যতার নাম বুঝি মায়া। জন্মভূমি প্রতি মায়া।

হারুন-অর রশিদ: পিএইচডি গবেষক। বায়োজেন্ট্রাম, ইউনিভার্সিটি অব বাসেল, সুইজারল্যান্ড।