কেনিয়ায় নববর্ষের আনন্দে প্রবাসী বাংলাদেশিরা

অনুষ্ঠানে বৈশাখী সাজে নারীরা
অনুষ্ঠানে বৈশাখী সাজে নারীরা

দক্ষিণ এশিয়ার সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ আর সুদূর আফ্রিকা মহাদেশে ভারত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ কেনিয়া-হাজার মাইলের ভৌগোলিক দূরত্বে অবস্থিত বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতি ও ভিন্ন সংস্কৃতির দুটি দেশ। জীবিকা ও পেশাগত দায়িত্বের প্রয়োজনে এ দেশের রাজধানী নাইরোবি ও অন্যান্য স্থানে ছোট একটি বাংলাদেশি কমিউনিটি বসবাস করে। একাকী প্রবাসজীবনে পরিবার, আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধব থেকে দূরে থাকা এবং দেশীয় স্বাদ ও আমেজের জন্য সারা বছর হা-হুতাশ করা এই বাংলাদেশি পরিবারগুলো হাজার মাইলের দূরত্ব আর সাংস্কৃতিক ভিন্নতর কষ্ট ভুলে যায় প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখের দিনটিতে।

বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। দৈনন্দিন হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও বছরে এই দিনটি পালন না করলে প্রবাসী বাঙালিদের জন্য একটা অসম্পূর্ণতা ও অতৃপ্তি থেকেই যায়। দিনটি এ বছর কেনিয়ার সরকারি ছুটির দিনে পড়ায় সকলের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মিলিত অংশগ্রহণে দিবসটি পালনের আনন্দ অন্য সময়ের চেয়ে এবার অনেক বেশি অনুভূত হয়েছে। ছোট আর বড়দের রং-বেরঙের বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশীয় পোশাক, সাজসজ্জা, ভোজনরসিক বাঙালির প্রিয় পিঠা-পায়েস, পান্তার আয়োজন আর দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কেনিয়ার হাইকমিশন প্রাঙ্গণটি হয়ে ওঠে আনন্দমুখর একটি ক্ষুদ্র বাংলাদেশ। সকলে মিলে লাল-সাদা শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে দেশীয় আমেজে বাংলা বর্ষবরণ প্রবাসীদের জন্য একটি অন্যতম উৎসব-আনন্দের দিনে পরিণত হয়েছে। দেশের সীমানা পেরিয়ে সুদূর বিদেশের মাটিতে নিজস্ব সংস্কৃতি তুলে ধরার এ প্রয়াস দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ এবং দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বেরই উদ্‌যাপন।

অনুষ্ঠানে বৈশাখী সাজে নারীরা
অনুষ্ঠানে বৈশাখী সাজে নারীরা

কেনিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে এবং রাজধানী নাইরোবি ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণে গত কয়েক বছর ধরে সাড়ম্বরে বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে গত রোববার (১৫ এপ্রিল) হাইকমিশন চত্বরে বরণ করা হলো বাংলা নববর্ষ ১৪২৫। এ বছর নববর্ষ পালনের আনন্দের সঙ্গে কেনিয়ার বাংলাদেশিদের জন্য যুক্ত হলো আরও দুটি প্রাপ্তি। উদ্বোধন করা হলো বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ হাইকমিশনের বাংলা ও ইংরেজি ওয়েবসাইটটি পুনরায় নতুনরূপে চালু করা হলো।

হাইকমিশনার, তার সহধর্মিণী ও বাংলাদেশিরা
হাইকমিশনার, তার সহধর্মিণী ও বাংলাদেশিরা

কেনিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ হ‌ুমায়ূন কবির ও তার সহধর্মিণী অ্যাডভোকেট তানজিনা আজিজ অনুষ্ঠানে আগত সকলকে শুভেচ্ছা জানান। নববর্ষ পালনের দিনব্যাপী আয়োজনের মধ্যে ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নজরকাড়া ফ্যাশন শো, ছোট ও বড়দের জন্য দেশীয় খেলাধুলা ও বিভিন্ন দেশীয় খাবারের আয়োজন। অনুষ্ঠানটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন আমিনুল ইসলাম সজল। রুমানা নকিবের আঁকা আবহমান গ্রাম বাংলার মঞ্চসজ্জা সকলের নজর কেড়ে নেয়। এষা মাহমুদের উপস্থাপনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয় জেইডেন, এইসন ও সুদীপ্তর কিবোর্ড ও বেহালার অপূর্ব সুরে জাতীয় সংগীত দিয়ে। ছোট্টমণি স্মিতার নাচ, রাইয়ান, রায়িদ, সায়ের, জুনায়েদ ও গালিবের কবিতা আবৃত্তি, রিমঝিমের গান সকলের মন ভরিয়ে দেয়। অনুষ্ঠানে একঝাঁক ছোট্ট শিশু তাজিন, হিবা, রোজালিন, আরিয়ান, আরহাম, জাহিন, রাইকা, মুনজারা, মুনতাহা ও রাশনিয়া উপস্থাপন করে বাংলার গ্রামীণ ও শহুরে জীবনযাত্রার নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ ছবি।

