বসন্ত বাতাসে সইগো

সিডনির রাস্তায় জ্যাকারান্ডার সারি। ছবি: ইন্টারনেট
সিডনির রাস্তায় জ্যাকারান্ডার সারি। ছবি: ইন্টারনেট

ষড় ঋতুর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্রকৃতি থেকে চার ঋতুর দেশে এসে মনে একটা শঙ্কা কাজ করছিল, নতুন দেশের প্রকৃতি কেমন হবে? এমনকি দেশ ছাড়ার আগে এক বন্ধুকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। যিনি আগে থেকেই অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন, তুমি যেহেতু প্রকৃতিপ্রেমিক লোক, এই দেশ তোমার অবশ্যই ভালো লাগবে। আমি কারণ জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেছিলেন এখানকার প্রকৃতি অনেক বেশি সুন্দর।

সিডনিতে আসার কিছুদিন পর এক পাকিস্তানি বন্ধু কৌতুকের স্বরে বলেছিল, বন্ধু, তিনটা জিনিসকে তুমি কখনোই বিশ্বাস করবে না—যত দিন অস্ট্রেলিয়াতে থাকবে এখানকার মেয়েদের, এখানকার চাকরি আর এখানকার আবহাওয়া। আমি কারণ জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, এখানকার মেয়েরা মানিব্যাগের পেছনে ছোটে মানুষের পিছে না। আর কোম্পানির যত দিন কাজ আছে তোমায় জবে রাখবে কিন্তু কাজ যেই নাই হয়ে যাবে তৎক্ষণাৎ তোমায় ছাঁটাই করে দেবে। তৃতীয়টি হলো এখানকার আবহাওয়া খুবই অস্থায়ী। একই দিনে এখানে চার ঋতু দেখা দিতে পারে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত ও বসন্ত—যেগুলো আসলে অস্ট্রেলিয়ার মূল ঋতু বৈশিষ্ট্য। আমি কিছুদিনের মধ্যেই তার প্রমাণ পেয়ে গেলাম। প্রচণ্ড গরমের দিন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে জানি হিমেল বাতাস এসে হাজির হয়। দিনের মধ্যে এই বৃষ্টি হচ্ছে আবার এই কড়া রোদ।

জ্যাকারান্ডা ও কুড়াজং ফুলের গাছ। ছবি: ইন্টারনেট
জ্যাকারান্ডা ও কুড়াজং ফুলের গাছ। ছবি: ইন্টারনেট

কিন্তু এত কিছুর পরও বসন্তকালটা আমার চোখে আলাদাভাবে ধরা দিল। বাংলাদেশের বসন্তকালের মতোই এখানকার প্রকৃতিও বসন্তকালে বিভিন্ন রকমের ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়। এখানকার বসন্তকালের সবচেয়ে বড় স্বাক্ষর বহন করে ‘জ্যাকারান্ডা’ নামের একটা ফুল। বাংলাদেশের বসন্তকালের যেমন সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গাছে গাছে শিমুল ফুল, যেখানে কোনো পাতা থাকে না। হঠাৎ দেখলে মনে হয় কে যেন পুরো গাছটায় একসাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ঠিক তেমনি এখানকার জ্যাকারান্ডা গাছেও কোনো পাতা থাকে না। গাছভর্তি থাকে নীল ফুলে। আর প্রতিদিন সকালে গাছের নিচে দেখলে মনে হবে প্রকৃতি পরম মমতায় গাছের তলায় নীল গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। বসন্তকালে বাংলাদেশকে পাখির চোখে দেখলে যেমন মনে হয় কোনো একজন শিল্পী তার নিপুণ তুলির আঁচড়ে কিছু কিছু জায়গায় লাল রং লাগিয়ে দিয়েছেন। ঠিক তেমনি সিডনিকে দেখলে মনে হবে কেউ যেন নীল রং ছড়িয়ে রেখেছেন।

