প্রকৃতি বা মানুষের সঙ্গে বসবাস

প্রতীকী ছবি। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
প্রতীকী ছবি। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

টমাস আমার ওয়ার্ডে আছে মাস কয়েক ধরে। ছোটখাটো গড়নের টমাস বা টম ওয়ার্ডে আছে খুব শান্তশিষ্ট ছেলের মতো। ত্রিশ বছরের টমকে কোনো প্রশ্ন না করলে সে যেচে আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসবে না।

সারা দিন সে তার নিজের জগতে ব্যস্ত থাকে। টিভি রুমে বা ডাইনিং রুমে টমকে মাঝে মধ্যে দেখা গেলেও কদাচিৎ সে কারও সঙ্গে কথা বলবে। ওয়ার্ডে আসা দৈনিক পত্রিকাগুলো অবশ্য সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে এবং এ ব্যাপারটাই আমার চোখে পড়ে এ হাসপাতালে যোগদান করার পরে।
বছর তিনেক আগে টমের অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। অবশ্য এ জন্য টমের মাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। মা খেয়াল করেন টম তার টাকা পয়সা লোকজনকে দিয়ে দিচ্ছে। সে একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করছিল তখন। টম তখন একাই থাকে। কয়েক বছর কাজ করে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় দশ লাখ টাকা সে জমিয়ে রেখেছিল তার মায়ের কাছে।
তো একরাতে সে হঠাৎ করেই মায়ের বাসায় হাজির। হুট করে সে টাকাগুলো চেয়ে বসে।
একটু অবাক হন টমের মা। ব্যাপারটা আসলে কী। কী করবে সে এ টাকা দিয়ে? কোনো ব্যবসা? ঘর কিনবে? কাউকে ধার দেবে?
না, এর কোনোটাই নয়।
টম বলল, আমার টাকা পয়সার আর প্রয়োজন নেই। কারণ, আমার ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। এ টাকাকড়ি রেখে কী লাভ।
আসমান থেকে পড়েন টমের মা। বলে কী তার ছেলে? যে ছেলে কখনো কোনো মশা-মাছি মেরেছে কিনা সন্দেহ, তার হবে ফাঁসি? আর ইংল্যান্ডে তো ফাঁসির কোনো নিয়মই নেই। অবাক ব্যাপার।
টম খুব ঘামছিল। সে ধরেই নিয়েছিল তার ফাঁসি হচ্ছে। কেন হচ্ছে তার ফাঁসি? কারণ, খুব ছোটবেলায় সে তার এক স্কুল ফ্রেন্ডের গালে একটা চড় মেরেছিল। টম জানে সহপাঠীকে চড় মারা অন্যায়। যেহেতু সে এ অন্যায় কাজ করেছে এবং এ জন্য সে ক্ষমা চায়নি, তাই তার জন্য এ শাস্তি অবধারিত হয়ে আছে বলে মনে করে টম। আর এ ব্যাপারটা সম্প্রতি তার মাথায় এসেছে।
টম মনে করে তার কোনো ক্ষমা নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে তার সবটুকু সঞ্চয় তার স্কুল বন্ধুদের মাঝে বিলিয়ে দেবে। মা আরও অবাক হয়ে শোনেন, গত তিন মাসে বেতনের প্রায় সব টাকাই সে লোকজনকে বিলিয়ে দিয়েছে।
প্রথম ডাক্তার দেখানোর তিন মাস আগে কোনো এক রোববার রাতে সে নিশ্চিত হয় যে তার বিরুদ্ধে মামলা এখন আদালতে এবং কালকেই তার রায় হবে। সে রায়ে তার ফাঁসি নিশ্চিত। সে জন্যই সে পাগলের মতো হয়ে মায়ের কাছে এসেছে।
কপাল ভালো যে, টমের মা তাকে ওই রাতেই হাসপাতালে নিয়ে যান। তারপর অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে সে এই সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালে আছে কয়েক মাস ধরে। দুর্ভাগ্যক্রমে টমকে পুরো সুস্থ করা সম্ভব হয়নি বাসায় রেখে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হয়েছে। কোর্টের মামলা নিয়ে সে অস্থির সময় কাটাচ্ছিল।
কীভাবে টম এ খবর পেল যে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং সে মামলা তখন চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায়? এর উত্তর টমের মা জানেন না। জানার কথাও নয়।
দেখি, টম কী বলে এ ব্যাপারটা নিয়ে।
‘তখন স্প্রিং বা বসন্ত কাল চলছে। পাতা ঝরার দিন।’ টম কথা বলে আমার সঙ্গে।
টমের প্রকৃতি প্রেম দেখে ভালো লাগে।
‘আমার অভ্যাস হলো খুব সকালে উঠে একটু হাঁটাহাঁটি করা। পাশের গলফ কোর্টেই হাঁটতাম সাধারণত। একদিন হাঁটছি। মনে হলো পাখিরা আমার সঙ্গে কথা বলছে। একটু অবাক হলাম আমার এ ক্ষমতা দেখে। কোনো সমস্যা হচ্ছে না ওদের ভাষা বুঝতে। ওরা ব্রিটিশ ওয়েদার নিয়ে কথা বলছিল। আমাকে বলল, কেমন আছ টম? এত সকালে হাঁটাহাঁটি করছ, ফ্লু হয়ে যেতে পারে। তাড়াতাড়ি বাসায় যাও। একটু পরেই বরফ পড়বে।’
টমের তো বিস্ময়ের শেষ নেই। কিছুক্ষণের ভেতরেই সে বরফ পড়ার লক্ষণ দেখতে পেল।
‘আমি পরিষ্কার করেই পাখিদের ভাষা বুঝতে পারলাম। একটু ভয় পেয়েই বাড়িতে হাঁটা শুরু করলাম। দৌড়াতে গিয়ে ঘাস আর বসন্তের ঝরাপাতা মাড়াচ্ছিলাম। আমার জন্য দ্বিতীয় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। রাস্তায় পড়ে থাকা পাতা বলে উঠল, টম আস্তে যাও। আমার শরীর ভেঙে চুরমার করে দিলে। কষ্ট দিলে আমাকে।’
এইভাবে পাখি আর পাতার সঙ্গে কথা হলো কয়েক দিন। কাউকে সে বলতেও পারছিল না তার এ অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা।
গাড়ি করে অফিসে যাচ্ছিল টম। এবার গাছই ডাক দিল তাকে। বলল আজ ডেইলি মিরর (Daily Mirror) পড়বে। ওখানে তোমার জন্য সংবাদ আছে। খবর তুমি সরাসরি পাবে না। একটু ঘুরিয়ে খবরটা দেওয়া হয়েছে। ১৩ নম্বর পাতায় একটি পুলিশ বিজ্ঞপ্তি আছে। ওরা টমাস নামক কাউকে খুঁজছে। তুমি কি জানো এ টমাস কে? এ হচ্ছে তুমি? মনে আছে তোমার ডোনাকে স্কুলে চড় দেওয়ার কথা? তোমাকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে।
অবাক ব্যাপার হলো ডেইলি মিররের ১৩ পৃষ্ঠায় ঠিকই অনেক বিজ্ঞপ্তি দেখতে পায় টম। কোনোটাই অবশ্য সরাসরি তার নাম উল্লেখ করেনি। কিন্তু সে ধরেই নেয় যে ইঙ্গিতটা তার দিকেই। তার ‘অপরাধের’ দিকে। তারপরেই শুরু টমের অস্থিরতা। গাছ, পাতা আর পাখিরা কথা বলতেই থাকে। পুরোপুরি বিশ্বাস জন্মে তার পুরো ঘটনায়। সে অপরাধী। তার অপরাধ সে ছোটবেলায় তার এক বন্ধুকে চড় মেরেছে। কিন্তু সে অপরাধের কারণে ফাঁসি? তাও আবার ইংল্যান্ডে? এতদিন পরে? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই টমের কাছে।
বসন্তের ঝরা পাতাই তাকে খবর দেয় একদিন। কাল তোমার রায় হবে আদালতে। কিন্তু তুমি তো এখন ৩০০ মাইল দূরে। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। কাল সকাল থেকেই তোমাকে এ ক্ষমতা দেওয়া হবে যে তুমি এখানে থেকেও আদালতে উপস্থিত হতে পারবে। তবে একটা শর্ত আছে এবং সে শর্ত হচ্ছে তুমি তোমার মায়ের কাছে রাখা সব টাকা বন্ধুদের বিলিয়ে দেবে। আমরা অবশ্য খুশি যে তুমি ইতিমধ্যে দান দক্ষিণা শুরু করে দিয়েছ।
টমের মতে সে পরদিন ঠিকই হাজির হয় লন্ডনের সে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। তার বক্তব্য হলো, সে একই সঙ্গে সেদিন ৩০০ মাইল দূরে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে ছিল। অফিসের রিসেপশনে রাখা ফায়ার রেজিস্টারের তথ্য মতে সে সেদিন কোর্টে নয় বরং তার অফিসেই ছিল। সেদিন তার ‘মামলার’ শুনানি হয়নি। অদ্ভুত ক্ষমতার বলে সে একই সঙ্গে দুই স্থানে একই সময়ে অবস্থান করছিল? কীভাবে এটা সম্ভব? টমের কাছে এর ব্যাখ্যা নেই। তার মতে এরপরে আরও কয়েকবার তার শুনানি পিছিয়েছে। শুনানি পেছালেও টম লোকজনকে টাকা বিলি করতে পিছিয়ে থাকেনি। বেতনের প্রায় পুরো টাকাটাই সে দিয়ে দেয় লোকজনকে। তিন শ মাইল দূরে থেকেও লন্ডনের কোর্ট থেকে সে জুরি ও উকিলের কাছ থেকে ‘লাইভ’ আপডেট পেয়েছে অসংখ্যবার। কয়েক শ মাইল দূরে নিজের অফিসে থেকেও লন্ডনের কোর্টে সে ‘উপস্থিত’ থেকে শুনানিতে অংশ নিয়েছে বেশ কয়বার। টমের বক্তব্য ‘এটা তার জন্য কোনো ব্যাপার নয়।’
শুরু হলো টমের দুই জীবন। একই সময়ে দুই স্থানে অবস্থান করার অদ্ভুত ক্ষমতা টমের জীবনকে প্রভাবিত করে প্রচুর। স্বাভাবিক জীবন থেকে ধীরে ধীরে সে সরে আসতে থাকে। একাকিত্ব ও নির্জনতাই হয়ে উঠে তার যাপিত জীবনের প্রধান অংশ।

দুই.
কথা বলি টমের সঙ্গে। এ হাসপাতালে তার জীবনযাত্রা নিয়ে। কেমন লাগছে তার এখানকার জীবন? কেনইবা সে একাকী থাকে এ ওয়ার্ডে?
—তুমি একা একা থাকো সব সময়। কারও সঙ্গে তেমন একটা কথাও বল না।
—কারণ দিনে আমি কয়েকবার ওয়ার্ডে থাকি না।
—আমার জানামতে তোমার হাসপাতালের বাইরে যাওয়ার কথা নয়। এর অনুমতি নেই। আর ওয়ার্ডের দরজা যখন সব সময় বন্ধই থাকে, তুমি সব সময় ওয়ার্ডে থাক না, এর মানে বুঝতে পারছি না। (এখানে বলে রাখা ভালো সাইকিয়াট্রি ওয়ার্ডে যারা Section-এর মাধ্যমে ভর্তি থাকে তাদের বাইরে যাওয়ার অনুমতি থাকে না বললেই চলে)।
টম বলতে থাকে।
—এই ধরো আজ সারা সকালই আমি বাইরে ছিলাম।
—কি বলছ তুমি? আমিতো সেই সকাল ৯টা থেকে তোমাকে পত্রিকা পড়তে দেখছি।
—ভুল বললে ডাক্তার। তুমি আমাকে এখানে ঠিকই দেখেছ কিন্তু আমি তো ছিলাম লন্ডনে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। আজ আমার শুনানি ছিল। আমি ছিলাম। ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রমহিলা খুব ভালো ছিলেন। আমাকে আগামীকাল আবার যেতে বলেছেন।
—শোন টম। যে শহরে এ হাসপাতাল তা থেকে লন্ডন শহর ২০০ মাইল দূরে। তুমি কীভাবেই বা গেলে বা কীভাবেই বা আসলে এই সকালে যখন তোমাকে আমি পত্রিকা নিয়ে সারা সকাল বসে থাকতে দেখলাম আমি নিজেই।
—এটা আমার বিশেষ এক ক্ষমতা। এ ক্ষমতার কারণে আমি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে মুহূর্তের মধ্যেই চলে যেতে পারি। এই ধরো গত রাতে আমি ছিলাম নিউইয়র্কে। দিনে ছিলাম হেগে। তবে যেখানেই আমি যাই না কেন কোর্টের শুনানি যখন চলে, আমাকে লন্ডনে যেতে হয় এবং আমি ওখানে যাই।
—কিন্তু আমার কাছে রিপোর্ট আছে যে ভর্তির পরে গত কয়েক মাস ধরে তুমি বাইরে কখনো যাওনি বা যাওয়ার অনুমতি ছিল না।
—কিন্তু আমি যে বললাম আমি দুই স্থানে একই সঙ্গে অবস্থান করতে পারি।
—তাই?
—এই ধরো আমি এ মুহূর্তে লন্ডনে আবার। আমি এখন জুরিদের সঙ্গে কথা বলছি। আমার সলিসিটার (উকিল) আমাকে ব্রিফ করছে। আমি এখন নিউ বেইলি কোর্টে আছি। আমার শুনানিটা আবার পিছিয়ে গেল। তবে আমার উকিল বলছে আমার ফাঁসি প্রায় নিশ্চিত। ওরা কিছু করতে পারবে না বলে মনে হচ্ছে।
বলেই টম কেঁদে ফেলে। আমি টিস্যু পেপার এগিয়ে দিই।
টম যখন কথা বলছে আমার সঙ্গে তখন প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে।
কথা বলি টমের গাছ, পাতা আর পাখির সঙ্গে কথা বলা নিয়ে।
—এখনো তুমি গাছের সঙ্গে কথা বলো? পাতার সঙ্গে? পাখির সঙ্গে?
—আগের মতো নয়। তবে দু-একদিন পর পরই।
—পরিষ্কার শুনতে পাও এদের কথা বার্তা?
—একদম পরিষ্কার। ওরা ইংরেজিতে কথা বলে আমার সঙ্গে। শীতের সময় ওরা খুব কষ্টে থাকে। বৃষ্টি নেই, পানিও নেই।
—আর পাখিদের কথা?
—ওরা মূলত গান শোনায় আমাকে। মাঝে মধ্যে কথা বলে রাজনীতি অর্থনীতি নিয়ে। ওদের ছেলেবেলার গল্প শোনায় আমাকে।
ওয়ার্ডে টমের সময় কাটে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে বেড়িয়ে বেড়িয়ে। শারীরিকভাবে সে আমার হাসপাতালে আছে। কিন্তু একই সঙ্গে সে লন্ডন, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় ভ্রমণ করছে কোনো সমস্যা ছাড়াই। সবখানেই সে যাচ্ছে এটা জানার জন্য যে, কেন তার মামলার শুনানি এত লম্বা হচ্ছে। কেন সে রায় পাচ্ছে না এত দিন। ওয়ার্ডে অন্যের সঙ্গে তার কথা বলার সময় নেই। কারণ সে থাকে তখন অন্য জগতে অধিকাংশ সময়ে।
কেন তার ফাঁসি হবে? এর কোনো উত্তর নেই টমের কাছে। তবে সে এ ব্যাপারে ১০০ ভাগ নিশ্চিত। তাই সে তার যাবতীয় টাকা কড়ি বন্ধুদের দিয়ে দেওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।

লেখক
লেখক


তিন.
