স্বর্গের শিশু-শিশুর মেলা

সুরনন্দন ভারতী পুরস্কারপ্রাপ্ত তিন শিক্ষার্থী
সুরনন্দন ভারতী পুরস্কারপ্রাপ্ত তিন শিক্ষার্থী

ফুল আর শিশু স্বর্গীয়। শিশুদের নিয়েই রসমঞ্জুরীর আয়োজন। ওদের মেলা বসেছিল। কেরালা সোশ্যাল সেন্টার ছিল নেদিন (২৮ এপ্রিল) তাদের ঠিকানা। কলকাকলিতে মুখর তখন গোটা হল। ওরা এসেছে সনদ নিতে। স্বর্গের সন্তানেরা এক এক করে মঞ্চে আসছে। হাতে তুলে নিচ্ছে আনন্দের সনদ।

রসমঞ্জুরীর অনুশীলনের বিষয় কত্থক। বিনোদন আসে মানুষের কথা বা গল্প বলা থেকে। গল্পের মধ্য দিয়ে একজনের সঙ্গে অন্যজনের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। কথায় কথায় তারা আসে কাছাকাছি। কথা বা গল্পই কিন্তু মানুষের আদি ও জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যম। এই গল্প বলার সঙ্গে যুক্ত হয় নৃত্যকলা। নৃত্য আর গল্প এই দুইয়ে মিলে জন্ম দেয় অনন্য নৃত্যের শাখা কত্থক।

দর্শকের সারি
দর্শকের সারি

কত্থকের পাশাপাশি এর চর্চা ওডিশি। ওরাও সেদিন সনদ নিল। তবে ওদের সংখ্যা কম। কুন্দন মুখার্জির এক শ শিক্ষার্থীর মধ্যে এ শাখায় শেখে ১৫ জন। এরা ওদিন নতুন বার্তা নিয়ে এল। রসমঞ্জুরীর তিন শিক্ষার্থী ছিনিয়ে এনেছে সুরনন্দন ভারতীর সেরা পুরস্কার। সুরনন্দন কলকাতায় সর্ব ভারতীয় আসরের আয়োজন করে। রসমঞ্জুরী সেখানে পাঠায় পাঁচ কিশোরীকে। এর মধ্যে সেরা তিন অহংকারের নাম অভিরামি অনিল কুমার, পল্লবী সেন শর্মা, নন্দা সেতু মেনন।
ভারত নয় শুধু ইউরোপ-আমেরিকায় আছে সুরনন্দন ভারতীর শাখা। সেখানে শিখছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গেছে তাদের নৃত্যচর্চার আসর। ঋতিষ চক্রবর্তী এই সাংস্কৃতিক মঞ্চের প্রধান নির্বাহী। রসমঞ্জুরীর কর্মাধ্যক্ষ বলেন, গান-কবিতা যুক্ত করে সুরনন্দন চায় তার প্রসার অব্যাহত রাখতে। এবার তারা সেরা পাঁচ নির্বাচন করে। সেই সেখানকার বড় আসরে রসমঞ্জুরীর শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়ে আনল শ্রেষ্ঠত্বের সনদ। এ কৃতিত্ব মেধাবী তিন শিক্ষার্থীর, এ মর্যাদা রসমঞ্জুরীর।

শিক্ষার্থীদের মায়েরা
শিক্ষার্থীদের মায়েরা

রসমঞ্জুরী প্রতি বছর করে থাকে এই অনুষ্ঠান। মঞ্চে উঠলেই সাজসজ্জার প্রশ্ন। সাজ পোশাক ছাড়া কোনো অবস্থাতেই মঞ্চে যাওয়া যাবে না। কিন্তু সেদিন তারা মুক্ত। তারা বিহঙ্গ। তারা ঐচ্ছিক পোশাকে এসেছে সেখানে। ও হ্যাঁ, ওরা কয়েকজন নেচেছেও। তাতেও ছিল অন্য পোশাক, অন্য পছন্দ। প্রদীপ জ্বালালেন রসমঞ্জুরীর প্রধান। সঙ্গে ছিলেন ধীরা মুখার্জি। নটরাজ বসা। তিনি অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের। নীতিক্ষা নাচল মারাঠি গানে।
ওই যে বললাম, আজ তারা স্বাধীন। বিশুদ্ধ কত্থক কিংবা ওডিশি থাকতে হবে এমন নয়। মিশ্রণ হতে পারে, হয়ও। মানশ্রী বাপনা নাচল আর একজনকে নিয়ে। আরও তিনটি নাচ হলো। শুরুর এ অংশে রমা নাচে, নৃত্য করে মৃণাল ও শর্বরী। বলিউড চলচ্চিত্রের গান। চমৎকার উপস্থাপনা। দারুণ এক মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় শ্রোতা দর্শকদের মাঝে।
ভারতের বেনারসের এক গল্প। রাজা যাচ্ছেন বন ভ্রমণে। তখন তিনি দেখেন কত্থকের নৃত্যকলা। স্বর্গের সুখ পেয়েছিলেন তিনি। তাইতো তাঁর নিজের জীবনকেও সাজালেন কত্থক ধারায়। গাছপালা তরুপল্লব নেচে ওঠে কত্থকে। নদী বয়ে যায়, পাখি গান গায়, সবারই এই চর্চা। চারপাশে যত কিছু তার মধ্যে দেখতে পান কথা বা গল্প বলার এই ধারাটি।

