ব্রিসবেনে পঞ্চনারী আখ্যান

পঞ্চনারী আখ্যান নাটকের একটি দৃশ্যে রোজী সিদ্দিকী
পঞ্চনারী আখ্যান নাটকের একটি দৃশ্যে রোজী সিদ্দিকী

নাটকটি সম্পর্কে প্রথম জেনেছি প্রায় বছরখানেক আগে | খ্যাতিমান শিল্পী দম্পতি শহীদুজ্জামান সেলিম ও রোজী সিদ্দিকীর সঙ্গে এক ঘরোয়া আড্ডায়। সেলিম ভাই বলেছিলেন এটি তাঁর নির্দেশিত ও রোজী আপার একক অভিনীত নাটক। আমাদের বেড়ে ওঠা কালের সমান্তরালে যে কয়জন গুণী অভিনয় শিল্পীকে ভালো লাগত তাঁদের মধ্যে শহীদুজ্জামান সেলিম ও রোজী সিদ্দিকী অন্যতম। আর সে কারণেই নাটকটি দেখার প্রতি মনের গহিনে একটি চাপা টান ছিল। সুযোগ খুঁজছিলাম কীভাবে নাটকটি সরাসরি দেখা যায় | ইতিমধ্যে সিডনি ও মেলবোর্নেও নাটকটির প্রদর্শনী হয়েছে। দুবারই বিশেষ কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অবশেষে সেই প্রতীক্ষার অবসান হলো। গত শুক্রবার ব্রিসবেনেও নাটকটির একটি বিশেষ প্রদর্শনী হয়ে গেল। ব্রিসবেন বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুল সেন্টেনারি স্টেট হাইস্কুলে নাটকটির ৫২তম প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। এখানে বলে রাখা ভালো, ব্রিসবেনে বাংলাদেশি কমিউনিটির বয়স কম করে হলেও ২০ বছরের বেশি হবে। এই ২০ বছরের ইতিহাসে এটিই কোনো বাংলাদেশি মঞ্চ নাটকের ব্রিসবেনে প্রথম মঞ্চায়ন।

বলছিলাম ঢাকা থিয়েটারের পঞ্চনারী আখ্যান নাটকটির কথা। হারুন রশিদের রচনা ও শহীদুজ্জামান সেলিমের নির্দেশনায় এ নাটকে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে পাঁচ নারীর আখ্যান নির্ঝরের মতো বলেছেন রোজী সিদ্দিকী। একজন অতি সামান্য দর্শক হিসেবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছিলাম তাঁর অভিনয় আর শুনছিলাম পাঁচ নারীর কথা। এত উজ্জীবিত অভিনয়ের মুনশিয়ানা এর আগে আমি খুব কম দেখেছি। হল ভর্তি দর্শকদের পিনপতন নীরবতা। অনেকের চোখের কোণে পানির ঝিলিক। মনে হয়েছে রোজী সিদ্দিকী এই চরিত্রগুলোকে বাস্তবের চেয়েও বেশি বাস্তব করে হলের প্রতিটি দর্শকের চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

পঞ্চনারী আখ্যান নাটকের একটি দৃশ্যে রোজী সিদ্দিকী
পঞ্চনারী আখ্যান নাটকের একটি দৃশ্যে রোজী সিদ্দিকী

মাহি মোরশেদের উদ্বোধনী বক্তব্যের পরপরেই ব্রিসবেন বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুলের শিক্ষার্থীরা কয়েকটি নাচ, গান আর নাটিকার সমন্বয়ে একটি ছোট পর্ব পরিবেশন করে। এই পর্বে উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরপুরুষ কবিতাটিকে নাটিকা আকারে পরিবেশন করা। বিদেশের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা একদল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যখন এমন একটি কাজ করার সাহস দেখায় তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
ছোট একটি বিরতির পরেই শহীদুজ্জামান সেলিম মঞ্চে আসেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রারম্ভিকতার শেষেই মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। আলোকিত হতেই দেখলাম মঞ্চে শুয়ে আছে চিরায়ত বাংলার এক অতি পরিচিত মেয়ে। পঞ্চনারীর আখ্যানের প্রথম নারী—জুলেখা। জুলেখা চেয়েছিল সুন্দর এক জীবন, মানুষের জীবন যেখানে সে প্রাণভরে নিশ্বাস নেবে। যেখানে তার খুব সামান্য চাওয়া পাওয়ার দাম থাকবে। নিজের মতো করে সে চলবে। কিন্তু পুরুষরূপী দানবদের কারণে আজ সে এক বন্দীশালা থেকে বিক্রি হয়ে আরেক বন্দীশালায় আটক। জুলেখা চরিত্রে রোজী সিদ্দিকী মিশে গেলেন বাজারে বিক্রি হওয়া লাখ লাখ এমন মেয়েদের মিছিলের মধ্যে। কোনো কিছু বোঝার আগেই যাদের শরীর চিরে খায় পুরুষরূপী হায়েনারা। সরল নিষ্পাপ এই মেয়েরা বাকি জীবনটা এমন করেই কাটিয়ে দেয়। কোথাও যাওয়ার এদের জায়গা থাকে না, কেউ গ্রহণ করে না। যেই পুরুষ ওদের ভোগ করে তারা ভুলেও ভাবে না যে এই মেয়েটিতো কারও মা বা বোন বা কারও মেয়ে।
এরপর মঞ্চে আসে অন্তরারূপী রোজী সিদ্দিকী। অন্তরা চলচ্চিত্রের সহযোগী অভিনয় শিল্পী। তারও ইচ্ছে ছিল একটি সুখী সংসারের। ভালোবেসে বিয়েও করেছিল। টেকেনি। লম্পট স্বামীর এখন শুধু টাকার প্রয়োজন হলেই তার কথা মনে পড়ে। তার ও তাদের একমাত্র ছেলের দায়িত্বও তাকেই নিতে হয়। ফিল্মের একস্ট্রা হিসেবে কতই-বা পায়। সমাজের তথাকথিত প্রগতিশীল আর ভদ্রলোক ভাইদের মনোরঞ্জনের জন্য সেবাদাসী তাকে হতে হয়, অভিনয়তো শুধু নামে! ছেলের চিকিৎসার টাকার জন্য তাকে অনৈতিক ব্যভিচারের অহবানেও সাড়া দিতে হয়। প্রগতিশীল আর ভদ্রলোক ভাইদের অন্ধকার চেহারাকে আলোতে আনার পাশাপাশি রোজী সিদ্দিকী যেভাবে অন্তরাদের প্রতিনিধি হয়েছেন তা দেখে মনে হয়েছিল আমি বুঝি এইভাবে নিগৃহীত বঞ্চিত ও অপমানিত কাউকে আমার চোখের সামনে দেখছিলাম। কখন যে চোখের কোণে পানি জমে উঠেছিল বুঝতেও পারিনি।

পঞ্চনারী আখ্যান নাটকের একটি দৃশ্যে রোজী সিদ্দিকী
পঞ্চনারী আখ্যান নাটকের একটি দৃশ্যে রোজী সিদ্দিকী

নাটকের তৃতীয় চরিত্রের নাম মনোরমা। মনোরমার বিয়ে হয়েছে উঁচু ঘরে। স্বামীর আয় রোজগার ভালোই। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবার যেমন চলে তেমনি চলে যাচ্ছে তার জীবন। কিন্তু মনোরমার পরিবারের দরকার একটি সন্তান। অনেক চেষ্টা তদবির করেও সন্তান হচ্ছে না। তার স্বামী ও সে দুজনই জানে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা তার স্বামীর নেই। কিন্তু এর দায় পড়ে মনোরমার ওপর। সে নাকি বন্ধ্যা! তার নপুংসক স্বামীসহ পরিবার সমাজ তাকে বন্ধ্যা মেয়েছেলে বলে দায় দেয়। অথচ সে জানে স্বামীর বীর্যে ক্ষমতা থাকলে সে মা হতো কবেই! এর পরেও মনোরমা ভালো থাকতে অভিনয় করেছে | সব অপমান নিজের গায়ে নিয়ে থাকতে চেয়েছে। মিথ্যা সুখাভিনয় দিয়ে মায়ের বাড়ির সবাইকে সুখী রাখতে চেষ্টা করেছে। ছোট ভাইকে তার সংসারের মিথ্যা সুখের কত গল্প করেছে। কারণ ভাইয়ের কাছ থেকে মা-বাবা সেগুলো শুনবে। ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে, আমাদের মেয়ে খুব সুখে আছে-এই ভেবে মা-বাবা খুশি হবেন। কিন্তু মনোরমার নিজের গায়ে সব দায় নিয়েও কি সব চাপা রাখতে পারবে? শেষ পর্যন্ত তা পারেনি। সত্য বেড়িয়ে এসেছে। এ যেন বাংলার হাজার হাজার মেয়ের চিরায়ত কাহিনি।