ডে-টিউলিপ ফুলের সারি
ডে-টিউলিপ ফুলের সারি

এর বাইরে এক ধরনের ফুল আছে যেটার নামটা একটু খটমট ধরনের। ব্রাছিছিটন এক্রেফলিয়াস। যেটার স্থানীয় নাম কুড়াজং। এই গাছটাতেও একেবারে পাতাহীন অবস্থায় বসন্তকালে ছোট ছোট লাল ফুল ধরে। এই গাছটাকে দেখলে সত্যিকার অর্থেই দুর থেকে শিমুলের কথা মনে পড়ে। কিন্তু কাছে গেলেই ভুল ভাঙে। কারণ এর ফুলগুলো অন্য রকমের আর আকারে বেশ ছোট। আর জ্যাকারান্ডা যেমন প্রায় রাস্তাঘাটে সব জায়গায় দেখতে পাওয়া যায় কুড়াজংকে অত বেশি দেখতে পাওয়া যায় না। ট্রেনে বাসে চলার পথে বেশ কয়বার দেখেছি এবং ইচ্ছে হয়েছে কাছে গিয়ে ছবি তুলে আনি কিন্তু বাস্তবে সেটা আর করা হয়ে ওঠেনি।

বাসাবাড়ির বাইরে কামিনী ফুলের শোভা
বাসাবাড়ির বাইরে কামিনী ফুলের শোভা

তবে এখানে উৎসব করে যে ফুলটা সবাই দেখতে যায় সেটা হচ্ছে টিউলিপ। এই ফুল এখনো সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কারণ এটা ঠান্ডার দেশের ফুল। তাই তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা আবহাওয়ার জায়গা ক্যানবেরাতে ভালো হয়। বসন্তকালের নভেম্বর মাসে এখানে সবাই উৎসব করে এই ফুলটা দেখতে যায়। যার জন্য আগের বছর থেকে টিকিট কেটে রাখতে দেখা যায়। সিডনির কান্ট্রি সাইড ওলোগঙেও ছোট আকারে টিউলিপ উৎসব পালন করা হয় যেটার খোঁজ পেয়েছিলাম উৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার পর। তাই আর দেখা হয়নি। অবশ্য ইতিমধ্যে এক ভাবির ফেসবুকে তাদের আঙিনার টিউলিপ ফুলের ছবি দেখে তাঁর বাসায় যাওয়ার বায়না ধরেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আর রাজি হননি। তাই আমি আমার মেয়ের সঙ্গে করা প্রতিজ্ঞাটাও আর রাখতে পারিনি। বলেছি একেবারে পরের বছর আমরা টিউলিপ ফুল দেখতে যাব।

লেখকের মেয়ের স্কুলের গাছে চেরি ব্লোজমের ছোঁয়া
লেখকের মেয়ের স্কুলের গাছে চেরি ব্লোজমের ছোঁয়া