সনদ নিচ্ছে শর্বরী, শার্লি, দুর্বা, মৃণাল
সনদ নিচ্ছে শর্বরী, শার্লি, দুর্বা, মৃণাল

গল্প বলার এই অভিনব কায়দাটি ছড়িয়ে পড়ে লক্ষ্ণৌ থেকে জয়পুর। তারপর উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত। মধ্য যুগের শুরুর দিকে কত্থক বন্দনা হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। সে যুগের অনন্য সাহিত্য নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন ব্যক্ত করার মাধ্যম ছিল কত্থক। সেই সূত্র ধরে এখনো কত্থকে রাধাকৃষ্ণের রাসলীলার প্রভাব।
কত্থকে আগে মেয়েদের পোশাক ছিল খাগড়া-চোলি আর ঘোমটা দিয়ে ওড়না। আর ছেলেরা সাধারণত খালি গায়ে কেবল ধুতি পরেই এই নাচ প্রদর্শন করত। কেবলমাত্র বন্দনায় ব্যবহৃত হওয়ার কারণে এই শিল্প ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে। কিন্তু এর সৌন্দর্য ও সাবলীল গল্প বলার ভঙ্গি ছিল সর্বদা উজ্জ্বল। কত্থকের বিশেষত্ব এখানেই।
মাইক্রোফোন মণিকা বাপনার হাতে। তিনি এক ছাত্রীর মা। এই অনুষ্ঠানের মঞ্চ সঞ্চালকও তিনি। আহ্বান করা হচ্ছে সনদের জন্য। ছোটরা আসছে। সঞ্চালক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিচ্ছেন শিক্ষার্থীর কৃতিত্বের। রসমঞ্জুরীর গুরু জুড়ে দিচ্ছেন কথা। সাম্প্রতিক পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয়টি আনলেন। এদের সবাই সব সময় ফার্স্ট ডিভিশন পায়নি। পায়নি ডিসটিংকশন বরং কখনো সেকেন্ড ক্লাসও পেয়েছে। তবে তাদের আটকাতে পারেনি। ঠিকই শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি আনতে অসুবিধা হয়নি। দুজন পুরস্কার আনতে পারেনি, তারাও গর্বের শিক্ষার্থী। নিখুঁত তাদের নাচ। কত্থকের নিরলস শ্রম তাদের। তারা যোগ্যতা রাখে এ স্বীকৃতি পাওয়ার, বলেন তিনি।

দর্শকের সারি
দর্শকের সারি

মোগল রাজদরবারে আসে কত্থক। এতকাল ছিল ধর্মীয় বন্দনার মাধ্যম রূপে। এখানে এর স্থান হয় বিনোদনের। তখন নিম্নআয়ের গোষ্ঠীরা রাজদরবারে কত্থক প্রদর্শন করতেন। এখানে কত্থকের পরিবর্তন আসে। নৃত্যে আসে উন্নতি। শিল্পীরা নতুন নতুন চিন্তায় কত্থকে যুক্ত করেন নব নব ভঙ্গি। রসে ভরে ওঠে এ নৃত্য। সংগীতজ্ঞরা রাগ সংগীতকে সমৃদ্ধ করেন। আর কত্থক শিল্পীরা নতুন উদ্দীপনায় নৃত্যের আঙ্গিকে পরিবর্তন আনেন। কত্থকে যুক্ত হয় আকর্ষণীয় পালক।
শিক্ষার্থীরা কেউ আসেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে, কেউ আল আইন থেকে। কেউবা অন্য প্রদেশ থেকে। তারা আনন্দে গ্রহণ করেন সনদ। দুই চারজনের বেলায় আসা সম্ভব হয়নি। সে ক্ষেত্রে মা-বাবা কিংবা স্বজন নিয়েছেন সে প্রাপ্তি। ছাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন তরুণী। চাকরি করেন। হিসাবরক্ষণ কিংবা প্রকৌশল বিদ্যায় লেখাপড়া করেছেন তাঁরা। আছেন তরুণী মা, গৃহিণীও। সনদ নেওয়ার সময় তাঁদের আনন্দ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অন্যরাও উৎসাহিত হয়।

