প্রবাসের কষ্ট

রাতের সাংহাই। সংগৃহীত
রাতের সাংহাই। সংগৃহীত

আমার প্রথম বিদেশে আসা চীনে। এ দেশে এসে প্রথম তিন দিন বার্গার আর নুডলস খেয়ে কাটালাম। কিন্তু তাতে ভাতের খিদে মিটল না। বাঙালি বলে কথা! ভাত ছাড়া আমাদের চলেই না। চতুর্থ দিন ভাতের খোঁজে যখন পাগল প্রায় তখন সন্ধান মিলল এক টার্কিশ রেস্তোরাঁর। যেখানে ১২ ইউয়ান দিয়ে এক প্লেট ফ্রাইড রাইস খেয়েছিলাম। খুব আহামরি না হলেও ডিম দিয়ে ভাজা ওই এক প্লেট ভাত মনে হয়েছিল অমৃত।

সেদিনই অনুধাবন করলাম ভাত না খেতে পারার কষ্টের মতো আর কিছু নাই।
দেশের বাইরে এলে দুইটা বিষয় বেশ কষ্টকর। দ্বিতীয়টা বুঝতে আরম্ভ কিছুদিন সময় লেগেছে।
সেটা হলো ভাষার কষ্ট। বাংলায় বলতে না পারার কষ্ট। সারা দিন জাপানি আর ইংরেজিতে বকবক করতে করতে অনেক ক্লান্ত আমি বাসায় ফিরে যখন বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা বলি অথবা বাংলায় চ্যাট করি মনে হয় আহা, প্রাণটা ফিরে পেলাম।
ইংরেজিতে চ্যাট করা তুলনামূলকভাবে সহজ। ইংরেজি হরফে বাংলা চ্যাট করার সময় এক যন্ত্রণার নাম অটো কারেকশন। লিখি এক আর হয়ে যায় আরেক।
একটা মজার কথা মনে পড়ল। আমার বন্ধু রাজুকে আমি প্রায়শই দাদা বলে ডাকি। একদিন চ্যাটে লিখলাম, Dada ki khobor?
সেন্ড করার পর দেখি ওটা হয়ে গেছে— Dad ki khobor?
বিব্রতকর অবস্থা!
ইদানীং আমার ফোন মনের কথা বুঝতে শুরু করেছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। ধরা যাক, আমি আমার আব্বুর সঙ্গে চ্যাট করছি। চ্যাটে লিখলাম, Dad ki khobor? ওটা হয়ে গেল, Dada ki khobor? এবারও বিব্রতকর অবস্থা!
আরেকটা ব্যাপার বলি। জাপানিরা মোট তিনটি বর্ণমালা ব্যবহার করে। প্রথম দুটি ওদের নিজস্ব বর্ণমালা হিরাগানা ও কাতাকানা। এক একটিতে বর্ণ আছে ৪৯টি। তৃতীয়টি হলো চাইনিজ কাঞ্জি। যার কোনো সংখ্যা নাই, হাজার হাজার। এত কিছুর পরেও তারা পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক শব্দই উচ্চারণ করতে পারে না।
এই যেমন আমার নাম ওরা বেলাল বলতে পারে না। বলে, ‘বেরারু’। বাংলাদেশ উচ্চারণ করতে পারে না। বলে, বাংগুরাদেশ।
তাদের প্রায় দেখা যায় মোবাইলে সার্চ দিয়ে কাঞ্জি লিখছে। সুযোগ বুঝে আমিও এক হাত নিতে ছাড়ি না। বলি, বাংলা ভাষায় সব মিলিয়ে ৫০টি বর্ণ হলেও পৃথিবীর প্রায় সব শব্দই উচ্চারণ করা যায়। এটা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা। তোমাদের উচিত বাংলাভাষা ব্যবহার করা।
এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ, সহজ-প্রাঞ্জল ও মধুর ভাষা যাদের আত্মদানের বিনিময়ে পেয়েছি তাদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা।
তিন বছর আগে এক ফেব্রুয়ারিতে ফেসবুকে যখন এ বিষয়ে একটা পোস্টটি দিয়েছিলাম তখন কানাডায় পিএইচডিরত আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রিয় শিক্ষক রাজিব স্যার মন্তব্য করেন, ‘বিদেশে আরেকটা কষ্ট আছে; বদনার কষ্ট’। আলবৎ!

বেলাল হোসেন: সাংহাই, চীন।