টিউলিপ ফুল দেখতে যেতে না পারার দুঃখটা আমরা মেটালাম ডে টিউলিপ ফুল দেখে। মেয়ের স্কুলে যাওয়া আসার পথে মেয়ের মা এক প্রতিবেশীর বাড়িতে এই ফুলটা দেখে আমাকে বলল, একটু ধীরে ধীরে যেতে যাতে করে সে ফুলটা দেখাতে পারে। কিন্তু তবুও আমি সেবার দেখতে পারলাম না কারণ রাস্তার অন্য পাশের বাড়ির ভেতরের বেড়া বরাবর সেটা লাগানো। আমি আবার ঘুরে এসে ফুলগুলোকে দেখে খুবই মুগ্ধ হলাম। পরে একদিন ভোরবেলা গিয়ে ফুলগুলোর ছবি তুলে নিয়ে এলাম। এরপর আরও এক প্রতিবেশীর বাড়িতে এই ফুলটার অন্য আরেকটা রং দেখলাম সেটা আরও বেশি আকর্ষণীয় ছিল। এই ফুলগুলো খুবই কম সময়ের জন্য ফুটে থাকে, পরের সপ্তাহে গিয়ে দেখি বেশির ভাগই শুকিয়ে গেছে।
বসন্তকালের একেবারে শুরুর দিকে ফুটতে শুরু করে এক ধরনের ফুল। যেটাকে সামগ্রিকভাবে বলা হয় চেরি ব্লোজম। এই ফুলগুলো আকারে ছোট। গাছগুলোও তেমন একটা বড় হয় না। এই ফুলগুলোকে দেখলে বাংলাদেশে গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তরে ফুটে থাকা ভাট ফুলের কথা খুব মনে পড়ে। এই ফুলগুলোও একেবারে পাতাহীন অবস্থায় গাছে ধরে তাই হঠাৎ দেখলে গাছগুলোকে একেকটা বড় ফুলদানি বলে ভুল হয়। মেয়ের স্কুলে একটা চেরি গাছ দেখে ছবি তুলে ফেললাম। ভাগ্য ভালো হওয়াতে একটা মৌমাছিকেও পেয়ে গেলাম ছবির মধ্যে। মৌমাছি মধু আহরণে ব্যস্ত ছিল তখন।
তা ছাড়া বাংলাদেশের অতি পরিচিত ফুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা মিলে কামিনীর। এখানে প্রায় প্রত্যেকটা বাসাতেই কামিনী ফুল গাছ আছে। এমনকি অনেক স্টেশনের বাইরেও এই ফুল গাছটা দেখা যায়। আমি এই ফুল গাছের পাশ দিয়ে গেলেই চোখে না দেখলেও নাক ঠিকই টের পেয়ে যায় আশপাশে কোথাও কামিনী ফুটেছে। এ ছাড়া গন্ধরাজ দেখা যায় অনেক বাড়িতেই। অফিস থেকে ফেরার পথে অন্যের বাগান থেকে গন্ধরাজ চুরি করে নিয়ে আসি মেয়েটার জন্য। সে সেটা গ্লাসের পানিতে ভিজিয়ে রাখে ফুলদানির মতো করে। এভাবে বেশ কদিন যাওয়ার পর শুকিয়ে গেলে ফেলে দিয়ে আবার আমরা চুরি করে নিয়ে আসি। তা ছাড়া বাংলাদেশি ফুলের মধ্যে জবা, টাইম ফুল এগুলোও অনেক বাড়িতে আছে। এর বাইরে গোলাপ তো প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িতেই আছে। আরও আছে নাম না জানা রং বেরঙের অসংখ্য ভুলের গাছ। যেগুলো দেখলে বসন্তের আগমন এমনিতেই টের পাওয়া যায়।

লেখকের অফিসের মোড়ের গাছে আমের মুকুল
লেখকের অফিসের মোড়ের গাছে আমের মুকুল

তবে মনে মনে আমি খুঁজে বেড়াতাম বসন্তকালের বাংলাদেশের আমের মুকুল। খুব বেশি খুঁজতে হলো না। মূল সড়ক থেকে হাঁটাপথে আমার অফিসে আসতে যে তেমাথাটা পড়ে, সেই মোড়ের একেবারে কোনার বাসাটায় একটা আম গাছ আছে। সেখানে আমের মুকুল দেখে বাংলাদেশের বসন্তকালের আমের মুকুলের কথা মনে পড়ে যায়। অফিসে আসার পথে ওই মোড়টা পার হওয়ার সময়ই নাকে এসে লাগে আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধ। এরপর একে একে আমের মুকুল থেকে আম বড় হয়ে পাকা পর্যন্ত আমার সতর্ক দৃষ্টি থাকে। কারণ আম বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো চুরি করে নিয়ে আসি। তাছড়াও ঝড়ের সময়ে গাছের তলা থেকে আম কুড়িয়ে আনি আর মনে মনে জসীম উদ্দিনের মামার বাড়ি ছড়া আবৃত্তি করি।

