বিস্মৃত এক বাঙালি বিজ্ঞানী

জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ
জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ

বিশ শতকের উষালগ্নের কথা। রসায়নসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার স্বর্ণযুগের হলো সূচনা। ইউরোপ জুড়ে প্রতিযোগিতা দিয়ে আবিষ্কার-উদ্ভাবন হচ্ছিল সে সময়। সহস্র বছরে যা উদ্ভাবিত হয়নি, বিশ শতকের প্রথমাংশেই তা হয়েছে। সৃষ্টির সে বাতাস লেগেছিল এই বাংলাতেও। বাংলার অদম্য মেধাবী কিছু তরুণ তখন এই ঢাকা কিংবা কলকাতায় বসেই, মেধার দুরবিন দিয়ে দেখতেন বিজ্ঞানের রেনেসাঁ। তাঁরা উদ্বুদ্ধ হতেন। অনুপ্রাণিত হতেন। তাঁদের মগজে আঘাত হানত সৃষ্টির নেশা। সে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এক তরুণের নাম জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ।

১৯০৩ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেলেন সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস। রসায়নে তাঁর গবেষণা তখন খুবই স্বীকৃত ও প্রশংসিত। আরহেনিয়াসের কাজ যখন সারা দুনিয়ার কেমিস্টদের মধ্যে এক ঢেউ তোলে, প্রেসিডেন্সি কলেজের এক তরুণ তখন সে কাজের একাংশে খুঁজে পায় কিছুটা সীমাবদ্ধতা (Limitation)। সে সময়ে কোনো ইন্টারনেট নেই। বাংলায় বিজ্ঞানবিষয়ক কোনো উঁচুমানের কাগজ বা ম্যাগাজিন নেই। ইউরোপ-আমেরিকায় একটি চিঠি পাঠাতে লাগত পক্ষকাল। অথচ সে সময়ে জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র নিভৃতে বসে, একজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীর কাজের আরও উন্নতি সাধনের (Further development) চেষ্টায় নিমগ্ন হয়ে রইলেন। কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার!

স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ও অন্যান্য বাঙালি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তরুণ জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ (সামনের সারিতে ডানে)
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ও অন্যান্য বাঙালি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তরুণ জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ (সামনের সারিতে ডানে)


জ্ঞানেন্দ্র তাঁর গবেষণার কাজ গোছালেন। বৈজ্ঞানিক আর্টিকেল হিসেবে লিখলেন। পাঠালেন জার্নালে। তাঁর আর্টিকেল প্রকাশিত হলো। শুধু প্রকাশিত হলো লিখলে অনেক অপূর্ণতা থেকে যায়। জ্ঞানেন্দ্রের কাজ প্রকাশিত হয়েছিল জার্নাল অব দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি (JACS) নামক জগৎখ্যাত জার্নালে। সেটি ছিল তার প্রথম আর্টিকেল। বছরটা ১৯১৪। জ্ঞানেন্দ্রের বয়স তখন মাত্র বিশ। জ্ঞানেন্দ্র ছিলেন সেই আর্টিকেলের একমাত্র লেখক (Sole Author)। তিনি তখন পিএইচিডিও শুরু করেননি। এই বিষয়টা যে কতটা বিস্ময়কর, সেটা যারা গবেষণা করেন তারাই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। তাঁর গবেষণা তখন যথারীতি আরহেনিয়াস ও অন্যান্য জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের নজর কেড়েছিল। নোবেল বিজয়ী আরহেনিয়াস তখন স্টকহোম ইউনিভার্সিটির* শিক্ষক। স্টকহোমে বসে তিনি জানতেন, বাংলার কোনো এক তরুণ তার বিষয় নিয়ে কাজ করছে, ভাবতেই কী শিহরণ জাগে। অল্প সময় পরই তিনি চলে গেলেন বিলেতে। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে ডক্টরেট (D.Sc.) ডিগ্রি নিলেন। তাঁর বয়স তখন মাত্র চব্বিশ! তখনই তাঁর কাজ প্রশংসিত হয়েছিল খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের দ্বারা। তাঁদের মধ্যে উইলাম ব্র্যাগ, ম্যাক্স প্লাংক ও নার্নস্ট প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। উল্লেখিত তিন বিজ্ঞানীই নোবেল বিজয়ী। ভারতবর্ষে তিনি পরিচিত হলেন জ্ঞান ঘোষ নামে আর ইউরোপে পরিচিত হলেন জি সি ঘোষ নামে।
১৯২১ সালে জ্ঞান ঘোষ বিলেত থেকে কলকাতায় ফিরলেন। সে বছরই ঢাকায় এসে পৌঁছলেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালেই তাঁকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পি জে হার্টগের অফিস থেকে। জ্ঞানেন্দ্রকে নিয়োগ দেওয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। সাতাশ বছরের টগবগে যুবক জ্ঞান ঘোষকে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বও নিতে হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেন দেড় যুগ। শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন গভীরভাবে। ঢাকায় বসেই মৌলিক গবেষণা করতেন। গবেষণার সে সকল কাজ প্রকাশিত হতো ইংল্যান্ডের রয়াল সোসাইটিসহ অন্যান্য জার্নাল থেকে। ১৯৩৯ সালে তিনি চলে গেলেন ভারতে। সেখানে গিয়ে তাঁকে সময়ে সময়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। তাঁকে করা হলো খড়গপুর আইআইটির ডাইরেক্টর। পরবর্তীতে হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। ইংরেজ সরকার তাঁকে নাইটহুড দিয়ে সম্মানিত করল। ভারতবর্ষে বিজ্ঞানচর্চায় অবদানের জন্য তাঁকে দেওয়া হলো পদ্মভূষণ।

জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র ঘোষের প্রথম আর্টিকেলের প্রচ্ছদ
জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র ঘোষের প্রথম আর্টিকেলের প্রচ্ছদ


জ্ঞান ঘোষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টিকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে দেখেছেন। আঠারো বছরের শিক্ষকতা ও গবেষণা জীবনে ছড়িয়েছেন আলো। সে আলো ঠিকরে পড়েছিল এই বাংলায়। তাঁর গবেষণা ছড়িয়ে পড়ে নানান শাখায়। তড়িৎ রসায়ন (Electro Chemistry) ছাড়াও আলোক রসায়নে (Photo Chemsitry) তিনি গভীর গবেষণা করেছেন। সে সময়ে (১৯২৪) তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘জার্নাল অব দ্য ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি’ (JICS)। সে জার্নালকে সমৃদ্ধ করার জন্য তাঁর কাজগুলো তিনি সেখানেই প্রকাশ করেন। আর এ কারণেই তখনকার কাজগুলো আন্তর্জাতিকভাবে নজর কেড়েছে কম। জ্ঞান ঘোষের কাজের প্রয়োগ (application) পাওয়া যায় বিজ্ঞানী ডিবাই এবং হুকেলের গবেষণায়। বিজ্ঞানী ডিবাই ১৯৩৬ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। একাডেমিক ও প্রশাসনিক বহু কাজে জড়িয়ে যেতে হয় তাঁকে। শরীর ভেঙে পড়ে দ্রুত। মাত্র ৬৪ বছর বয়সে, ১৯৫৯ সালে তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর, শোক বার্তা প্রকাশিত হয়েছিল বিজ্ঞানের খ্যাতনামা জার্নাল নেচারে।
জ্ঞান ঘোষের গবেষণাপত্র পড়তে গিয়ে বিস্মিত হয়েছি। তার কর্মজীবন জেনে শিহরিত হয়েছি। এমন আলোকাধারের কথা আমাদের পাঠ্য বইয়ে নেই। তাঁর নামে কোনো স্মারক পুরস্কার কিংবা স্মারক বক্তৃতা নেই। বাংলাদেশ কেমিক্যাল সোসাইটি তাঁর নামে মেধা পুরস্কার চালু করতে পারে। তাঁর নামে স্মারক লেকচার আয়োজন করতে পারে। জ্ঞান ঘোষের মতো জ্ঞানতাপসের আলো যদি ক্ষীণ হতে থাকে তাহলে আমাদের তরুণেরা জাগবে কী করে!

সূত্র
১. <pubs.acs.org/doi/abs/10.1021/ja02188a007>
২. <nature.com/nature/journal/v183/n4662/pdf/183645a0.pdf>
৩. <Current Science,1995,68,1068-1072>

*স্টকহোম ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত গবেষণাগারের বর্তমান নাম ‘আরহেনিয়াস ল্যাবরেটরি’। লেখক সেখান থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

ড. রউফুল আলম: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <facebook.com/rauful15>