পঞ্চনারী আখ্যান নাটকের একটি দৃশ্যে রোজী সিদ্দিকী
পঞ্চনারী আখ্যান নাটকের একটি দৃশ্যে রোজী সিদ্দিকী

নাটকের চতুর্থ চরিত্রের নাম মরিয়ম। ঘর ভর্তি ছেলেমেয়ে রেখেও স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে। বিয়ের ব্যাপারে মরিয়মের মতামত নেওয়া হয়নি। মরিয়মের অজান্তেই বিয়ে করে। নিজের সতিনকে বরণ করে নিলেও ভাগ্যের পরিহাসে ছেলেমেয়েসহ ঘরছাড়া হতে হয় মরিয়মকে। চরম অর্থকষ্ট আর বসবাসের স্থানের অভাবে পড়ে মরিয়ম। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে এক আইনজীবীর পরামর্শে মরিয়ম আদালতে মামলা করে। প্রথম স্ত্রী হিসেবে মরিয়মের অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করায় আদালত তার স্বামীকে জেল ও জরিমানা করে। জরিমানার টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হয়। মরিয়ম কিছুই বুঝতে পারে না। জেল খাটাটা না হয় ঠিক আছে। তার স্বামী অন্যায় করেছে সে জন্য জেল খাটবে। কিন্তু জরিমানার টাকা সে এবং তার ছেলেমেয়েরা যদি নাই পাবে তাহলে সে কেন মামলা করতে গেল? সরকারের কোষাগারে টাকা জমা হলে তার ও তার ছেলেমেয়েদের লাভ কী? জেল থেকে বের হয়ে স্বামীতো তাকে ও তার ছেলেমেয়েদের আর স্বীকারও করবে না। ভেবেছিল জরিমানার এই টাকা দিয়ে সে কিছু একটা করে ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে কোনো রকমভাবে বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু তাও হলো না। সে বুঝে উঠতে পারছে না এ কেমন বিচার?

সমাপনী পর্বে রোজী সিদ্দিকী, শগীদুজ্জামান সেলিম ও অন্যরা
সমাপনী পর্বে রোজী সিদ্দিকী, শগীদুজ্জামান সেলিম ও অন্যরা

নাটকের পঞ্চম ও শেষ চরিত্রটি ছিল মমতাজ মহলের | মোগল সম্রাট শাহজাহানের পত্নী মমতাজ মহল, যার সমাধির ওপর সম্রাট শাহজাহান তৈরি করেছেন পৃথিবী বিখ্যাত তাজমহল। ইতিহাস থেকে উঠে এসে মমতাজ মহল বলে গিয়েছেন তাঁর মনের গহিনে লুকানো কথাগুলো। তার মতে তিনি সুন্দরী ছিলেন। সে হিসেবে তিনি ছিলেন শাহজাহানের খেয়ালি ভালো লাগা ভালোবাসা প্রকাশের যন্ত্র মাত্র। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। যখন ইচ্ছে তখন তাঁকে ব্যবহার করতেন। প্রকাশ করতেন শারীরিক ভালোবাসা। তারও যে একটি মন আছে, তারও যে ভালো লাগা মন্দ লাগার মতো একটি ব্যাপার থাকতে পারে সেটি কি সম্রাট কখনো জানতেন? মমতাজের ধারণা তাকে বাঁচতে দেয়নি স্বয়ং সম্রাট। মমতাজ প্রসবজনিত নানাবিদ সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন। রাজ দরবারের বড় বড় বৈদ্যদের কাউকেই মমতাজের চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়নি। সম্রাট অনুমতি দেননি। কারণ বৈদ্যদের সবাই পুরুষ ও পুরুষ বৈদ্যরা সম্রাজ্ঞীর নগ্ন অঙ্গ দেখে ফেলবে এটি সম্রাট মেনে নিতে পারবেন না। মমতাজ মারা গেলেন। সম্রাট শাহজাহান মমতাজের সমাধিতে নির্মাণ করলেন জগৎ বিখ্যাত তাজমহল। মমতাজের বর্ণনায় জীবিত অবস্থাতে তিনি ছিলেন সম্রাটের খেয়ালি ভালোবাসায় বন্দী আর মৃত্যুর পর সম্রাটের লোক দেখানো প্রেমের সমাধির মার্বেল পাথরে চাপা পড়া আরেক বন্দী। শ্রেষ্ঠ প্রেমের উপমা হিসেবে মমতাজের সমাধিতে সম্রাট শাহজাহানের তাজমহলকে বোঝানো হয়। এটি ভ্রান্ত। তাজমহল সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতা, প্রতিপত্তি আর কুক্ষিগত করে রাখার মহরত দেখিয়েছেন সম্রাট শাহজাহান। এখানে প্রেমের কিছু নেই।

ব্রিসবেন বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা
ব্রিসবেন বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা

নাটকটির শেষ দৃশ্যটি শেষ হওয়ার পর অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। মমতাজরূপী রোজী সিদ্দিকী যেন খুব সন্তর্পণে বলে গেলেন ভালোবাসা প্রকাশ করতে তাজমহল করতে হয় না। এভাবে ভালোবাসার মানুষকে বাজারে তুলতে হয় না। সবাইকে বলতেও হয় না। শুধু ভালোবাসার কথাগুলো ঠিকঠাকভাবে ভালোবাসার মানুষের মনের গহিনে পৌঁছে দিতে হয়। তার সবকিছুতে থাকতে হয়-সুখে, দুঃখে, আনন্দে, বেদনায়।
নাটকটি শেষ হওয়ার পর রোজী সিদ্দিকী ও শহীদুজ্জামান সেলিম দুজনেই দর্শকদের অনেক কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দেন। এক প্রশ্নোত্তরে রোজী সিদ্দিকী বলেন, তিনি আজ কয়েক বছর থেকে দেশের বাইরে এই নাটকটির প্রদর্শনী করে আসছেন। সব স্থান থেকেই খুব আশাব্যাঞ্জক সাড়া পেয়েছেন। অনেকেই দেশের বাইরে এখন থিয়েটার করার কথা ভাবছেন। দেশের বাইরে নাটক বা ঘটা করে থিয়েটার করা সাধারণত হয়ে ওঠে না। নাচ গান আবৃতি এসবের মধ্যেই বাঙালি অনুষ্ঠানগুলো সীমাবদ্ধ থাকে। তাঁর এই নাটকটি দিয়ে যদি তিনি কোনোভাবে দেশের বাইরে নাটক থিয়েটারের চর্চাটা শুরু করাতে একটু অবদান রাখতে পারেন, তাহলেই তার এই নাটকটি এককভাবে করতে গিয়ে তিনি যে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার কিছুটা হলেও সার্থক হবে। এই পর্বে শহীদুজ্জামান সেলিম ব্রিসবেন বাংলা স্কুলের মাহি মোরশেদ, সাঈদ চৌধুরী ও রাফিউল আলম লুলুকে সার্বিক সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান | রোজী সিদ্দিকী পুরো নাটকটি উপভোগের জন্য দর্শকদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান | ব্রিসবেনে পঞ্চনারী আখ্যানের এই প্রদর্শনীর মঞ্চ পরিকল্পনায় ছিলেন শহীদুজ্জামান সেলিম ও সংগীত পরিকল্পনায় ছিলেন সানজানা খান শ্রীমা |

ড. মুহম্মদ জে এ সিদ্দিকী শামিম: শিক্ষক ও বিজ্ঞানী, গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া |