ঠিক তার পাশের বাড়িতেই দেয়ালের মধ্যে দুটো আঙুরের গাছ আছে। আমি শুরুতে বুঝতে পারিনি যে এগুলো আঙুরের গাছ। কারণ এর আগে জীবনে কখনোই আঙুরের গাছ দেখিনি। তাতে এক সময় সবুজ আঙুর ধরল এবং সেটা পেকে কালো জামের বর্ণ নেওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম সেগুলো আঙুরের গাছ। পরের বছর তাই একেবারে সবুজ থাকা অবস্থাতেই আঙুর চুরি করলাম। সেটা মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোটবেলায় পড়া শেয়ালের গল্পের মর্মবাণী মনে পড়ে গেল—আঙুর ফল টক। কাচা আঙুর যে এতটা টক হতে পারে আমার ধারণাতেও ছিল না। অনেকটা বাংলাদেশের আমলকির কাছাকাছি টক স্বাদের। সেই কাচা আঙুর চুরির শেষ এরপর থেকে পাকা পর্যন্ত অপেক্ষা করে চুরি করি।


তবে যে জিনিসটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় সিডনিতে বসন্ত এসে গেছে, সেটা হলো কোকিলের ডাক। যখন কোকিলের ডাক শুনি তখন দেখা যায় হয়তো বা অফিসে বা কোনো যানবাহনে ভ্রমণ করছি। তাই আর ইচ্ছে থাকলেও ছোটবেলার মতো করে কোকিলের সঙ্গে সুর মেলাতে পারি না। কিন্তু এক ধরনের অকৃত্রিম ভালো লাগায় ভরে ওঠে মনটা। তবে বাসায় থাকা অবস্থায় যদি কোকিলের ডাক শুনি তাড়াতাড়ি বাসার বাইরে এসে খুঁজে দেখার চেষ্টা করি কোন গাছ থেকে কোকিলটা ডাকছে। আর সুর মিলিয়ে কোকিলের সঙ্গে ডেকে উঠি। ইদানীং আমার দেখাদেখি আমার মেয়েও এই কাজটা করা শুরু করেছে দেখে খুবই ভালো লাগে। এই বিদেশবিভুঁইয়ে বাংলাদেশের প্রকৃতির কিছুটা স্পর্শ দিতে পেরে খুবই ভালো লাগে মনে মনে।

লেখকের অফিসের মোড়ের গাছের কাচা আঙুর
লেখকের অফিসের মোড়ের গাছের কাচা আঙুর

এ ছাড়া আরেকটি জিনিস আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করে সেটা হচ্ছে বসন্তকালের উদাস বাতাস। এই বাতাস গায়ে মাখলে একজন চরম সাংসারিক মানুষও মুহূর্তের জন্য উদাস হতে বাধ্য। এই বাতাসের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে এটা না ঠান্ডা না গরম। গায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। শুধু এই বাতাসটা উপভোগ করার জন্য আমি রাতের একটা বড় সময় আগের বাসার সামনের পার্কের বেঞ্চে বসে কাটাতাম। আর এখনকার বাসার সামনে কোনো পার্ক না থাকায় মাঝরাতে কফি খাওয়ার অজুহাতে বাতাস খেতে বের হয়ে যাই। কফিশপে হেঁটে যেতে প্রায় মিনিট দশেক লাগে। এই সময়টুকুকে যতখানি পারি দীর্ঘ করার জন্য ধীরে ধীরে হাঁটি। তারপর কফি নিয়ে বসে যাই পাশের দোকানগুলোর সামনের গাটারে। কফি শেষ হলেও উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তবুও চরম অনিচ্ছা নিয়ে একসময় উঠে বাসার দিকে হাঁটা দিই। তখন মনের মধ্যে বেজে চলে একটা গানের সুর ‘বসন্ত বাতাসে সইগো বসন্ত বাতাসে, তোমার বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে সইগো আমার বাড়ি আসে।’

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।