ভালোবাসা আর সম্পর্কের দ্বৈরথ ডুব

ডুব ছবির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, ইরফান খান, নুসরাত ইমরোজ তিশা ও পার্নো মিত্র l ছবি: প্রথম আলো
ডুব ছবির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, ইরফান খান, নুসরাত ইমরোজ তিশা ও পার্নো মিত্র l ছবি: প্রথম আলো

জাভেদ খান (ইরফান খান) আর তার পারিবারিক জীবনের টানাপোড়েনের একপর্যায়ে তিনি টেবিলের জগ থেকে পানি ঢালতে গিয়ে দেখেন পানিশূন্য জগ। তিনি পানি কোথা থেকে জগে আসে তেমন বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করে সমাধান না করতে পেরে হতাশা আর একরাশ জীবনের ক্লান্তি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আড়াল থেকে তার মেয়ে সাবেরি (তিশা) পানির একটি গ্লাস নিয়ে বাবার পেছনে ছুটে যায়। সাবেরি আর তার বাবার সংলাপহীন এই মুহূর্তের বিষাদময় শূন্যতার দৃশ্যায়নে নির্মাতার প্রখর মুনশিয়ানার ছাপ। কী করে শুধু স্মৃতিময় অনুপস্থিতির অভিব্যক্তি একটি মুহূর্তকে পুনর্জীবিত করে তা অভিনেতাদের চরিত্রায়ণের মধ্যে একাকার হয়ে যায়। দৃশ্যটি মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর নতুন সিনেমা ডুব থেকে নেওয়া।

ভিনদেশে নিজ ভূখণ্ডের নির্মাতার চলচ্চিত্র মানেই ভিন্ন আমেজ, ভিন্ন অনুভূতি। ডুব, যা এক সন্ধ্যার পুরো সময়ে ডুবিয়ে রেখেছিল-স্মৃতির শহরের চেনা পথ, জীবনের বাঁক, মধ্যবিত্ত গণ্ডি, সম্পর্কের শীতলতা, অচেনা ঢঙে চেনা মানুষ। গল্প বলার ঢং, মনোবীক্ষণ, চিত্রায়ণ, চরিত্র বিনির্মাণ-সব মিলে জমজমাট দুঃখ নির্মিত হয়েছে এক ক্যানভাসে। একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ক্রমশ জটিল হয়ে পড়া জীবনে পরিবার সমাজ গুরুত্বপূর্ণ নাকি বেঁচে থাকার জন্য নিঃশর্ত ভালোবাসা অপরিহার্য! এই প্রশ্ন নিঃশব্দে জড়িয়ে রয়েছে সমস্ত সিনেমা জুড়ে। তীব্র হাহাকারে ছেয়ে যায় দর্শকের হৃদয়ে। পাশাপাশি এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি সামনে নিয়ে এসেছেন পরিচালক, নিজস্ব কোনো মতামত আরোপ করেননি তিনি।
ফিল্মমেকার জাভেদ খানের স্ত্রী এক মেয়ে আর ছেলে নিয়ে সাদামাটা সংসার। হঠাৎ সেখানে বিনা মেঘে বজ্রপাত। মেয়ের বান্ধবীসম তরুণী নিতুর (পার্নো) সঙ্গে জাভেদের প্রেম ও পরবর্তীতে বিয়ে। এই সংকীর্ণ সমাজের জন্য খানিকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের স্রোত, যা সরল নয় বরং সরস; এই গল্প নির্মাতা গভীর ভালোবাসা আর মমত্ববোধে বেঁধেছেন। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ ব্যবস্থায় নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ফিরে ফিরে এসেছে। নির্মাতাকেও পক্ষপাতিত্ব দোষে দুষ্ট মনে হয়েছে কখনো। সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয়ের সীমারেখাকে অতিক্রম করেননি তিনি। সম্পর্কের ব্যবধান, অস্তিত্বের সংকট, কাছে আসার আকুলতা, বন্ধন ও ভাঙনের পর্যায়ক্রম ফারুকী গভীর মায়াকল্পে আবৃত করেছেন। মানুষের মৃত্যু ঘটে তখনই যখন প্রিয় মানুষের সঙ্গে ভালোবাসাহীন সময়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হয়। এই গভীর উপলব্ধি জীবনকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। দর্শক হিসেবে প্রাপ্তি হয়তো এখানেই!
বাংলাদেশ ভারতের যৌথ প্রযোজনার এই সিনেমায় জাভেদ খান চরিত্রে ইরফান খানের অনবদ্য একনিষ্ঠ অভিনয়, হিন্দিভাষী হয়েও বাংলা বলার পারদর্শিতা উল্লেখযোগ্য। অল্প কিছু ত্রুটি থেকে অনায়াসে চোখ সরিয়ে নেওয়া যায়। অভিব্যক্তির তীব্রতা, সম্পর্কের দোদুল্যমানতা ইরফান খানের গভীর দৃষ্টিতে বিদীর্ণ হয়েছে। নুসরাত ইমরোজ তিশা বরাবরই সুঅভিনেত্রী, তার অভিব্যক্তি চরিত্রের জন্য মানানসই, পুরো সময় জুড়ে বোবা কান্না দর্শককে নাড়া দিতে বাধ্য। রোকেয়া প্রাচীর অভিনয় যথোপযোগী। পার্নো মিত্রা চরিত্রের তীক্ষ্ণতার রেশ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সহযোগী বাকি শিল্পীদের অভিনয় ভীষণভাবে সাবলীল। একটি মাত্র গান (ব্যান্ড চিরকুট) ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন দৃশ্যের প্রয়োজনে। মাদকতা ভরা সেই গানের কথা ও সুর—সমস্ত সিনেমার হাহাকারকে তীব্রতর করেছে।
নির্মাতা ফারুকীর পূর্ববর্তী ছবি থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, পিঁপড়াবিদ্যা ছবিগুলোও ছিল শহুরে জীবনের ক্রাইসিস নিয়ে। ট্রিটমেন্ট ছিল তীক্ষ্ণ ও গতিশীল। আর টেলিভিশন ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের গল্প। আঙ্গিক ছিল মোলায়েম। ক্যানভাসের ওপর আলতো করে তুলি বোলানোর মতো তিনি ছবিতে ক্যামেরা বুলিয়েছেন। কিন্তু এই ছবি অনেক ম্যাচিউরড। ইনটেন্স প্রেমের ছবি, ইউরোপিয়ান আর্ট হাউস সিনেমার আঙ্গিকের খুব কাছাকাছি। ধীর স্থির, অচঞ্চল আর স্থিত। ট্রিটমেন্ট ইউরোপিয়ান কিন্তু কনটেন্ট পুরোদস্তুর বাঙালি। এই দুয়ের অদ্ভুত মিলমিশে তৈরি হয়েছে ডুব, যা নির্মাতা ফারুকীর আগের সব ছবি থেকে আলাদা। কলকাতার দর্শকের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা এই সিনেমা। ফেস্টিভ্যালের সিনেমা হিসেবেই এত দিন বাংলাদেশের সিনেমা দেখেছেন তারা। এবার উড়ুক ফারুকীর বিজয় নিশান। যারা চলচ্চিত্রের সিরিয়াস দর্শক, যারা মনে করেন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মনের কথা বলার স্বাধীনতা পরিচালকের থাকা উচিত, যারা মনে করেন সিনেমা মূলত দেশকাল ছাপিয়ে যায়, যারা মনে করেন সিনেমা মূলত অনুভবের বিষয়, তাদের জন্যই ডুব।