ছোট্ট স্মিতার নাচ
ছোট্ট স্মিতার নাচ

নাইরোবির বাঙালি শিল্পীদের কণ্ঠে ‘এসো হে বৈশাখ’ গান, মনমাতানো নানা বাংলা ফোক ও আধুনিক গানের সুর, কৌতুক ও যুগল-দম্পতিদের বাঙালি পোশাকের ওপর ফ্যাশন শোও ছিল মনোমুগ্ধকর। দুপুরে নানারকম মজার মজার খাবারের আয়োজন করেছিল হাইকমিশন। আর এই আয়োজনে সহযোগিতা করেন বাঙালি কমিউনিটির খাদ্য কমিটির সদস্যরা। পান্তা, বিভিন্ন রকম ভর্তা, ভাজি, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে চটপটি, পিঠা-পুলি, পায়েস, মিষ্টি, হালুয়া কিছুই বাদ যায়নি। দুপুরের ভোজনের পর বৈশাখী আয়োজনের মধ্যে আরও ছিল এম এ হান্নান ও মো. দাউদের পরিচালনায় মহিলাদের বালিশ খেলা, বাচ্চাদের চকলেট দৌড়, মোরগ লড়াই, ছেলেদের ডার্টসহ নানা খেলাধুলা প্রতিযোগিতা। যা ছোট-বড় সকলে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করে।

বৈশাখী সাজে ছোট্টমণি হিবা ও তার বাবা
বৈশাখী সাজে ছোট্টমণি হিবা ও তার বাবা

নাইরোবির এবারের নববর্ষ পালন আরও আনন্দঘন ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ‘বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। কেনিয়ায় বাংলাদেশি ছাড়াও ভারতের পশ্চিম বাংলার বেশ কিছু বাংলাভাষী রয়েছেন। তবে বাংলা ভাষাভাষীদের সংখ্যা স্বল্প হওয়ায় এখানে বাংলা মাধ্যমে কোনো স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ ছাড়া প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করায় নিয়মিত যোগাযোগের অভাবে বাংলা ভাষা চর্চা করার সুযোগ এখানে অত্যন্ত কম। বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা যাতে নিজের মাতৃভাষা বাংলা ভুলে না যায় ও নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে, সে লক্ষ্যে স্থানীয় বাংলাদেশিরা সন্তানদের বাংলা ভাষা শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ সৃষ্টির জন্য দীর্ঘদিন ধরে ইচ্ছা প্রকাশ করে আসছিলেন।

বৈশাখী নৃত্য
বৈশাখী নৃত্য

সম্প্রতি বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে আবুল কালাম মোহাম্মদ হ‌ুমায়ূন কবীরের দায়িত্ব গ্রহণের পর তার ঐকান্তিক আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বাংলাদেশি কমিউনিটির সকলের সার্বিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ হাইকমিশন প্রাঙ্গণে ‘বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’ নামে একটি বাংলা চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। হাইকমিশনার এবারের পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে এই চর্চা কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। কেন্দ্রে পাক্ষিক ভিত্তিতে মাসে দুদিন স্থানীয় বাঙালিদের স্বেচ্ছা অংশগ্রহণের ভিত্তিতে শিশুদের বাংলা বর্ণমালা ও সহজ ভাষা শিক্ষা দেওয়া হবে এবং পাশাপাশি সংগীত, আবৃত্তি ও শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ শেখানো হবে।

বৈশাখী সংগীত পরিবেশনা
বৈশাখী সংগীত পরিবেশনা

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমাদের সাহসী পূর্ব-পুরুষেরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার যে মহান উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই লক্ষ্য পূরণের প্রচেষ্টা হিসেবে এই ভাষা ও সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রবাসে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মরা বাংলা ভাষাকে হৃদয়ে ধারণ করবে ও দেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে আগ্রহী হবে-সেই আশাবাদ ব্যক্ত করে অনুষ্ঠান শেষ করা হয় পুরস্কার বিতরণ আর হাইকমিশনারের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে।

শারমিনা নাসরীন: নাইরোবি, কেনিয়া।

ফ্যাশন শো
ফ্যাশন শো