আপ্যায়নে ব্যস্ত তাঁরা
আপ্যায়নে ব্যস্ত তাঁরা

কত্থক ধীরে ধীরে রাধা-কৃষ্ণের রাসলীলা থেকে সরে আসে। তারপর উচ্চাঙ্গ সংগীত এবং বাদ্যযন্ত্রকে ভিত্তি করে দাঁড়ায়। এ সময় বেশভূষায়ও আসে পরিবর্তন। ছেলেরা চুড়িদার পায়জামা ও কুর্তা ব্যবহার শুরু করে। মেয়েরা চুড়িদারের সঙ্গে বড় ঘেরের কামিজ। এ ছাড়া মাথায় টুপি ব্যবহারের চলও শুরু হয় তখন।
শিক্ষার্থীরা আনন্দের সময় কাটায়। তাদের হাসি-খুশি মন উড়ে উড়ে চলে। তারা মাকে ছেড়ে মেশে সতীর্থদের সঙ্গে। কোনো কথায় একজন আরেকজনের গায়ে হেলে পড়ে। কী তাদের চপলতা। গুরু পছন্দ করেন এমনটি। বলেন, বয়সটা উচ্ছল তার। তাইতো মঞ্চ থেকেই উচ্চারিত হয়, রমা বড় চঞ্চল মেয়ে। মৃণালের দুষ্টুমি আকাশছোঁয়া।
মোগল আমলের পর কত্থকের বিকাশ কিছুটা থমকে দাঁড়ায়। তবে এখন কত্থকের শিল্পরূপ উন্মোচিত হচ্ছে বহুলভাবে। কত্থক রাস লীলায় কেবল যে তা নয়। এখন এ নৃত্যধারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছে উচ্চাঙ্গ সংগীতও। পাশ্চাত্য সংগীত, সমকালীন নাচ কিংবা পপ সংগীতের সঙ্গে নতুন মিশেল কত্থকের।
তাসনুভা এসেছে তার বড় বোন পুষ্পাকে নিয়ে। পুষ্পা মেডিকেল সায়েন্সের ছাত্রী। অন্যদিকে ছায়ানটে নেয় সংগীতের তালিম। মঞ্চ থেকে শিক্ষার্থী সনদ গ্রহণ করে। শুধু সে কেন জ্যেষ্ঠার মুখেও হাসি। প্রথমে কিছুটা অসতর্ক ছিল ঈমানী। তাই আবার এল গুরুর আশীর্বাদ নিতে। দুর্বা এখন তৃতীয় বর্ষে। বাপরে বাপ্! আধ্যা, মধ্যা, পূর্ণা—তারপরই না প্রথম, এখন তৃতীয় বর্ষে। এইভাবে কত দিন শিখবে! হ্যাঁ, শেখারতো শেষ নেই। মা বাবা ভাবেন, চলছে চলুক।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মায়েরা
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মায়েরা

মায়েদের মুখেও অসীম তৃপ্তি। তাঁরা আজ হেসে হেসে কথা বলছেন। গল্প জুড়ে দিচ্ছেন। উমা অনিল কুমার, ধানিয়া মেনন, স্মিতা থুকরুল ব্যস্ত আপ্যায়নে। লাকি হালদার উল্কা বসেছেন তরুণী মায়েদের নিয়ে। বর্ষা খাদিলকার, স্বাতী দাস, ভাবনা সুরানি, অর্পিতা খাটুয়া জমিয়ে তুলেছেন তাঁদের আড্ডা। আছেন আর এক জায়গায় অনুরাধা দার্নি, প্রমীলা ক্রাস্টা, অদিতি হাজরা। তোমার খোলা হাওয়া… লাগিয়ে পালে...আমি ডুবতে রাজি আছি। তাঁরা হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন তামাম পরিবেশ। সাবরিনা শাহাবুদ্দিন এসেছেনে সপরিবারে। মোহময় তাঁদের প্রকাশ।
তাঁরা সন্তানদের নিয়ে এক জায়গায় আসেন। সেখানে কর্মাধ্যক্ষ থাকেন। থাকেন স্বজনেরা। ক্যামেরার ক্লিকে জ্বলে ওঠে মঞ্চ। ক্লাসিক্যাল কত্থক নিয়ে কথা হচ্ছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। নৃত্যের এই ধারাটি কি তাহলে ক্ল্যাসিক থাকছে না! তা হবে কেন! ক্ল্যাসিক্যাল কত্থককে কেন্দ্রে রেখেই যুক্ত করা হচ্ছে এ সব অনুষঙ্গ। এ কারণে পূর্ব ইউরোপ কিংবা রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কত্থকের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এ যে এক সমন্বয়। ক্ল্যাসিক্যাল কত্থকের স্বচ্ছ মুদ্রা, মুঘলীয় কত্থকের দ্রুতলয় এবং আধুনিক কত্থকের দৃষ্টি নান্দনিকতা মিলে কত্থক হয়ে উঠেছে পরিপূর্ণ।
ওরা আনন্দ করে। কত্থকে বিকশিত করে নিজেকে। এক সঙ্গে মিষ্টি খায়। স্ন্যাক্স গ্রহণ করে কেউ। কথা ও গল্পে গোটা হলকে হাতের ভেতর নিয়ে নেয়। ওরা আজ সবাই রাজা। ওরা ওদের রাজার রাজত্বে। ওরা আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে। স্বর্গের শিশুরাতো এমনই। আসতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তারপরও দৌড়াতে হয়। কারণ এক বোঝা কাজ তখন ঘাড়ের ওপর।

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।