এক রাতে হাসপাতাল থেকে আসতে আমার দেরি হয়ে যায়। আমার ওয়ার্ডের রোগীরা সাধারণত রাত দশটার আগেই বিছানায় চলে যায়। হঠাৎ করে টিভি রুম খোলা দেখে একটু উঁকি দিই। নার্স রুমে নার্সরা বসে আছেন। টিভি বন্ধ। টম কারও সঙ্গে কথা বলছে। আমি এগিয়ে যাই।
—টম।
কোনো জবাব নেই। আবার ডাকি টম, তুমি কি শুনছ? শরীরে মৃদু ধাক্কা দিয়েও কোনো লাভ হলো না। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কোনো জবাব নেই। কিন্তু সে কথা বলতে থাকে নিজের সঙ্গে।
—আমার এ জীবন আর ভালো লাগে না। আপনারা আমার রায় দিয়ে দিন। আমিতো বলেছি আমি অপরাধী। কেন এত সময় নিচ্ছেন আপনারা?...আমিতো আপনাকে বলেছি আমার আর শুনানির প্রয়োজন নেই। আমি দোষী। প্লিজ আমাকে শাস্তি দিয়ে দিন।
আমি অবাক হই। টম আমার কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না।
নার্সদের ডাকি। ওরাও ডাকাডাকি করে। কোনো জবাব নেই।
মিনিট দশেক পরে টমের হুশ ফিরে আসে।
—সরি, ডাক্তার।
—এতক্ষণ আমরা তোমাকে ডাকাডাকি করছি, তুমি জবাব দিচ্ছ না কেন?
—আমি এতক্ষণ কোর্টে ছিলাম। জুরিদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। এইমাত্র হাসপাতালে এলাম আবার। সরি আমার উকিল আমার সঙ্গে কথা বলবে এখন…।
বলেই টম অন্যমনস্ক হয়ে যায় আবার।
—আমার আর বলার কিছু নেই। আমি অনেকবার বলেছি আমি দোষী। আর কি জিজ্ঞেস করবেন আপনি?
টম আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আমাদের কাছ থেকে। সে এবার ২০০ মাইল দূরে লন্ডনের বিখ্যাত ওল্ড বেইলি কোর্টে।
নার্সরা বললেন ইদানীং প্রতি রাতেই টম ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা একা কথা বলে। প্রতি রাতেই সে কয়েক ঘণ্টা তার উকিল আর জুরিদের সঙ্গে তর্ক বিতর্ক করে। এ সময় তার সঙ্গে কোনো কথা বলা যায় না।
টমকে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। কখন যে কী করে বসে!
নার্স রুমে চলে আসি। চা-কফি খাচ্ছিল ওরা। এক কাপ এগিয়ে দেয় আমাকে। আমি বিনয়ের সঙ্গে না বলি। রাতে আমি কফি বা চা খাই না।
—সাবধানে গাড়ি চালাবে আজ রাতে। বাইরে বরফ পড়ছে। এটা ডিসেম্বর মাস। ওদের চা খাবার মাঝেই আমি আলাপ করি টমের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে।
হাসপাতাল থেকে বাইরে আসার জন্য করিডরে আসি। টম দাঁড়িয়ে আছে।
—তোমার কি আমার জন্য একটু সময় হবে?
—নিশ্চয়ই।
—আমার উকিল তোমার সঙ্গে একটু কথা বলবে। Mr Lumb would like to have a word with you.
Mr Lumb হচ্ছেন টমের কাল্পনিক আইনজীবী। একটু অবাক হই।
—তোমার উকিল এখন কোথায়?
—এই যে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে?
—কোথায়? আমি তো তাকে দেখতে পাচ্ছি না।
—তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আমার উকিল।
আমি সামনে তাকাই। করিডরে কেউ নেই। সুনসান নীরবতা। রোগীরা সবাই যার যার রুমে। টম ধীর পায়ে ওর রুমের দিকে হাঁটতে থাকে।
নার্স রুমে ফিরে আসি। এবার আমার এক কাপ কফি দরকার। আমি আসলে ঘামছি। বাড়ি ফেরার পথে টম আমাকে কিছুটা ভয়ই ধরিয়ে দিল। ওর উকিল, তাও কাল্পনিক, আমার সঙ্গে কথা বলবে? কথা বলতে এই রাতে সে হাসপাতালে চলে এসেছে? টম সব সময় তার কাল্পনিক উকিলের সঙ্গে কথা বলে সেটি ব্যাপার নয়। ব্যাপার হচ্ছে সে এখন উকিলকে হাসপাতালে দেখতে পাচ্ছে এবং উকিল সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন, এ আমাকে ভাবিয়ে তুলছে।
নার্সরা একটু অবাকই হন আমার ফিরে আসা দেখে। মুখে ঘামের চিহ্ন লুকানো সম্ভব হয় না।
ডোনা বলল, তোমাকে ভালো মনে হচ্ছে না ডা. জাহান। তুমি কি ঠিক আছ? (Something is not quite right, Dr Jahan. You look unwell. Are you alright?)
