আমার শব্দগুলো সব চোখের জলে ভেজা

লেখিকা
লেখিকা

আমার জন্ম অজপাড়া এক গ্রামে। যে গ্রামে বিদ্যুৎ ও পাকা রাস্তা ছিল না। সকালে আমার ঘুম ভাঙত পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে। দিন বাকি সময়ের দুপুর পর্যন্ত কাটত গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, কুকুর, বিড়াল, কবুতর ও প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটি করে। অলস বিকেল কাটত নীড়ে ফেরা পাখিদের গুণে গুণে। ক্লান্ত সাঁঝের বেলা ব্যস্ত সময় কাটাতাম আকাশ ভেঙে পড়া ঝি ঝি পোকাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে।

রাতের বেলায় হারিকেনের আলোয় বিজ্ঞান বই সামনে খুলে গলা ফাটিয়ে কিছু সময় বাংলা কবিতা পড়েই উঠোনে খোলা আকাশের নিচে বিছানা পেতে দাদার কোলে গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়তাম। আহা, কী মধুর ছিল সেসব দিনগুলি!
ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের রাস্তায় রিকশা বা মোটরসাইকেলের শব্দ শুনলেই ভয় পেতাম। দৌড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে আসতাম। মনে আছে একদিন সিএনজি দেখে ভয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। মৃত্যুকে তখন খুবই ভয় পেতাম। কেনইবা মরতে ইচ্ছে হবে! তখন তো আমার বাবা-মা ছিলেন।
গ্রামের মেয়ে হিসেবে হালচাষ, মাছধরা, ধান কাটা, গাছে ওঠা, নৌকা চালানো সব বিষয়েই পারদর্শী ছিলাম। গরু, ছাগল, মহিষ, সাপ, শিয়াল, কুকুর, বিড়াল কোনো কিছুতেই আমার ভয় না থাকলেও তিন চাকার রিকশা আর দুই চাকার মোটরসাইকেলকে খুবই ভয় পেতাম। তবে কোনো দিনই আমি উড়োজাহাজকে ভয় পেতাম না। মাথার ওপর দিয়ে যখনই প্লেন উড়ে যেত আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম আর আনমনা হয়ে ভাবতাম কীভাবে মানুষ নিয়ে প্লেন আকাশে উড়াল দেয়?
জীবনের এবেলায় এসে দুই চাকার সাইকেল, গাড়ি এগুলো এখন আমি নিজ হাতেই চালাই। শুধুই উড়োজাহাজ বা প্লেনকে ভীষণ ভয় পাই। এয়ারপোর্ট, প্লেন শব্দগুলো শুনলেই ভয়ে আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। মনে হয় এই প্লেন, এয়ারপোর্ট আমাকে দুই ভাগ করে দিয়ে আত্মাটা ফেলে আসে একপ্রান্তে আর প্রাণহীন দেহটা বয়ে নিয়ে যায় আরেক প্রান্তে। সেটা কেমন যন্ত্রণা শুধু ভুক্তভোগী জানেন।
আমার কাছে এখন ভয়াবহ রকমের দুটো ভয়ের জায়গার নাম হলো শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্ট। কারণ আমার বাবাকে আমি শেষ বিদায় দিয়েছি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আর মাকে শেষ বিদায় দিয়েছি জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে।

পলি শাহীনা: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।