ভুল স্বীকারে অবমাননা হয় না বরং উচ্চতা বাড়ে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সবার জানা একটি গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র একবার গোপাল ভাঁড়কে জব্দ করতে গিয়ে বললেন, ‘শোনো গোপাল, এই যে আমি মাটিতে একটি রেখা টেনে দিলাম। এবার তুমি যদি এটিকে না কেটে বা স্পর্শ করে ছোট করতে পার, তবে তুমি পুরস্কৃত হবে। আর না হলে তোমার নির্বুদ্ধিতা প্রতিষ্ঠা পাবে।’

গোপাল তাৎক্ষণিক সেখানে ওই রেখার পাশে অন্য একটা বড় রেখা একে দিয়ে বললেন, ‘নিন মহারাজ আমার রেখার তুলনায় আপনার রেখা ছোট হয়ে গেল।’
গোপালের এই অনন্যসাধারণ বুদ্ধিমত্তা থেকে কি কিছু বার্তা পাওয়া যায়? দয়া করে একটু ভাবুন সবাই, আমি অন্য প্রসঙ্গে যাই।

আমাদের সমাজে একটি বাস্তবতা আছে। আমরা আমাদের নিজেদের চিন্তার বাইরে বা পরিসরের বাইরে চিন্তা করা অনেক ক্ষেত্রে অন্যায়, অন্যায্য ও অনুচিত বলে মনে করি। আমরা ভুলে যাই, আমরা যে দেশে বা পরিবারে জন্মেছি সেটি কোনোভাবেই আমাদের নিজেদের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। এটি একটি ঐশ্বরিক ব্যাপার। হয়তো আমরা যাদের ঘৃণা করি, যাদের পছন্দ করি না, যে সমাজে মেশাটাকে অবমাননাকর মনে করি, সেখানে না জন্মানোটা তাদের প্রতি আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। ভেবে দেখুন তো, আপনি যদি অন্য দেশে, অন্য সমাজে বা অন্য পরিবারে জন্মাতেন তবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি তাদের মতো হতো কিনা। নাকি আপনি সেখানে থেকেও বর্তমানে যেমন চিন্তা করছেন তেমন চিন্তা করতে পারতেন?
রাস্তার যে ভিক্ষুককে আমরা ভিক্ষা দিই বা করুণা দেখাই, কখনো কি আমরা চিন্তা করে দেখি এ রকম একটি পরিবারে আমারও জন্ম হতে পারত। কিংবা সে আমার জায়গায় আর তার জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম! রিকশাওয়ালার গায়ে হাত তোলার সময় কি ভাবি, সেও আমার স্বজন হতে পারত? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উত্তর হচ্ছে—‘না’। আমাদের আচার-আচরণ বা অনুশীলনে এই সংবেদনশীলতা তৈরি করার ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। আমরা জন্মসূত্রে চরম মাত্রায় বর্ণবাদী (এই বর্ণবাদ শুধু গায়ের রঙে নয়, সত্যিকারের মানসিকতাতেও)।

আমার পিএইচডির সহপাঠী ফিলিপাইনের ডি ল্যা স্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে আমি বলছিলাম, আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মা-বাবারা তাদের নিজেদের সন্তানদের বিয়ের পাত্র বা পাত্রী তারা নিজেরা খুঁজে দেন। তিনি খুব আশ্চর্য হলেন এবং বললেন, মা-বাবারা কীসের ভিত্তিতে তাদের সন্তানদের জীবনসঙ্গী খুঁজে বের করেন? আমি খুব হালকাভাবে উত্তর দিলাম—সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন তাদের নিজেদের সঙ্গে অন্য পরিবার বা বংশের সামঞ্জস্য, এর সঙ্গে শিক্ষা ও অন্যান্য বিষয় (দৈহিক গড়নের বিষয়টি ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেলাম)। আমি খুব স্বাভাবিকভাবে বলছিলাম। হঠাৎ তাঁর মন্তব্যে নড়েচড়ে বসলাম। ‘ব্রো, ইউ আর সো রেসিস্ট!’ কী সরল সত্যি কথা। অথচ আমাদের কাছে এটিকে বর্ণবাদ বলে কখনো মনে হয়নি বরং যৌক্তিক মনে হয়েছে।

লেখক
লেখক

এই ঘটনা এখানে বলার কারণ হচ্ছে, আমরা একটি বিষয়কে যেভাবে প্রতিনিয়ত দেখি সেটিকেই স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেই। কিন্তু আমার জন্ম অন্য জায়গায় হলে, বেড়ে ওঠা ভিন্ন পরিবেশে হলে ব্যাপারটিকে আমি হয়তো ভিন্ন চোখে দেখতাম। ভিন্নতাকে উপলব্ধি করা ও গুরুত্ব দেওয়া তাই অত্যন্ত জরুরি। তবে নিজস্ব গণ্ডিতে থেকে ভিন্ন চিন্তা করা কিন্তু মোটেও কোনো সহজ কাজ নয়। অ্যারিস্টটল, প্লেটো ও অন্যান্য দার্শনিকেরা এমন ভিন্ন চিন্তা করতে পারতেন বলেই সবাই তাদের মনে রেখেছেন। এ জন্যই তাদের চিন্তা দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়েছে।

ভিন্নতার প্রসঙ্গ আলোচনায় আনার কারণ হলো, কখনো কখনো ভিন্নতার মধ্যে অনেক সুন্দর ব্যাপার থাকে। সেগুলোর অনেক কিছুই আমরা আমাদের সংস্কৃতিতে পরিমার্জিতরূপে গ্রহণ করতে পারি। যেমন বিভিন্ন দেশে নিজের অজান্তে কিংবা অবহেলার কারণে কোনো ছোট ত্রুটি বা অন্যায় হয়ে গেলে তার জন্য ভুল স্বীকার করা বা দুঃখিত বলা খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার হলেও, আমাদের দেশে নিজে ভুল করে সেটি স্বীকার করাটাকে খুব ছোট করে দেখা হয়। এটিকে ব্যক্তিত্বের চরম অবমাননা হিসেবে গণ্য করা হয়। দুঃখিত বলা, কিংবা নিজ ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়াটাকে এখানে অন্যের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার কারণ হিসেবে দেখা হয়।

রাজনৈতিক উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবার একই দৃষ্টিভঙ্গি। এর কারণ হয়তো এমন যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ সেগুলোকে সগর্বে প্রচার করে বেড়ায় এবং এর জন্য তাকে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়। দেশে অনেককে কখনো এমনও বলতে শোনা যায় যে, ‘শেষ পর্যন্ত সে তো আমার কাছে মাফ চেয়ে গিয়েছে, কিংবা শেষ পর্যন্ত তো সে নাকে খত দিয়ে গেল।’ অথচ এমন কথা কিন্তু বলা উচিত ছিল না। প্রকৃত সত্য হলো, ভুল করে মাফ চাইতে বুকে সাহস থাকতে হয়। সবার সেটা নেই। ভুল করে শুদ্ধ বলে চালিয়ে দেওয়াটাই বরং হীনমন্যতা ও কাপুরুষতা। সত্যকে জেনে বুঝে গ্রহণ না করাটাই বরং মূর্খতা।

প্রথম গল্পের প্রসঙ্গে ফেরার আগে আরেকটি ঘটনা বর্ণনা করা যাক। আমাদের সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত অধ্যাপক ভাষা শিক্ষা কোর্সে একটি কবিতা পড়ে তার মূল উপজীব্য বোঝাচ্ছিলেন। এটি ছিল একটি ‘থাংশি’ অর্থাৎ থাং রাজবংশের (৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ) সময়কালে রচিত কবিতা। কবিতার কয়েক চরণের ইংরেজি অনুবাদটি এমন:

The hilltop kissing the setting-sun,
The Yellow River flows to the ocean.
Stepping up a still higher building,
You may enjoy the far sightseeing.

চৈনিক মূল কবিতাটির প্রথম দুই চরণে রয়েছে দৃশ্যপটের বর্ণনা এবং পরের দুই চরণে রয়েছে জীবনদর্শন। এর মোটামুটি একটি অর্থ হচ্ছে-অস্তগামী সূর্য পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়তে চলেছে, পীত সাগর সমুদ্রের বুকে গিয়ে মিশেছে, তখন যদি তুমি আরও উঁচু স্থানে উঠতে পারো, তবে তুমি তখনো সেখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাবে, সঙ্গে আরও বেশিক্ষণ দেখবে সূর্যটাকেও। অর্থাৎ, তোমার দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র তখনই প্রসারিত হবে, যখন তুমি তোমার নিজের স্থানকে উচ্চে নিয়ে যেতে পারবে; তোমার সীমিত গণ্ডি ছেড়ে ওপরে উঠতে পারবে। যখন অন্যদের কাছে সূর্য অস্তমিত হয়ে যাবে, তখনো তুমি সেটির আলো উপভোগ করতে পারবে।

যা হোক, অন্যকে ছোট না করে নিজের অবস্থান ওপরে নিয়ে গিয়েই প্রকৃত অর্থে বড় হতে হয়। এটিই কাঙ্ক্ষিত। ওপরের গল্পে গোপাল এটিই করেছিলেন। নিজের ভুল স্বীকার করলে ব্যক্তিত্বের অবমাননা হয় না বরং তার উচ্চতা বাড়ে। এই বোধ জাগ্রত হওয়াটা জরুরি। আর নিজের উচ্চতা বাড়লে অন্যকে ছোট না করেও নিজে বড় হওয়া যায়-এই উপলব্ধিটা অন্তত আমাদের হওয়া দরকার।

মো. বশীর উদ্দীন খান: পিএইচডি গবেষক, সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয়, সাংহাই, চীন ও সহকারী অধ্যাপক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।