সাহস দেখাই।
না, সবকিছু ঠিকই আছে। মনে হলো কফিটা খেয়েই যাই। বাই দ্য ওয়ে, টমের ব্যাপারে তোমাদের কাছে আর কিছু তথ্য আছে।
—কি ধরনের তথ্য চাইছ তুমি?
—না, মানে, ওষুধ কাজ করছে না কেন, একটু আগে টিভি রুমে ওর আচরণ, এখন আবার visual hallucination হচ্ছে, visual hallucination-এর চরিত্র আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে, এসব নিয়ে ভাবছি।
—ওর উকিল তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে?
একটু আগে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা খুলে বললাম। ওরাও অবাক হয়। টমের কিছু ব্যাপার ওদেরকেও ভাবিয়ে তুলছে।
কফি এগিয়ে দেয় ডোনা।
টমকে নিয়ে বেশ সমস্যার মধ্যে আছি। ওষুধ দেওয়া সত্ত্বেও ওকে সুস্থ করে তোলা যাচ্ছে না। ওর অদ্ভুত সব ব্যাপার রীতিমতো আমাদের চিন্তার কারণ।
ব্রেন স্ক্যানের সিদ্ধান্ত নেই। টমের একটি এমআরআই ব্রেন স্ক্যান করা খুব প্রয়োজন। অনেক সময় ব্রেনের Temporal Lobe-এ টিউমার থাকলে রোগীর সিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ নিয়ে আসতে পারে। ওষুধ কাজ দেয় না। টমের ব্যাপারে কী তাই হচ্ছে? এসব ভাবতে ভাবতেই বরফের রাতে গাড়ি ড্রাইভ করে বাসায় রওনা দিই। গাড়ি চলাচ্ছি ঠিকই কিন্তু মাথায় ভর করে আছে টম।

চার.
পরদিন টমকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানাতে যাই। ডেইলি মিরর পত্রিকা পড়ছে সে মন দিয়ে।
—কী খবর টম, তোমার কোর্টের শুনানির কি হলো? রায় কি পেয়ে গেলে?
—আজ বিকেলে কোর্ট বসবে আবার। সকালে মেগপাই (এক ধরনের পাখি) এসে বলে গেল।
—তাই? আর কিছু বলল?
—আর হ্যাঁ, তুমি যে এমআরআই ব্রেন স্ক্যান করাতে চাইছ তাতে আমার আপত্তি নেই। আবার আমি ধাক্কা খেলাম। টম কীভাবে জানল আমি তার ব্রেন স্ক্যানের কথা ভাবছি? এটাতো শুধু আমার জানার কথা! জগতের অনেক কিছুর ব্যাখ্যা নেই। টমের রোগের কিছু উপসর্গের সঙ্গে পরিচিত হলেও কিছু ব্যাপারের ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে।
টমের ব্রেন স্ক্যান রিপোর্ট নরমাল এসেছে। এখনো সে ওষুধের ওপরেই আছে। অনেক ভালো এখন। কোর্টে যাওয়া বন্ধ হয়েছে। তবে পাখি আর গাছগাছালির সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হয়নি এখনো। হয়তো ওটাও একসময় বন্ধ হবে। তবে ওর কিছু ব্যাপার যেমন কিছু অগ্রিম জেনে যাওয়ার ক্ষমতা বইয়ের পাতার সঙ্গে ঠিক মেলে না।
উপসংহার: টম Schizophrenia রোগে আক্রান্ত। ও bizarre delusion, visual and auditory hallucination এ ভুগছে। আমরা চেষ্টা করছি তাকে পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার।

*এ কাহিনি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। পেশেন্ট কনফিডেনশিয়াল ইস্যু থাকায় স্থান, কাল ও পাত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে।

ডা. আলী জাহান: ইংল্যান্ডে কর্মরত সাইকিয়াট্রিস্ট। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: