অসম দিন-রাতের রোজা

মাহবুব মানিক।
মাহবুব মানিক।

বিকেল সাতটা বাজে! সূর্য তখন পশ্চিম আকাশের কার্নিশে মাত্রই হেলেছে! শুনতে খুব অদ্ভুত লাগলেও জার্মানিসহ মেরুর দেশগুলোতে এটাই হচ্ছে হরহামেশাই আরও অবাস্তব মনে হয় যখন দেখি ঘড়িতে আটটা বাজে অথচ সূর্য তখনো পশ্চিম আকাশে হেলছে কিন্তু ঘাড় ধরিয়ে ও সূর্য ব্যাটাকে ডুবানো যাচ্ছে না৷ যদিও জার্মান ব্যাকরণ মতে সূর্য ব্যাটা নয় বেটি (স্ত্রী লিঙ্গ)৷ এ জন্যই হয়তো সূর্যের তাপ কম কিন্তু সৌন্দর্য বেশি৷ বাংলাদেশে থাকতে দিন-রাত্রির অসম ব্যবধানের ব্যাপারটা আপাত-অবাস্তব মনে হলেও বর্তমানে এসব অস্বাভাবিকতা স্বাভাবিক হয়ে গেছে৷

আমরা বাংলাদেশিরা রাত নেমে পৃথিবীটা অন্ধকার হলেই মনে করি ঘুমানোর উত্তম পরিবেশ৷ যদিও এখন ভিন্ন জগতের অদ্ভুত সব নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়৷ রাতের জন্য নির্ধারিত সময়ে দিনের আলো দেখতে দেখতে ঘুমাতে যেতে হয়৷ রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারের অপেক্ষা করলে আর ঘুমানোর সময় পাওয়া যাবে না!

আমরা যারা মেরুর কাছাকাছি দেশগুলোতে থাকি, তাদের প্রতিনিয়ত প্রকৃতির অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়৷ বছরের পরিক্রমায় কখনো এমন হয় যে দিনের দেখা নেই৷ সকাল-বিকেল বলে কিছুই নেই৷ সবই প্রায় রাত৷ আবার কখনো সন্ধ্যা-রাত বলে কিছু নেই৷ সবই প্রায় ঝকঝকে দিন৷

আমার শহরে এখন সন্ধ্যা নামছে নয়টায়৷ মাত্রই বসন্ত চলছে৷ গ্রীষ্ম কাল দ্বারপ্রান্তে৷ বছরের পরিক্রমায় দিনের পরিধি এখনো বাড়ন্ত৷ বাড়তে বাড়তে মাস দু-একের মধ্যে সন্ধ্যা নামবে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে৷ দিনের আলো ফুটবে মাত্র দুইটা (রাত) বাজলেই৷ এমন অস্বাভাবিক দিনগুলোতে বিছানায় ঘুমোতে যেতেও সমস্যায় পড়তে হয় ৷ কারণ আমরা বাঙালিরা ঘুটঘুটে কালো রাত না নামলে রাতের ঘুমকে স্বাভাবিক ঘুম মনে করি না৷ দিনের দৈর্ঘ্য যখন বাড়ন্ত ঠিক সে সময়েই পবিত্র রমজান মাসের আগমন৷ একটি অস্বাভাবিক দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্যের ব্যবধানে প্রতিটা রোজা রাখা যেখানে সত্যি ই চ্যালেঞ্জের ব্যাপার৷

দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নয়টা বাজতেই মোবাইল ফোনে মাগরিবের আজান বেজে উঠল৷ মসজিদের পাশেই বাসা৷ হেঁটে যেতে পাঁচ থেকে সাত মিনিট সময় লাগে৷ বাংলাদেশে এমন ব্যবধানে মসজিদ থাকলে নির্ঘাত প্রতি ওয়াক্তের আজান মসজিদ থেকেই শুনতে পেতাম৷ এই শহরে মসজিদ একটাই৷ সৌভাগ্যক্রমে এটি আমার বাসার পাশেই৷ দূরদূরান্ত থেকে মুসলিম এখানে আসে নামাজ পড়তে৷ একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেই বাসাটি মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে৷ বিভিন্ন দেশের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজে দাঁড়াই৷ বাংলাদেশে মসজিদের নামাজে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষ দেখা যায় না৷ এখানে আমরা প্রকাশ্যে আজান শুনতে পাই না৷ জার্মানিতে প্রকাশ্যে আজানের অনুমতি নেই৷ অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতোই মোবাইলে আজান শুনে দেশে থাকার একটা তৃপ্তি নিতে হয়৷ নামাজের সময় জানতে ও মোবাইল ফোনের অ্যাপের ওপরেই ভরসা করতে হয়৷

ছোট-বড় ঘুম দিয়ে ভোররাতে উঠে সাহ্‌রি খেতে আমরা পারি না৷ একবারেই সাহ্‌রি খেয়ে ঘুমাতে যেতে হয়৷ ভোর রাত বলতে দুইটা থেকে আড়াইটা৷ তিনটায় মোটামুটি ভোর৷ চারটায় সকাল৷ যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততায় আমাদের অত রাত জাগা সম্ভব হয় না৷ কারণ ভোরবেলাতে অফিস থাকে৷ খুব ভোরে উঠতে হয়৷ যান্ত্রিক জীবন আমাদের৷ এখানে মানুষের আবেগ-অনুভূতি দিয়ে কিছুই চলে না৷ সবাই যান্ত্রিক৷ এমনিতেই জার্মানদের আমরা ‘মানুষ রোবট’ বলি৷

যান্ত্রিকতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তাই দ্রুত সাহ্‌রি করে শুতে যেতে হয়৷ এর ফলাফল ও সুখকর নয়৷ রাত ১২টা থেকে সন্ধ্যা নয়টা৷ রোজার দিনে কর্মদিবসগুলোয় মোটামুটি একুশ ঘণ্টা পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয়৷ ক্রমান্বয়ে ব্যবধান আরও বাড়ছে৷ এমনিতে দীর্ঘ সময় পানাহার বিরত দিয়ে থাকতে আমার খুব একটা সমস্যা হয় না৷ যদিও দীর্ঘদিনের মাইগ্রেনের সমস্যাটা পীড়া দেয়৷ বিকেল আটটা নাগাদ কপালের কোনো এক পাশে চোখের কোটরসহ চিনচিন করা ব্যথা জানান দেয় সারা দিন অভুক্ত আছি৷ তবুও কষ্ট নিয়েও সংযমের মাসে সংযত থাকার প্রাণপণ চেষ্টা আমাদের৷

মাহবুব মানিক, গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি